পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থান হিসেবে পরিচিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ । স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রের এতো গভীরে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক অবস্থা পরিলক্ষিত হবে। এখানে রয়েছে অস্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান, তরল সালফারের বুদবুদ এবং আগ্নেয়গিরি। মারিয়ানা ট্রেঞ্চে কোন প্রাণের অস্তিত্বকে বাঁচতে হয় সমুদ্র পৃষ্ঠের চাইতে পানির প্রায় হাজারগুণ বেশি চাপে। তবে শত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও এই গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চে রয়েছে বিচিত্র প্রাণের অস্তিত্ব।
প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে এবং মারিয়ানা আইল্যান্ড থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ যা পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থান। অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর বিন্দু এখানে অবস্থিত। ক্রিসেন্ট আকৃতির এই ট্রেঞ্চের দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৬৯ কিলোমিটার।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের পৃষ্ঠে অবস্থিত একটি গভীর বিন্দু ‘চ্যালেঞ্জার ডীপ’ নামে পরিচিত। জানামতে এর গভীরতা ১০,৯৮৪ মিটার। ছোট একটি গর্তের মত দেখতে এই উপত্যকাটি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। দ্বিতীয় গভীর বিন্দুটি ‘সিরেনা ডীপ’ নামে পরিচিত যা চ্যালেঞ্জার ডীপ থেকে ১২৪ মাইল পূর্বে অবস্থিত। এর গভীরতা ১০,৮০৯ মিটার পরিমাপ করা হয়েছে।
প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কোন আদর্শ স্থান নয়। এখানে বেঁচে থাকতে হলে সম্পূর্ণ অন্ধকার পরিবেশ, অস্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান, পানির প্রচন্ড চাপ, খাদ্য ঘাটতি ইত্যাদি নানান সমস্যা মোকাবেলা করে বাঁচতে হয়। এসব প্রতিকূলতার মাঝেও মারিয়ানা ট্রেঞ্চে রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। প্রধান তিনটি জীব হলঃ
এককোষী প্রাণী হল xenophyophores. এরা সাধারণত বৃহদাকার অ্যামিবার মত যার আকার ১০ সেন্টিমিটারেরও বেশি। Amphipodes দেখতে অনেকটা চিংড়ির মত যাদেরকে সাধারণত ট্রেঞ্চের গভীর বিন্দুগুলোর এলাকায় দেখা যায়। Holothurians সম্পর্কে এখনও পরিপূর্ণ ভাবে জানা যায়নি। ধারণা করা হয় এরা একশ্রেণির সামুদ্রিক শশা। আরেকটি অস্বাভাবিক প্রাণ রয়েছে যাদেরকে Snailfish বলা হয়।
আরও পড়ুনঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল -পৃথিবীতে ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে নাকি পুরোটাই মিথ
২০১৪ সালে মারিয়ানার এই স্নেইলফিশ আবিষ্কৃত হয় প্রায় ৮,০০০ মিটার (২৬,২০০ ফিট) গভীরে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, স্নেইলফিশের ছোট গোলাপী রঙের শরীর দেখলে মনেই হয়না এরা এধরনের প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। অথচ এরাই অনেকটা দখল করে রেখেছে এই ট্রেঞ্চের বাস্তুসংস্থানকে। এখানকার অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বেশি গভীরে যেতে পারে স্নেইলফিশ। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা চ্যালেঞ্জার ডীপ থেকে সংগৃহীত কাদায় পেয়েছেন প্রায় ২০০ প্রজাতির ক্ষুদ্র জীব।
সিরেনা ডীপেও পাওয়া গিয়েছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রাণ। এসব ক্ষুদ্র প্রাণ হাইড্রোজেন এবং মিথেন থেকে জীবন ধারণ করে যা তৈরি হয় সমুদ্রের পানি এবং পাথরের সংঘর্ষ থেকে।
সমুদ্রেই এতো গভীরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান বিস্মিত করে বিজ্ঞানীদের। কিন্তু মারিয়ানা ট্রেঞ্চে রয়েছে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়গিরি। উল্লেখযোগ্য একটি আগ্নেয়গিরি হল Eifuku Submarine আগ্নেয়গিরি। চিমনির মত দেখতে বিভিন্ন হাইড্রোথার্মাল উৎস থেকে তরল কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করে এই আগ্নেয়গিরি । এই নির্গত তরলের তাপমাত্রা ২১৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরেকটি আগ্নেয়গিরি Daikoku Submarine নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার অনুযায়ী এখানে রয়েছে সালফারের আধার যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪১০ মিটার নিচে অবস্থিত।
গভীর সমুদ্র রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থের সংরক্ষণের স্থান হিসেবে কাজ করে থাকে। কিছুদিন আগে Newcastle University এর একটি রিসার্চ টিমের তথ্যমতে, মানুষের তৈরি কিছু রাসায়নিক পদার্থ যা ১৯৭০ এ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তা এখনও সমুদ্রের গভীরে আছে। তীব্র মাত্রায় Persistent Organic Pollutants (POP) আবিস্কৃত হয়েছে সমুদ্রের গভীরের প্রাণীদেহের কোষে। Nature Ecology and Environment জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, Poly chlorinated biphenyl (PCB) এবং poly brominated diphenyl ether (PCDE) যা সাধারণত ইলেকট্রিক্যাল ইনসুলেটরে ব্যবহৃত হয়, তা পাওয়া গিয়েছে সমুদ্রের গভীরে।
যেহেতু এসব রাসায়নিক প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারেনা, সেহেতু এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অবস্থা দ্বারা চালিত হয়ে একসময়ে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়৷ একসময় গিয়ে সমুদ্রের একবারে গভীরে গিয়ে জমা হয়। এসকল রাসায়নিক পদার্থ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের প্রাণীদের উপর বিস্তর প্রভাব বিস্তার করে। ২০১৯ সালে Scientific American একটি রিপোর্টে উল্লেখ করে, নিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম থেকে নির্গত কার্বন-১৪ পাওয়া গিয়েছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের প্রাণীর দেহকোষে।
আমাদের পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় পরিবেশ এবং প্রাণী। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সেরকমই একটি বৈচিত্র্যময় স্থান। সমুদ্রের অত্যন্ত গভীরে মানুষের পৌঁছানোর ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা। যার কারণে এখনও মারিয়ানা ট্রেঞ্চকে পুরোপুরি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। হয়তো আরও অনেক বিচিত্র প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে এখানে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সম্পর্কে আরও আশ্চর্যজনক তথ্য জানতে পারবো।
মন্তব্য লিখুন