বিংশ শতকে অন্যতম গুরুত্বপুর্ন সাহিত্য আন্দোলন হল উত্তর-উপনিবেশীক সাহিত্য আন্দোলন। মূলত সাবেক ইউরোপীয় উপনিবেশীক শক্তিগুলোর অধীনস্থ দেশগুলোতে এই আন্দোলনের সুত্রপাত। বিংশ শতকে এসব ইউরোপীয় শক্তির অধীন দেশগুলো একের পর এক স্বাধীন হয়ে যায়। সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার ঢেউ লাগে সর্বত্র। রাজনৈতিকভাবে যেমন এসব দেশে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে, তেমনি শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রেও লাগে নতুন আন্দোলনের ছোঁয়া। এসব আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম হল “উত্তর-উপনিবেশীকতা”।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় জাতিগুলো যখন থেকে সারা পৃথিবীতে ভৌগলিক অভিযানের সুত্র ধরে দেশে দেশে উপনিবেশ স্থাপন করা শুরু করে। উপনিবেশের অধিবাসীরা কেবল যে রাজনৈতিকভাবে শাসিত হতে থাকে তাই নয়, তাদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জীবনেও পরিবর্তন আসে।
উপনিবেশিক শক্তিগুলো কেবল যে অধীনস্ত দেশগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল তাই নয়, বরং নিজেদের সুবিধার্থে তারা উপনিবেশিত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সামাজিক জীবন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তাই উপনিবেশিত দেশের সংস্কৃতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে উপনিবেশবাদী দেশগুলো আসলে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল। এর মাধ্যমে আসলে তারা উপনিবেশিত দেশের সংস্কৃতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সেসব দেশে এমন একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরী করা যারা নিজেদের সাংস্কৃতিক মূল হতে বিচ্যুত হবে।
উত্তর উপনিবেশীক চিন্তাধারা এই বিষয়টাকেই চ্যালেঞ্জ করে। সোজা ভাষায়, উত্তর-উপনিবেশীকতা হল উপনিবেশবাদের প্রতি প্রবল সমালোচনামূলক এক দৃষ্টিভঙ্গী। উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক ও লেখকরা উপনিবেশের আধিপত্যে বিশ্বাস করে না। উপনিবেশবাদীরা যেখানে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সব কিছুকে বর্বর বলে খারিজ করে দেয়, উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখকরা সেখানে প্রাকঔপনিবেশিক যুগের সংস্কৃতির মাঝে গর্বের উপাদানগুলো অনুসন্ধান করে, ঔপনিবেশিক আমলের নৃশংসতার স্বরূপ উন্মোচন করে।
উত্তর-উপনিবেশীক তাত্ত্বিকরা প্রাক্তন উপনিবেশের সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণকে শেখায় উপনিবেশীক আমলের সবকিছু নির্বিবাদে মেনে না নিতে। উত্তর- উপনিবেশী সাহিত্যিকরা প্রায়ই ইউরোপীয় লেখকদের উপস্থাপিত দৃষ্টিভঙ্গীর পাল্টা দৃস্টিভঙ্গী তুলে ধরে , যাকে বলা হয় কাউন্টার ডিসকোর্স।
বিশ্ব সাহিত্যে উত্তর উপনিবেশীকতার তাত্ত্বিক সুত্রপাত আমেরিকা প্রবাসী ফিলিস্তিনী পন্ডিত এডওয়ার্ড সাইদের হাত ধরে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে তিনি প্রথম দেখান পশ্চিমা বিজয়ী শক্তিগুলো কিভাবে প্রাচ্যকে জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি সীমাবদ্ধ স্বত্বা হিসেবে তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে উপনিবেশীত জনগনের মনোজগতে তারা আধিপত্য বিস্তার করেন। একই সাথে প্রাচ্যের দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারটা দেখা হয় পশ্চিমের তথাকথিত সভ্যতা বিস্তারের মিশন হিসেবে। সাইদ তাঁর এই গ্রন্থে সমালোচনা করেন বালজাক, টেনিসন থেকে শুরু করে শেক্সপীয়র পর্যন্ত সকল খ্যাতনামা পশ্চিমা লেখকের সমালোচনা করেন।
