মার্কিন প্রবাসী ফিলিস্তিনী অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদের লেখা ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “ওরিয়েন্টালিজম” গ্রন্থটি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এই বইটিতে সাইদ পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের স্বরুপ উন্মোচন করেছেন। একই সাথে তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বে আসলে প্রাচ্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটি পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্রাজ্যবাদেরই একটি অংশ।
লেখক পরিচিতি
এডওয়ার্ড সাইদ (আরবি: إدوارد وديع سعيد, Idwārd Wadīʿ Saʿīd; ২ নভেম্বর ১৯৩৫ – ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৩) ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি আমেরিকান তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি উত্তর উপনিবেশবাদ ধারণার সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। সাইদ ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত প্যালেস্টাইনে জন্মগ্রহণ করেন।
সাইদের বাবা ওয়াদি সাইদ প্রথম মহাযুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেন এবং বিনিময়ে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। সাইদ জেরুজালেম ও কায়রোতে তার শৈশব অতিবাহিত করেন। কায়রোতে তিনি অভিজাত ব্রিটিশ বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদারিত্বের কারণে সাইদ ও তাঁর পরিবার কায়রোতে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে থাকেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট হন।
১৯৬৩ সালে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে তিনি সেখানে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হন। ২০০৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মাঝে আছে ওরিয়েন্টালিজম, কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম, কাভারিং ইসলাম।
সারসংক্ষেপ:
ওরিয়েন্টালিজম বইটি মুলত তিনভাগে বিভক্ত। ওরিয়েন্টালিজম এর বাংলা অনুবাদ হল প্রাচ্যবাদ। সাইদের মতে, প্রাচ্যবাদ হল প্রাচ্যের প্রতি পশ্চিমের সদাই সমালোচনামূলক এক দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রকাশ পায় পাশ্চাত্যের বিভিন্ন একাডেমিক ভাষ্য হতে শুরু করে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, এমনকি বিজ্ঞাপন চিত্র এবং ভ্রমণকাহিনীতেও। প্রাচ্য বলতে সাইদ মূলত বুঝিয়েছেন এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে।
বইটির “সূচনা” অধ্যায়ে সাইদ দেখিয়েছেন যে পশ্চিমের চিন্তাচেতনায় “প্রাচ্য” সবসময় নেতিবাচক এবং অসম্পুর্নরুপে উপস্থিত। পাশ্চাত্যের আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ একাডেমিক কাজগুলোর মাঝেও প্রাচ্যকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আসলে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণাই শুধু করে না, বরং এই মতবাদকে তুলে ধরে যে যেহেতু পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে প্রাচ্যের চাইতে সেরা, তাই প্রাচ্যকে শাসন করার অধিকার পাশ্চাত্যের আছে।
এভাবে প্রাচ্যের জনগণকে মানসিক দাসত্বে আবদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাচ্যের জাতিগুলোর ওপর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়। যেমন, হলিউডের ছবিতে সব আরবই সন্ত্রাসী আর জাপানীরা সবাই ক্যারাটে এক্সপার্ট।
সাইদ দেখান যে শেক্সপীয়র হতে শুরু করে কার্ল মার্ক্স পর্যন্ত সব পশ্চিমা সাহিত্যিক এবং চিন্তাবিদই প্রাচ্যকে উপস্থাপন করেছেন অনগ্রসর চিন্তাধারার অধিকারী এক জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল হিসেবে, যে জনগোষ্ঠীকে পাশ্চাত্যের তথাকথিত সভ্য শাসনের মাধ্যমে “আলোকিত” করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আসলে প্রাচ্যের জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্দয় শাসন তারা চাপিয়ে দেয়, সেটাকেই ন্যায্য হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাইদ দেখান যে উনিশ শতকের পূর্বে যেখানে প্রাচ্যকে দেখা হত ভয়ংকর এক অজানা জগত হিসেবে, উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিংশ শতকে এসে পশ্চিমের চোখে প্রাচ্য হয়ে গেল এক রোমান্টিক আদিম জগত। কিন্ত এখানেও সেই একই বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি চলল। “প্রাচ্য” যেন এক স্বপ্নপুরী। সেখানে কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়।
