“এটাই প্রথম লাশ। এই প্রথম গুলিবিদ্ধ হয় মিছিলের সময়। এর রক্তই সর্বপ্রথম রাজপথে রক্তবন্যা সৃষ্টি করে। হ্যা, এই প্রথম শহীদ”। সবার মনেই কয়েকটা শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে-“প্রথম গুলি, প্রথম রক্ত, প্রথম শহীদ “
পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় করার দাবি মোটেই অযৌক্তিক নয়-ডাইনিং এ দুপুরের খাবার খেতে বসে এই মর্মে ১০ মিনিটের লম্বা বক্তৃতা দিলো লাহোর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন বাঙালি ছাত্র। মো: সরফরাজ নজরুল ইসলাম নামের সেই ছাত্রের ভাষণ উর্দুতে শুনে রক্ত গরম হয়ে যায় উপস্হিত ছাত্রদের।
দুর্ভাগ্যবশত তাদের সাথে কোনো ছাত্রী ভর্তি হয়নি। আর ইঞ্জিনিয়ারিং এ ছাত্রীদের উপস্হিতি তখনকার সময়ে ছিলো হাতে গোনা। বাঙালি মাত্র সরফরাজ সহ তিনজন। তার দুইজন বাঙালি বন্ধুর রক্ত গরম ভাবটা অনেক্ষণ স্হায়ী হল। কিন্তু বাকি যারা পশ্চিম পাকিস্তানী, তাদের মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত গরম ভাবটা আর দেখা গেলো না। বরং সরফরাজের জন্য এক প্রকার ঘৃণা কাজ করতে শুরু করলো। করবে নাই বা কেনো? তাদের মাতৃভাষার সম মর্যাদায় বাংলাকে আসীন করতে চায়! সাহস কত বড় বাঙালি এই ছোকড়ার!!
আব্বাস নামের এক ছাত্র ব্যপারটা ডিপার্টমেন্টের হেড কে জানালো। জানাতে হতোই। এটা তার দেশের প্রতি দায়িত্বের একাংশ। কাজের দৃষ্টিকোণ অনেক হয়। পাকিস্তানি দৃষ্টিকোণ থেকে কাজটা নৈতিক পর্যায়ে পড়লেও সরফরাজসহ বাঙালি তিনজন ছাত্র বিষয়টাকে বাংলা ভাষার প্রতি শত্রুতা হিসেবে নিলো।
তমুদ্দুন মজলিশের আহব্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কাশেমের সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করে সরফরাজ। তার বাবার বন্ধু এই আবুল কাশেম নামের ভদ্রলোক বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষের লোক -এরকমটাই ধরে নিলো সরফরাজ। কারণ তমুদ্দুন মজলিশ কর্তৃক প্রকাশিত “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু” বইটা পড়েছে সরফরাজ। ভালো লেগেছে তার। বাংলা ভাষা যে সময়ের দাবি, সেটা বুঝতে বাকি থাকলো না তার। কাশেম আংকেল এর টেলিফোন নম্বরটা বাবার থেকে এবার পূর্ব পাকিস্তানে যেয়ে সংগ্রহ করবে সরফরাজ। দরকার হলে কোনো বড় আন্দোলন করার সময় আংকেল কে সাহায্য করতে পারবে সে।
যাই হোক আব্বাস সরাসরি কলেজের প্রিন্সিপাল কে অভিযোগ করেছে। ব্যপারটা যেন তেন নয়। বাঙালি একজন….. না না তিনজন….. তিনজন বাঙালি ছাত্র লাহোরে বসে সে দেশের ভাষার সমমর্যাদায় আরেকটি ভাষাকে অধিষ্ঠিত করতে চায়!! কোথায় উর্দু, কোথায় বাংলা!! রাষ্ট্রদ্রোহীতা তো এটা!!
