পড়াশোনা বা কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই বা উপন্যাস পড়তে সবারই ভালো লাগে। কিছু উপন্যাস আছে যেগুলো একবার পড়লে বারবার পড়তে ইচ্ছে হয় এমনকি আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। যেগুলো পাঠককে নিজে থেকেই গল্পের ভিতরে নিয়ে যায়, পাঠককে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। পাঠকের নরম মনকে শক্ত করতে এবং পাঠককে বাঁচতে, আত্নবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল করতে শিখায়। “সাতকাহন” তেমনি একটি উপন্যাস।
সমরেশ মজুমদার ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটিতে যে মেয়েটির চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, সে আর দশটি মেয়ের মতো নয়। জীবনসংগ্রামী, আত্মনির্ভরশীল এক অসাধারণ বাঙালী নারীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এই সাতকাহন উপন্যাসটিতে। প্রকৃতপক্ষে এ উপন্যাসটির সূচনা, বিস্তৃতি এবং প্রবাহধারা একজন নারীকে নিয়ে। যার নাম দীপাবলি বন্দ্যোপাধ্যায়।
আপাত দৃষ্টিতে এই উপন্যাসটিকে শুধু মাত্র একজন নারীর গল্প মনে হলেও, দীপা হলো সেই সব নারীদের প্রতিনিধি যাদেরকে এই পুরুষ শাসিত সমাজ কখনো সংস্কার, দুর্বলতা আবার কখনো লালসার ভয় দেখিয়ে হতাশার কাল কুঠুরিতে ছুড়ে ফেলতে চায়, কিন্তু এই দীপা নামক মেয়েরা কখনো দমে না, হারে না।
লেখক প্রতিটি নারীকেই উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, “একফোঁটা চোখের জল, একশো ফোঁটা রক্তের চেয়েও দামি”। এই উপন্যাসটি প্রতিটি নারীর চোখ খুলে দিবে তাদেরকে বাঁচতে শিখাবে এই সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
সমরেশ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ১৩৪৮ সনের ২৬শে ফাল্গুন, ১০ ই মার্চ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। তার শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। তিনি বাংলায় স্নাতক সম্পূর্ণ করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তার প্রচন্ড আসক্তি ছিল। তার প্রথম গল্প “অন্যমাত্রা” লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে, আর সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু। তার প্রথম লেখা অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিলো দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে।
সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস “দৌড়” ছাপা হয়েছিল দেশেই ১৯৭৬ সালে।তিনি শুধু তার লেখনী গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি;ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনিতে তার জুড়ি মেলা ভার।
সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলোর মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, সপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রুপকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
দীপাবলিঃ উপন্যাসের নায়িকা। হার না মানা এক সংগ্রামী সাহসী নারী হিসেবে দেখা গিয়েছে তাকে।
অঞ্জলিঃ দীপাবলির মাসি।দীপাবলিকে নিজের সন্তানের মতই ভাবতেন।
অমরনাথঃ দীপাবলির মেসো।দীপার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তার পাশে ছিলেন তার এই বাবা নামক মানুষটি অমরনাথ।