সেখানকার শাসকেরা অত্যাচারী, জনগন তাদের হাতে নিপীড়িত। তাই দিনশেষে পাশ্চাত্য অগ্রসর এবং মানবিক, আর তাই পাশ্চাত্যের আধিপত্য প্রাচ্যকে মুক্তি দেবে। সাইদ বিখ্যাত সব প্রাচ্যবিদ পন্ডিতদের লেখা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে প্রাচ্যকে এক চির “অনুন্নত” জনপদ হিসেবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আসলে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরা পাশ্চাত্যকে দেখান এমন এক স্বত্বা হিসেবে যে প্রাচ্যকে স্বাভাবিকভাবেই শাসন করতে পারে। যেন পশ্চিম চির গতিশীল, উন্নত; প্রাচ্য সেখানে জড়তার প্রতীক।
তৃতীয় অধ্যায়ে সাইদ দেখান যে বিংশ শতাব্দীতে এসে “প্রাচ্যবাদ” তার কেন্দ্র পরিবর্তন করেছে। পূর্বে সেটা ইউরোপ হলেও বর্তমানে এই কেন্দ্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জ্ঞানভাষ্যে শুধু নয়, এমনকি মার্কিন বিনোদন জগতেও প্রাচ্যবাদের প্রভাব পড়ছে। সাইদ এই বিষয়টি স্পষ্ট করেন যে প্রাচ্যবাদ মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং জ্ঞানের জগতে পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি কৌশলমাত্র। যখন ইউরোপ সাম্রাজ্যবাদী ছিল, তখন প্রাচ্যবাদ ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের হাতিয়ার। এখন সেই স্থান দখল করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাইদ জ্ঞানের জগতে এমন সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের তীব্র নিন্দা করেন।
বিশ্ব সাহিত্য এবং সমকালীন চিন্তাধারায় ওরিয়েণ্টালিজম বইটির প্রভাব
বিশ্বসাহিত্যে ওরিয়েন্টালিজম এর অবস্থান অনেক উঁচুতে। মূলত আলজেরীয় চিন্তাবিদ ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর হাত ধরে বিশ্বসাহিত্যে উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তা চেতনার শুরু হলেও এডওয়ার্ড সাইদ এই ধারাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ওরিয়েন্টালিজম রচনা করেন।
পাশ্চাত্যের আপাত নিরীহ যে কোন টেক্সটও যে আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের হাতিয়ার সেটা তাঁর আগে কেউ এভাবে দেখাতে পারেননি। মূলত পশ্চিমা শক্তিগুলো কোন দেশ দখল করে নিজেদের বানানো শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিত সেসব দেশের ওপর।
আরও পড়ুনঃ
থিংস ফল অ্যাপার্ট: আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস
সাহিত্যে উত্তর-উপনিবেশীকতা: সাহিত্যের নতুন ধারার আন্দোলন
পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের সাহিত্য ও দর্শন পড়ানো হয়, সেগুলোর মূল কথা থাকে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্ব। এতে প্রাচ্যের জাতিগুলোর মাঝে একদিকে হীনমম্ম্যতা তৈরী হয়, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনগুলোকেও নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকে। সাইদ জ্ঞান এবং সাম্রাজ্যবাদের এই মেলবন্ধনের সমালোচনা করেন।
পশ্চিমা চিন্তাধারাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়ার যে প্রবনতা ঔপনিবেশিক বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের কারণে সৃষ্টি, সাইদ সেই প্রবনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সাইদের পরে উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান হোমি ভাবা, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, বিল অ্যাাশক্রফট প্রমুখ পন্ডিতবর্গ। কিন্ত তাঁদের সবার চিন্তাধারার মাঝেই সাইদের স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। তাই বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী তাত্ত্বিক হিসেবে কার্ল মার্ক্স এবং মিশেল ফুকোর পাশাপাশি এডওয়ার্ড সাইদের নামও উচ্চারিত হয়।
তথ্যসুত্রঃ
১। ওরিয়েন্টালিজম, এডওয়ার্ড সাইদ। সম্পাদনা: ফয়েজ আলম।
২। The Post Colonial Studies Reader. Editor: Ashcroft, Griffith and Tiffin.