ব্যাস। দেশপ্রেমিক প্রিন্সিপালের মাথায় আগুন ধরে গেল। আগুনের লেলিহান শিখার প্রতিপ্রভা তার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠলো।শান্ত স্বরে কিন্তু যথেষ্ট জোড় দিয়ে কম্পাউন্ডারকে নির্দেশ দিলেন এই মুহূর্তে সেই তিনজন বাঙালি ছাত্রকে হাজির করতে।যাকে বলে -“রাইট নাউ!”
প্রিন্সিপালের রুমে মোট তিনজন বাঙালি ছাত্র দাড়ানো। সন্ত্রস্ত হয়ে দুইজন ছাত্র দাড়ানো। দুইজনেরই ভয়ে মাথা নুইয়ে আছে।আর একজনের শিড় যথাযথভাবেই সোজা রয়েছে! বলাই বাহুল্য, সরফরাজ ছাড়া আর কেউ নয় সে।
প্রিন্সিপালের কাছে আব্বাসের দায়ের করা সমস্ত অভিযোগই সরফরাজ অকপটে স্বীকার করলো।
“আমাদের দাবি তো নায্য! এটা তো সময়ের দাবি! আমরা এতদিন মুখ খুলতে সাহস পাইনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের বাঙালিদের সে সাহস দিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বুকে দাড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়ার সাহস তিনিই আমাকে দিয়েছেন, গোটা বাঙালিকে দিয়েছেন। আমি তো উর্দুকে হেয় প্রতিপন্ন করছি না স্যার! শুধু দাবি এটাই যে উর্দুর সমান মর্যাদা বাংলাও পাক! ১-২ লক্ষ মানুষের কথা বলার ভাষা নয় স্যার বাংলা,কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা!!”
প্রিন্সিপাল চোখ সরু করে স্পষ্ট বাংলায় বলতে লাগলো-
“সমান মর্যাদা? বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়া বাঙালি নামক জনগোষ্ঠীর ভাষা। উর্দু হলো প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হওয়ার পথে এরকম একটা ভাষা। আর বিজয়ীকেই গ্রহণ করতে হয়,পরাজয়ীকে নয়। বিপন্ন হোক তোমাদের বাংলা ভাষা- এটাই চাই। উর্দু তে কথা বলে যে শান্তি, বাংলায় কি সেটা পাবে? পেয়ারা পাকিস্তান হামারা পেয়ারা পাকিস্তান!”
সরফরাজ প্রতিবাদের সুরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই হাত তুলে প্রিন্সিপাল থামিয়ে দিলো।
“আজকের পর থেকে কেউ লাহোর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের না ক্যান্টিন না ডর্মেটরি না ল্যাবরুম না ক্লাসরুম- কোথাও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের গুণ কীর্তনের সুযোগ পাবে না, বাংলাকে উর্দুর সমান মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করতে পারবে না। তুমি তো নও ই, তোমার দুইটা বন্ধুও নয়।”
প্রিন্সিপালের মুখের রহস্যময় হাসির অর্থ রুমের তিনজনের কাছেই সহজেই বোধগম্য। টি.সি দেওয়া হবে তাদের। ১০ মিনিটের মধ্যে টি.সির কাগজ তৈরী। শেষ আশা হিসেবে সরফরাজ বাদে বাকি দুইজন প্রিন্সিপালের পা জড়িয়ে ধরলো। অনুনয় করতে লাগলো তাদের ক্ষমার জন্য। প্রিন্সিপাল বললো ক্ষমা করতে পারি, চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে দিতে হবে কলেজে বাংলা ভাষা সম্পর্কিত কোনো কিছুর সাথে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না। দুইজন একসাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
“আমার টি.সি এর পেপারস গুলো তাড়াতাড়ি সাইন করে দিলে খুশি হতাম স্যার। ওপাড় চলে যাবো রাতের ফ্লাইটেই।”
“সবাই অনুনয় করছে, ভিক্ষা চাইছে, তুমি কিছুই করবে না!! ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া অসমাপ্ত রেখে চলে যাবে!!”