আরেকজন বিখ্যাত উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান অধ্যাপক হোমি কে ভাবা। তাঁর লেখনীতে তিনি হাইব্রিডিটি, মিমিক্রির মত ধারনাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর ফ্রাঞ্জ ফানোন, নোয়াম চমস্কির মত পন্ডিতেরা এসব নিয়ে লেখালেখি করেন।
তবে সৃজনশীল সাহিত্যে প্রথম উত্তর উপনিবেশীক সাহিত্যকর্মের সুত্রপাত করেন নাইজেরীয় ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচেবে। আচেবে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর থিংস ফল অ্যাাপার্ট গ্রন্থে প্রাক ঔপনিবেশীক যুগের আফ্রিকার ঐতিহ্য তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে কিভাবে একটি সমৃদ্ধ আফ্রিকান জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে ইউরোপীয়দের আগ্রাসনের কারণে। আচেবে এই উপন্যাসে ইংরেজ লেখক উইলিয়াম কনরাডের লেখা হার্ট অফ ডার্কনেস উপন্যসের কাউন্টার ডিসকোর্স দাঁড় করান।
বর্তমান বিশ্বের অনান্য বিখ্যাত উত্তর উপনিবেশী লেখকের মধ্যে আছেন কেনিয়ার নগুগী ওয়া থিংগো, সুদানের তায়্যেব সালেহ, ভারতের অমিতাভ ঘোষ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেরেক ওয়ালকট প্রমুখ।
উত্তর উপনিবেশী লেখকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য হল উপনিবেশবাদীদের ভাষাকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। যেমন, আচেবে থিংস ফল অ্যাাপার্ট লেখেন ইংরেজীতে। কিন্ত এই ইংরেজী ব্রিটিশ বা আমেরিকান ফরমাল ইংরেজী না। এই ইংরেজী আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যে ভরা। এভাবে উপনিবেশের ভাষাকেও কিছুটা অ্যাাডাপটেশন বা পরিবর্তন করে নেয়া যার মাধ্যমে এর ওপর আসলে উপনিবেশবাদের শিকার জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে উপনিবেশবাদের ভাষার ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাংলা সাহিত্যে সেই অর্থে উত্তর-উপনিবেশীকতা এর চর্চা কম হয়েছে। একাডেমিকভাবেও বাংলা সাহিত্য জগতে উত্তর-উপনিবেশীকতা র আলোচনা একেবারেই সাম্প্রতিক। তবে কাজী নজরুল ইসলাম, শরতচন্দ্র প্রমুখের লেখায় উত্তর উপনিবেশিক চিন্তার ছাপ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা খোয়াবনামা উপন্যাসে উত্তর উপনিবেশবাদের ছোঁয়া আছে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়া, একাডেমিক ও তাত্ত্বিক লেখালেখির ক্ষেত্রে গৌতম ভদ্র, রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত লেখকদের চিন্তা গুরুত্বপূর্ন।
সাম্প্রতিককালে তাহমিমা আনামের গুড মুসলিম, এ গোল্ডেন এজ বা মনিকা আলীর ব্রিকলেন এর মত উপন্যাস একদিকে যেমন বাঙ্গালী জাতির সংগ্রামের ইতিহাস বিবৃত করে, তেমনি উপনিবেশবাদ আর আধুনিকতার অভিঘাতে কিভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে সেটাও দেখানো হয়েছে।
সব শেষে বলা চলে যে উত্তর-উপনিবেশী সাহিত্যের মাধ্যমে উপনিবেশিত দেশগুলোর মানুষ নিজেদের সাবেক দখলদার জাতিগুলোর সাহিত্যক্ষেত্রে আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। তাই, উত্তর-উপনিবেশী সাহিত্য হল সাহিত্যের জগতে নিপীড়িতের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ
১। উত্তর-উপনিবেশী মন, ফয়েজ আলম
২। Post Colonial Studies Reader, Bill Ashcroft
মন্তব্য লিখুন