খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দেহের পুষ্টি সাধিত হয় ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই সুস্থ জীবনের জন্য মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে মানুষের সঠিক খাদ্যাভাস এর অভাবে অচিরেই মানবসভ্যতা ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’- এ সম্প্রতি গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।
সুস্থ থাকার জন্য সঠিক খাদ্যাভাস খুবই জরুরী। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি লোক প্রয়োজনীয় খাবার পায় না এবং ২০০ কোটি লোক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাবার খায় বলে গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। সেসবের বেশির ভাগ অস্বাস্থ্যকর খাবার বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষকেরা দাবি করেছেন, সঠিক খাদ্যাভাস এর অভাবে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক কোটি দশ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কয়েক ধরনের ক্যান্সারে উন্নত দেশের মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এর মাধ্যমে সেই হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
গবেষণা নিবন্ধের অন্যতম সহলেখক ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম ল্যাং বলেন, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে এক হাজার কোটি, যা কিনা বাড়তেই থাকবে। এখনই সবার খাদ্যাভ্যাস না বদলালে এত বিপুলসংখ্যক লোককে স্বাস্থ্যসম্মত ও টেকসই খাবারের জোগান দেওয়া তখন অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই খাদ্যাভ্যাসের দিক দিয়ে দুনিয়াজুড়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
স্বাস্থ্যকর ও সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তোলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সম্পর্কে।
১. ফল ও সবজি খাওয়া অনেকের কাছেই ভীতিকর একটি বিষয়। এই সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়টি নিয়ে ভয় কে জয় করতে হবে। বিষয়টিকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে হবে এবং নিজের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হবে।ফল ও সবজি না গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় অনেক ভিটামিন ও মিনারেল এর ঘাটতি থেকে যাবে।
২. ফাস্টফুড খেতে কে না ভালোবাসেন? কিন্তু, ফাস্টফুড শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট জমা করে। বার্গার কিংবা বাটার পাস্তা না খেয়ে সেই টাকা খরচ করে ফ্রুট সালাদ কিংবা ক্যাশিওনাট খেতে পারেন।
৩. মিস্টি খাবার ডায়াবেটিস সৃষ্টি করতে পারে। তাই বলে মিস্টি খাওয়া বন্ধ করে দিবেন? না। চিনি থেকে দূরে থাকবেন। ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন মাঝে মধ্যে তবে বেশি কখনোই না। নাহলে অতিরিক্ত ডার্ক চকোলেট মেদ সৃষ্টিতে অপকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
মেরুদণ্ডের যত্ন নিনঃ মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারন ও প্রতিকার
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদ হতে পারে শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ!
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা কি কেন লক্ষণ ও প্রতিকার
৪. কর্মজীবীরা দেখা যায় বাইরের ক্যাফেটেরিয়া কিংবা ক্যান্টিন হতে অস্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সম্পন্ন করেন।এটা একদম ই ঠিক না। শর্করা, আমিষ, স্নেহ জাতীয় খাবার সব কিছুর সঠিক কম্বিনেশনে বাসা থেকে তৈরী কোনো খাবার আনতে পারেন। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমার সাথে অর্থনৈতিক ভাবেও বেশ লাভবান হতে পারবেন।
৫. শাক সবজি না খেলে শরীরে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।শাক সবজি খেলে শরীরে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ লবণের সরবরাহ হয়।
আপনি আপনার পছন্দমত মশলা দিয়ে অল্প অল্প করে সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। এছাড়া পাতাকপি,আলু এসব সিদ্ধ করে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। বিভিন্ন ধরণের শাক স্যুপের সাথে মিক্স করে খেতে পারেন। এভাবে শাক সবজি অল্প অল্প করে হলেও খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৬. জার্নাল মেইনটেইন করতে পারেন। নিজে রুটিন করে সঠিক পুষ্টিমানের খাবার গ্রহণ করুন। এক্ষেত্রে নিউট্রিশনিস্ট এর দরকার হবেনা। ইন্টারনেটের সাহায্যই গ্রহণ করতে পারেন আপনি।