মনোরমাঃ দীপাবলির ঠাকুমা।
মাষ্টার সত্যসাধন বাবুঃ তিনি তার অভিজ্ঞ চিন্তা শক্তি দিয়ে দীপার মাঝের মেধাবী সত্ত্বাকে সহজেই চিনে নিয়েছিলেন।
অলোক মুখার্জিঃ দীপাবলির স্বামী ছিলেন। বেশিদিন টিকে নি তাদের সংসার।
একটি মেয়ের গল্প, যে কিনা ছোটোবেলা থেকেই অনেক দুরন্ত ছিলো। ছোটোবেলা থেকেই সে সব ধরনের বাঁধা-বিপত্তি থেকে মুক্তি চেয়েছিল। মুক্ত পাখির মত আকাশে উড়ে বেড়াতে চেয়েছিল। জীবনে চলার পথে একজন মেয়ে হিসেবে যত রকম বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তার প্রায় সব ধরনের বাঁধার সম্মুখীন সে হয়েছে।
পদে পদে সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে চলা একটি মেয়ে, নাম তার দীপাবলি। নাম শুনেই বুঝে গেছেন যে আমি সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন এর কথা বলছি। এই সাতকাহন উপন্যাসটিতে আমার খুঁজে পাই দীপাবলি নামের মেয়েটিকে। চা বাগানের সেই পাহাড়ি এলাকাতে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে। বাবার চাকরির সূত্রে তার বড় হওয়া সেখানে।
এই বইটি ঠিক যে সময়কার পেক্ষাপটে লেখা ঠিক সেই সময়ে পুরুষশাসিত সমাজ নারীর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে নারীবাদী চেতনা। সমাজের অনেক পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে একজন মেয়ের উপরে উঠে আসার গল্প।
দীপাবলির মায়ের মৃত্যুর পর তার জন্মদাতা পিতার কাপুরুষতায় তার আশ্রয় মেলে তার মাসি-মেসোর সংসারে। অপরের সন্তান না মনে করে, নিজের সন্তান এর মত ভালোবাসতেন দীপাকে তার মাসি-মেসো। নিজের দুইটা সন্তান থাকতেও তারা দীপাকে বুকে টেনে নিয়েছিল।অমরনাথের মা মনোরমাও দীপাকে কখনো আলাদা করে দেখেনি।
কিন্তু বৈধব্যের সংস্কারের কারণে নারী পুরুষের ভেদাভেদের চেতনায় মনোরমা সারাক্ষণ দীপাকে আবদ্ধ রাখতে চাইত। মাষ্টার সত্যসাধন বাবু তার অভিজ্ঞ চিন্তা শক্তি দিয়ে দীপার মাঝের মেধাবী সত্ত্বাকে সহজেই চিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই সমাজের সংস্কারগুলো দীপার পরিবারের মানুষগুলো পিছু ছাড়ে না।
মাত্র এগারো বছর বয়সে এক বিত্তবান ছেলের সাথে দীপার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পরের দিন তার স্বামী মারা যায়।আর তারা দীপাকে পাঠিয়ে দেন তার বাপের বাড়িতে। এরপর থেকেই জীবনের বিভীষিকাময় দিন গুলি সামনে আসে দীপার।দীপার এই দশার জন্য তার বাবা অমরনাথ নিজেকে দায়ী ভাবেন।
তাই তার নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়তো দীপার পড়াশোনা বন্ধ করতে দেননি। দীপা পড়াশোনায় নিজেকে উজাড় করে খোঁজে তার মুক্তির পথ। মাধ্যমিক মেধাবী ফলাফল করে জলপাইগুড়িতে ভর্তি হয় উচ্চ মাধ্যমিক এর জন্য। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডিও পার হতে দীপাকে খুব বেশি অসাধ্য সাধন করতে হয়নি।
কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হবার পরে অমরনাথ এর মৃত্যু হয়। অমরনাথের স্বাভাবিক মৃত্যু তার মা কখনো মেনে নিতে পারেনি। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হলো দীপাকে। তাই অঞ্জলি দীপাকে তার পরিবারের ছায়া থেকে বের করে দেওয়া হলো।এরপর থেকে দীপার জীবনে আরো অন্ধকার নেমে আসলো। সে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল।