“আমরা বাঙালিরা স্যার অদ্ভূত। কেউ প্রচুর পা চাটা, কেউ প্রচুর একরোখা। দ্বিতীয় স্বভাবের আমি স্যার। ক্ষমা করবেন। আমি কোনো অন্যায় করিনি। বিনা অন্যায়ে টি.সি পেলে তার জন্য ক্ষমা আমার নয়, আপনার প্রার্থনা করা উচিত আমার কাছে।”
আশ্চর্যজনকভাবে প্রিন্সিপাল রেগে গেলেন না। শান্তভাবে সব পেপার সাইন করে সরফরাজকে দিয়ে দিলেন এবং সসম্মানে কলেজ থেকে বের করে দিলেন।
এক বছর পূর্ব পাকিস্তানে এসে বেকার অবস্হায় সরফরাজ। বাবা উকিল মানুষ তার। পয়সা অঢেল। তবে ছেলে মানুষ হয়ে কোনো আয় রোজগার না করে বসে থাকা তো আর শোভনীয় নয়। তাই কিছু করা দরকার। বাবাকে বলে একটা দোকান খুললো। স্টেশনারি এবং বইয়ের দোকান। সময় কাটানোর একটা মাধ্যম শুধুমাত্র। ব্যবসা মুখ্য নয়। সারাদিন বাড়িতে বসে উপন্যাস পড়ে, গাছে পানি দিয়ে সময় কাটে না সরফরাজের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাছেই হওয়াতে স্টেশনারিতে খুব একটা খারাপ বেঁচা-কেনা হতো না।
কোনো এক ভর দুপুরে তার সামনে একজন যুবক এসে দাড়ালো। মাথায় পাতলা কালো চুল। সুদর্শন যুবক। কেউ কখনো স্টেশনারিতে এসে নিজের নাম পরিচয় দেয়না। অমুক জিনিসটা আছে কিনা, থাকলে দাম কত এসব প্রশ্ন করেই বিদায় হয়। লোকটা বলল সে রফিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বইয়ের সন্ধান করছিলো সে। সে ধারণা করেছিলো পাকিস্তান সরকারের কড়া নীতির ফলে আর দশটা জায়গার মত এখানেও পাওয়া যাবেনা বইটা। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেটও এখন নিউমার্কেটের অভিজাত দোকানগুলো ছাড়া দুষ্প্রাপ্য। তাও জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু রফিককে অবাক করে দিয়ে সরফরাজ জানালো যে বইটা আছে তার কাছে। সেদিনের মত হালকা আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে শেষ হল তাদের কথোপকথন।
রফিক রোজকার মত তার বন্ধু সরফরাজের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এখন রফিক আর সরফরাজ ভালো বন্ধু। তারা দুইজনই চায় মাতৃভাষা বাংলা হোক।
সরফরাজ আর রফিক চা খাচ্ছিলো। চা খাওয়ার এক পর্যায়ে রফিককে সরফরাজ বলল-
“বন্ধু, পশ্চিম পাকিস্তানে আমার বাবার পুরাতন একটা বাড়ি আছে। বাবা বড় একজন এমএলএ এর কেস সলভ করে বাড়িটা পেয়েছিল উপঢৌকন হিসেবে। কিন্তু বাড়িটা একজন কেয়ার টেকার দেখাশোনা করে শুধুমাত্র। বাবা বললো বাড়িটা কাকে যেনো বিক্রি করবে। একজন এক্স মিলিটারি। তাই সে ব্যপারে তাঁর সাথে আলাপের জন্য আমাকে পশ্চিম পাকিস্তান যেতে হবে। সম্ভবত ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারী যাবো। তাই তুমি কি পারবে ততদিন আমার স্টেশনারির দেখাশোনা করতে?”