৭. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা কিছু রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত খাদ্য ও রোগের ঝুঁকি সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে সুস্থ থাকা সম্ভব।’
বিএসএমএমইউ’র মেডিসিন বিভাগের এই অধ্যাপকের ভাষ্য, ‘শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, সুস্থ থাকার জন্য এর সঙ্গে আরও কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার। ধূমপান না করে, পান-জর্দা ও রাস্তার পাশের খোলা খাবার না খেয়ে, বিশুদ্ধ পানি পান করে, ঘরের খাবার বাসি হওয়ার আগেই খেয়ে আমরা সুস্থ থাকতে পারি।’
প্রাচীন যুগের কবি কালিদাস বলেছেন ‘আশ্বাস: পিশাচো হপি ভোজনেন’। অর্থাৎ পিশাচকেও ভোজন দ্বারা বাগে আনা যায়। কথাটা হাস্যরসাত্মক হলেও বাস্তব সত্যের খুব কাছাকাছি। পরবর্তীকালেও বহু কবি এবং লেখক সুযোগ পেলেই সু-খাদ্যের ব্যাখ্যায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন। গৃহিণী যদি সু-রাঁধুনী হন তাহলে কর্তার মান ভাঙাতে বেশি অনুনয় করতে হয় না।
প্রাচীনকালে রন্ধন শৈলীকে চৌষট্টি কলার অন্যতম কলা বলে গণ্য করা হতো। বস্তুত রন্ধন শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সুকুমার কলা বলে গণ্য করা হতো। আদিম মানুষ সব খাদ্য কাঁচা খেতে অভ্যস্ত ছিল। আমিষ নিরামিষ সবই কাঁচা খেত। যেই আগুন আবিষ্কৃত হল অমনি কাঁচা ছেড়ে ঝলসে খেতে শুরু করল। ক্রমশ মানুষের রুচি বদলাতে লাগল। কাঁচা খাওয়ার বদলে রেঁধে খাওয়ার রীতি শুরু হল এবং সেদিন থেকে রান্নার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হল এবং সব আবিষ্কারের মতো রান্নার নতুন নতুন পদ আবিষ্কার হতে থাকল। রন্ধনশিল্পীরা ক্রমশ খাদ্যের নানা রকম পদ সৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
বৈদিক সংস্কৃতে ভোজন শব্দের দুটি অর্থ ছিল। সে সময় ভোজন অর্থে সুখানুভূতি এবং খাদ্য দুটোই বোঝানো হতো। ভোজনে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও যে একটা তৃপ্তি বা আনন্দের অনুভূতি আছে সেটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সে জন্যই বোধকরি সর্বস্তরের মানুষ কমবেশি সুখাদ্যের অনুরাগী।
অনেকে আছেন যারা হয়তো ভোজনবিলাসী নন কিন্তু ভোজন রসিক, পরিমাণে খান অল্প কিন্তু যেটুকু খান সেটা হতে হয় স্বাদু ও পরিতৃপ্তিদায়ক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীর মেয়ে বাসন্তীকে লিখেছেন- ‘আমাকে পেটুক বলে যদি কল্পনা কর তাহলে ভুল করবে। আমি যতটা খাই তার চেয়ে গুণ গাই বেশি।’ কবি নিজে নতুন নতুন রান্না আবিষ্কার করতেন। তিনি রান্নায় ব্যস্ত পত্নীর পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন রান্নার ফরমাস করতেন, নানারকমভাবে রান্না করার নতুন পদ্ধতি শেখাতেন স্ত্রীকে। তবে একথা মানতেই হয় যে ভোজনবীরের সংখ্যাও আমাদের সমাজে নেহায়েত কম নয়।
কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘মধ্যযুগের বাঙ্গালা’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘নবাবী আমলে বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী জমিদার রাজস্ব বাকির দায়ে বন্দিভূত হইয়া গোটা একটা খাসি রাঁধিয়া একাকী নিঃশেষ করায় বাকি খাজনা হইতে রেহাই পাইয়াছিলেন।’ রাজা রামমোহন রায়ও নাকি একা একটি আস্ত পাঁঠা খেতে পারতেন। রাজা রামমোহন রায়ের মতো বিস্ময়কর উদাহরণ ইউরোপেও আছে। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোও নাকি এক বসায় একটি ষাঁড়ের অর্ধেক ভোজন করতে পারতেন।
বাঙালির মাছ ও মাংস খাওয়া সম্পর্কে নীহাররঞ্জন লিখেছেন- ‘বারিবহুল, নদনদী-খালবিল বহুল, প্রশান্ত-সভ্যতাপ্রভাবিত এবং আদি-অস্ট্রেলীয়মূল বাঙলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। চীন, জাপান, ব্রহ্মদেশ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের আহার্য তালিকার দিকে তাকাইলেই বুঝা যায়, বাংলাদেশ এই হিসাবে কোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সর্বত্রই এই তালিকায় ভাত ও মাছই প্রধান খাদ্যবস্তু। বাংলাদেশের এই মৎস্যপ্রীতি আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনোদিনই প্রীতির চক্ষে দেখিত না, আজও দেখে না। অবজ্ঞার দৃষ্টিটাই বরং সুস্পষ্ট। মাংসের প্রতিও বাঙালীর বিরাগ কোনোদিনই ছিল না।
যাই হোক, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি। সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন। শুধু নিজের রুচি ও পছন্দের খাবার না গ্রহণ করে সুস্বাস্থ্য গঠন করবে এমন খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন। নেশা দ্রব্য হতে দূরে থাকুন। তাহলেই দীর্ঘজীবী এবং সুন্দর একটি জীবনের অধিকারী হতে পারবেন।
ছবিঃ সংগৃহীত
সূত্রঃ ais.gov.bd, Wikipedia, বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক যুগান্তর
মন্তব্য লিখুন