বাংলা সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে সত্যজিৎ রায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতার শিল্প সাহিত্যে সুপরিচিত রায় পরিবারে তার জন্ম। তিনি একাধারে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, লেখক, চিত্রকর এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। প্রপিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় এবং পিতা সুকুমার রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি সত্যজিৎ রায়। তাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। কেবল চলচ্চিত্র অঙ্গনই নয়,সাহিত্যে তার অবদান অপরিসীম। বাঙালী পাঠকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় তার রচিত গ্রন্থসমূহ। সত্যজিৎ সৃষ্ট বিখ্যাত বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় এক চরিত্র “ফেলুদা“।
বাংলা সাহিত্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাপক জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে “সন্দেশ” পত্রিকায় ফেলুদাকে নিয়ে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় যার নাম ছিল “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি”। এর পরের বছরগুলোতে ফেলুদা সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলো প্রকাশিত হতে থাকে।
অধিকাংশ কাহিনীই ১ম পূজাবার্ষিকী “দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং কিছু গল্প প্রকাশ করা হয় “সন্দেশে”। ফেলুদার শেষ উপস্থিতি “রবার্টসনের রুবি” (রচনাকাল অনুযায়ী), এবং “ইন্দ্রজাল রহস্য” (প্রকাশকাল অঅনুযায়ী) গল্পে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ৩৫টি সম্পূর্ণ ও ৪টি অসম্পূর্ণ ফেলুদা কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে।
বেশিরভাগ অঙ্কন এবং প্রচ্ছদের কাজ সত্যজিৎ রায় নিজেই করতেন। পরবর্তীতে এ সিরিজকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স। ফেলুদা মূলত সত্যজিৎ রায়ের শৈশবে পড়া শার্লক হোমস থেকে অনুপ্রাণিত। তবে লেখকের নিজস্ব গগল্পগুলো ফেলুদাকে গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র চরিত্র হিসেবে। ফেলুদা সিরিজের সব কয়টি কাহিনী ইংরেজিতে অনুদিত।
ফেলুদা এক বাঙালী প্রাইভেট ডিটেকটিভ। যার নেশা বলতে এক গোয়েন্দাগিরি আর সিগারেটের ব্র্যান্ড চারমিনার। ফেলুদার ভালো নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র আর ডাকনাম ফেলু। নয় বছর বয়সে বাবা মাকে হারালে কলকাতার ২১ রজনী সেন রোডে বসবাসরত তার কাকার কাছেই মানুষ তিনি।
খুড়তোতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে, যে কিনা তার সহকারীও। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির কাহিনী জানা যায় তোপসের জবানিতেই। এ কারণে তাকে সবাই ফেলুদা বলেই বেশি জানে।
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার ফেলু মিত্তির মার্শাল আর্টে পারদর্শী। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে তিনি মগজাস্ত্র বলে থাকেন। এ মগজাস্ত্রের গুণেই অসাধারণ একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়ে ওঠেন ফেলুদা। তার নিজস্ব পয়েন্ট থ্রি টু কোল্ট রিভলভার থাকলেও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এটি ব্যবহার করেন না তিনি। নিয়মিত শরীরচর্চা, ভোরে যোগব্যায়াম করা এবং প্রচুর বই পড়া তার প্রাত্যহিক কাজ।
অন্যান্য কিছু চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তোপসে, রহস্য রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি (ছদ্মনাম জটায়ু), সিধুজ্যাঠা এবং মগনলাল মেঘরাজ। মগনলাল ফেলুদার এক শত্রু যাকে ৩টি গল্পে যথা “জয় বাবা ফেলুনাথ”, “যত কান্ড কাঠমান্ডুতে”, “গোলাপী মুক্তা রহস্য” দেখা যায়।
ফেলুদার নেশা এবং পেশা গোয়েন্দাগিরি। অসাধারণ মেধা এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার গুণে জটিল সব কেসের সমাধান করেন তিনি। কেবল ভারতের নানান স্থানই নয়, কেস সমাধানে তিনি বিদেশেও গিয়েছেন বহুবার।