“দুঃখিত বন্ধু। আমার যে কোনো সময় মিটিং এ যেতে হয়। কখন কোথায় থাকি ঠিক নাই। তবে চাইলে আমার পরিচিত এক ছোট ভাইকে দোকান দেখাশোনা করতে বলতে পারি যদি না তোমার আপত্তি থাকে! দশম শ্রেণির ছাত্র। ঢাকাতেই মিশনারি স্কুলে পড়ে। আনোয়ার নাম। খুব ভদ্র ছেলে।”
“আপত্তি কেনো থাকবে। বেশ তাই হবে।”
করাচি বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রওনা দেয় সরফরাজ। বিমানের টিকিট উর্দু আর ইংরেজিতে লেখা। অথচ এয়ারওয়েজ কোম্পানির ৬৫% চাকুরিজীবী পূর্ব পাকিস্তানের। ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে আসে তার। ঠিক সে সময় উর্দুতে টেক অফের বার্তা শোনানো হয়। কেনো যেন সে চাচ্ছিলো এরপর বাংলায় বলা হোক একই কথা। কিন্তু না। ইংরেজিতে কিছু নির্দেশিকা দিয়ে ক্যাপ্টেন সবাইকে বিদায় জানালো। রাগে থরথর করে কাপতে থাকলো সরফরাজ। টেক অফের সময় বিমানের কম্পনে সেই কাঁপুনি পাশের যাত্রী টের পেল না…
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেলের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা দল মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের বন্দুকের নল তাক করা মিছিলের দিকে। তা সত্ত্বেও মিছিল ছত্রভঙ্গ হল না! পুলিশ এবার গুলি চালালো।
মিছিলের অগ্রভাগে থাকা রফিকের মাথার খুলি ভেদ করলো এলোপাতারিভাবে ছোড়া গুলির একটা গুলি। মগজ বের হয়ে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। রফিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্ব পাশে রফিকের লাশ অনেক্ষণ পড়ে থাকে। ৬-৭ জন মিলে এসে ধরাধরি করে তাঁর লাশ এনাটমি হলের পিছনের বারান্দায় এনে রাখলো। ডা. মাশারফুর রহমান তাঁর ছিটকে যাওয়া মগজটা তুলে নিয়ে লাশের পাশের রাখলেন।
ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন-
“এটাই প্রথম লাশ। এই প্রথম গুলিবিদ্ধ হয় মিছিলের সময়। এর রক্তই সর্বপ্রথম রাজপথে রক্তবন্যা সৃষ্টি করে। হ্যা, এই প্রথম শহীদ”।
সবার মনেই কয়েকটা শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে- “প্রথম গুলি, প্রথম রক্ত, প্রথম শহীদ” ।
সরফরাজ দেশে ফিরেছে খুব ভোরে। সকাল ৯ টা বাজতেই নিজের স্টেশনারির দোকানে চলে যায় সে। আনোয়ার নামের সেই ছেলেটিকে নীরস মুখে বসে থাকতে দেখে মনের মধ্যে অশুভ সংকেতের দামামা বেজে উঠে। ২১ ফেব্রুয়ারীর ছাত্র অসোন্তষের কথা শুনেছে সে। রফিক বলেছিলো তাকে যে সকল প্রকার মিটিং-মিছিলে তার সরব উপস্হিতি নিশ্চিত করবে সে। বাংলার ভাষার জন্য প্রাণটা দিতেও প্রত্যয়ী ছিল সে। তার ভাবনায় ছেদ দিলো আনোয়ার।
“ভাই, রফিক ভাই আর নেই।”
কথাটা শুনে আশ্চর্যজনকভাবে একটুও অবাক হলো না সরফরাজ। শুধু স্হির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে থাকলো। মুষ্ঠি দুটো পাকিয়ে তুললো। চোয়াল প্রচন্ড রকমের শক্ত করলো। এরপর মুখে শুকনা হাসি নিয়ে বললো-
“রফিক আছে। বেঁচে আছে। ও মরে নাই। দেহ নাই বলে কি জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকানদের মধ্যে নেই? নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকানদের মাঝে নেই?”