পাশে এসে দাড়াবার মত খুঁজে পেল না কাউকে। তবু দীপা কি পেরেছিল এই সমাজের হিংস্র আর স্বার্থান্বেষী শকুনের ভিড়ে নিজেকে রক্ষা করতে? তার পরবর্তী জীবন কেমন হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে চলতে হবে দীপাবলির সাথে।দীপাবলির জীবন চলতে থাকে একটি সদ্য বিধবা মেয়ে কিভাবে পড়াশোনা চালিয়ে, নানা বাঁধা অতিক্রম করে চলে আসে শহরের দিকে। শহরের জীবন যাপন শুরু করে সাদামাটাভাবে।
যেই ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল, ঠিক সেই মানুষগুলোর জন্য বিধবার জীবন যাপন করতে হয়েছিল সেই মানুষগুলোকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেয় নি। সেই মানুষগুলোকে নিয়ে সে তার নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটা জায়গায় যাওয়া ঠিক যেখান থেকে সে সমঅধিকার পাবে।
আরও পড়ুনঃ বাংলা মৌলিক থ্রিলার এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা
যে মানুষগুলো অধিকার বলে, ক্ষমতা বলে এই ধরনের অধিকার ফলিয়েছে, নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে, দীপাবলি ঠিক সেই জায়গাতে যেতে চেয়েছিল। এবং ঘটনার পরিক্রমায় আমরা দীপাবলিকে পাব ঠিক সেই ক্ষমতার অধিকারিণী হিসেবে কিন্তু ক্ষমতাই সব!! না। এই দীপাবলিকে আমরা পাব পৃথিবীর সবচাইতে নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে। দীপাবলি তার জীবনে যাকে পেয়েছিল, যতবার আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, ভালোবেসেছিলেন কিন্তু কেউই হয়তোবা নারী বলে তার এই ভালোবাসাটাকে পর্যাপ্ত মর্যাদা দিতে পারে নি।
কিংবা দীপাবলি যে ক্ষমতার অধিকারিণী সে ক্ষমতা পছন্দ করেননি কিংবা তাদের চরিত্রগুলোই এমন ছিল। সবশেষে আমরা খুঁজে পাব এমন এক দীপাবলিকে যে দীপাবলি পৃথিবীর সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে সে উঠে আসে প্রত্যন্তঅঞ্চল থেকে তার বিধবার জীবন থেকে নতুন সংসার জীবন, চাকরির জীবন, নতুন সংসার জীবন থেকে ভালোবাসার মানুষ আবার ভালোবাসার মানুষকে ত্যাগ করা এবং দিনশেষে শুধুমাত্র একটি মানুষকে নিয়ে বেঁচে থাকা যেই মানুষটি হয়তোবা পরোক্ষভাবে তার জীবনের সব কষ্টের জন্য দায়ী ছিলেন।
কিন্তু তবুও সেই মানুষটিকে দীপাবলি তার জীবন থেকে ত্যাগ করেন নি।“সাতকাহন”এ আমরা যেই দীপাবলির চরিত্র পাই আসলে এই বইটি দুই খন্ডে বিভক্ত। সমরেশ মজুমদার যখন প্রথম খন্ড প্রকাশ করেছিলেন তখন পাঠকদের প্রবল আকর্ষণ দেখে এবং পাঠকদের থেকে নানা ধরনের চিঠি পেয়ে তিনি ভেবেছিলেন আরও কিছু লেখা দরকার তাই সে নতুন খন্ড লিখলেন। কিন্তু নতুন খন্ডে অন্য দিকে মোড় তার।
নতুন খন্ডে আমরা দেখতে পাব এক দীপাবলির জীবনে আাসা নানা পুরুষ শুধু মাত্র একটি কুসংস্কার বা একটি বৈধব্য জীবনের দিকে তাকিয়ে চলে গেছে পিছন দিকে। একজন এগিয়ে এসেছিল কিন্তু ওই যে কথায় আছে না যার সাথে ঘর বাঁধে সেই কিন্তু মনের মানুষ হয় না। তাই খুব সুখের কাটেনি তার সংসার জীবন।
কিন্তু দীপাবলি প্রমাণ করে দিয়েছে নারীর জীবন কি শুধু সংসার জীবন!! না দীপাবলি দেখিয়েছেন সংসার জীবনের বাইরে গিয়েও একটা পুরুষের জীবন যেভাবে হতে পারে একটা নারীর জীবন ও কিন্তু সেভাবে হতে পারে। যদি নিজে বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে প্রবল করা যায় তাহলে কোন বাঁধাই যে আসলে বাঁধা নয় তাই কিন্তু আমাদের দীপাবলি দেখিয়েছেন।
মন্তব্য লিখুন