সহকারী তোপসে এবং লেখক বন্ধু জটায়ু হন তার সঙ্গী। তদন্তে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠলেই ফেলুদা দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে চারমিনার ফুকতে ফুকতে বিস্তর চিন্তা করেন মগজাস্ত্রের সাহায্যে। তদন্ত শেষে বেশ নাটকীয়তার সাথে অপরাধী সনাক্ত করেন তিনি।
যদিও স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত শার্লক হোমস চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ফেলুদার সৃষ্টি, তারপরেও সত্যজিৎ রায়ের গল্প বলার আলাদা ধরন, বাঙালীয়ানা এবং সরস বর্ণনার গুণে ফেলুদা বাংলা সাহিত্যে আলাদা স্থান করে নিয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে ফেলুদার ১১টি কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ২টি চলচ্চিত্র “জয় বাবা ফেলুনাথ” এবং “সোনার কেল্লা” নির্মিত হয়েছে।
এরপর সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় নির্মাণ করেছেন “বাক্স রহস্য”, “বোম্বাইয়ের বোম্বেটে”, “কৈলাসে কেলেঙ্কারি”, টিনটোরেটোর যীশু”, “গোরস্থানে সাবধান”, “রয়েল বেঙ্গল রহস্য”, “বাদশাহী আংটি”, এবং “ডবল ফেলুদা”। ডবল ফেলুদা নির্মিত হয়েছে ২টি গল্প “সমাদ্দারের চাবি” এবং “গোলকধাম রহস্য” কে একত্রিত করে।
চিত্রঃ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “সোনার কেল্লা”তে ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
সত্যজিৎ পরিচালিত চলচ্চিত্র দুটিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকি ফেলুদার পরবর্তী বিভিন্ন অঙ্কনেও সৌমিত্রের চেহারার সাথে সাদৃশ্য লক্ষনীয়। বোম্বাইয়ের বোম্বেটে থেকে শুরু করে পরবর্তী বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই সব্যসাচী চক্রবর্তী ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেন।
চিত্রঃ “রয়েল বেঙ্গল রহস্য” চলচ্চিত্রে ফেলুদা রূপে সব্যসাচী চক্রবর্তী
তিনি ফেলুদা নিয়ে তৈরি একটি টেলিফিল্ম এবং টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন। কেবল ২০১৪ সালে নির্মিত “বাদশাহী আংটি” চলচ্চিত্রে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস নামে হিন্দিতে ফেলুদা সিরিজের “যত কান্ড কাঠমান্ডুতে” গল্প অবলম্বনে একটি সিরিজ নির্মিত হয়েছিল। এতে শশী কাপুর ফেলুদা চরিত্র রূপায়ন করেছিলেন।
বাংলাদেশের চ্যানেল আই, বায়স্কোপ এবং আড্ডা টাইমসে ফেলুদা সিরিজের ৩টি গল্পে “শেয়াল দেবতা রহস্য “, “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা “ এবং “গোলকধাম রহস্য” ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন “নয়ন রহস্য “ যাতে ফেলুদার ভূমিকায় ছিলেন আহমেদ রুবেল।
চিত্রঃ “ফেলুদা ফেরত” ওয়েবসিরিজে ফেলুদা টোটা রায় চৌধুরী
২০১৯ এ সৃজিত মুখোপাধ্যায় ফেলুদাকে নিয়ে “ফেলুদা ফেরত” নামে একটি ওয়েব সিরিজ তৈরির ঘোষণা দেন । “ছিন্নমস্তার অভিশাপ “ এবং “যত কান্ড কাঠমান্ডুতে “ এ দুটি গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ সিরিজটিতে ফেলুদার ভূমিকায় ছিলেন টোটা রায় চৌধুরী।
বিভিন্ন সময়ে তোপসে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য এবং ঋদ্ধি সেন। লালমোহন গাঙ্গুলী তথা জটায়ু রূপে বিভিন্ন সময়ে সন্তোষ দত্ত, রবি ঘোষ, বিভু ভট্টাচার্য এবং অনির্বাণ চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন।
এছাড়াও ফেলুদাকে নিয়ে রয়েছে অসংখ্য কমিক-স্ট্রিপ। ছোট বড় সকল পাঠকদের জন্যই দারুণ উপভোগ্য এসব কমিক।
বাংলা সাহিত্যে যেসকল গোয়েন্দা চরিত্র রয়েছে, তাদের মধ্যে ফেলুদা অন্যতম প্রধান এবং তুমুল জনপ্রিয় একটি চরিত্র। সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য এ চরিত্রের আবেদন বর্তমান সময়েও এতটুকু কমেনি। বরং ফেলুদার অসাধারণ বুদ্ধি, তোপসের সুখপাঠ্য বর্ণনা এবং জটায়ুর ভুলে ভরা রহস্য রোমাঞ্চ বইয়ের গল্প বর্তমানেও পাঠকদের মাঝে সমান ভাবে জনপ্রিয়।
মন্তব্য লিখুন