আরও পড়ুনঃ সত্যেন্দ্রনাথ বসু -গল্পে গল্পে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবন কল্প
গেরিলা বাহিনীর চৌকস যোদ্ধা, টিম লিডার মোঃ সরফরাজ নজরুল ইসলামের বুকে গুলি লেগেছে। সহযোদ্ধার দিকে ধেয়ে আসা গুলি বুক পেতে নিয়েছে সে। গুলি একটা দুইটা নয়, চারটা। চারটা গুলি বুকে খেয়েও তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়া অবাক করার মতই বিষয়। ৪৫ সেকেন্ড সময় পায় মৃত্যুর আগে সরফরাজ। আনোয়ারের হাতের মুঠোয় নিজের বুকের তাজা রক্তভেজা হাত গুজে দিয়ে অনুনয়ের সুরে বলতে লাগলো-
“রফিকরা যেটা শুরু করেছে, আমরা যেটা চালিয়ে রেখেছি এতদিন, তোরা সেটা শেষ কর ভাই। রফিকরা তবেই শান্তিতে ঘুমাবে…”
বিকেল ৪ টা বেজে ৯ মিনিট। আনোয়ারের হাতে পতাকা। স্বাধীন বাংলার পতাকা।পতাকা নিয়ে আবাদি জমির আইল ধরে দৌড়াচ্ছে। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে। সে জানেনা কিসের পানি এটা। হতে পারে রফিক ভাইকে ভাষা আন্দোলনে ও সরফরাজ ভাইকে মুক্তিযুদ্ধে হারানোর বেদনায়, অথবা হতে পারে স্বাধীন দেশ পাওয়ার চরম আনন্দে। সে সত্যিই জানেনা কিসের পানি এটা। লাল বৃত্তের মাঝে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতীকী মানচিত্রের দিকে তাকালেই ওর মনে পড়ে যায় সাদা কাফনে মোড়া রফিক ভাইয়ের লাশ যাকে রাত তিনটায় সশস্ত্র পাহাড়ায় আজিমপুর কবরস্হানে দাফন করা হয়। আবারো মনে পড়ে যায় মুঠো জড়ো করে বাচ্চাদের মত করে আকুতি করা সেই সরফরাজ ভাইয়ের কথা। সে ভুলবে না। সে জানে, জাতিও ভুলবেনা। এসবকেই তাহলে ইতিহাস বলে?
হঠাৎ আনোয়ার এর মনে হয় আচ্ছা, এই যে পতাকাটায় লাল বৃত্তাকার অংশ, কার রক্ত এতে প্রথম লেগেছে?
কোনো মুক্তিযোদ্ধার না কোনো ভাষা শহীদের?
ভাষাশহীদরাই তো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস, সাহসিকতা প্রদর্শনের সূতিকাগার। কোনো ভাষা শহীদের রক্তই স্বাধীন বাংলার পতাকাকে প্রথম রঞ্জিত করেছে তাহলে।
সে জানে প্রথম ভাষা শহীদ তার প্রাণপ্রিয় রফিক ভাই। তবে কি পতাকার গর্বিত এই অংশের প্রথম অংকন টা রফিক ভাইয়েরই রক্তে?
ছবি:সংগৃহীত
গল্পটির মূল চরিত্র বায়ান্নার ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক। এছাড়া অন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র সরফরারজ এবং আনোয়ার। তিনজন গল্পে তিন প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করলেও তাঁদের অনুভব একটি বিন্দুতে এসে মিশে। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা ভাষাশহীদ রফিক চরিত্রটির সাথে কাল্পনিক সরফরাজ চরিত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব গড়ে উঠে এবং রফিকের আত্মত্যাগের ফলে অনুপ্রাণিত হয়ে সরফরাজ নামের কাল্পনিক চরিত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরের মত মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। সেই সাথে আরেকটি কাল্পনিক চরিত্র আনোয়ার যে স্বচক্ষে দেশ স্বাধীন হওয়া দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে বায়ান্নতে রফিকদের ত্যাগ, একাত্তরের সরফরাজদের ত্যাগের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে এবং সেই ত্যাগের চিত্রায়ণ জাতীয় পতাকায় প্রস্ফুটিত রয়েছে।
চমৎকার গল্প! কিন্তু ভিউ এতো কম!
অনেক ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। ♥