ঘুরতে কে না ভালবাসে? আর যারা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মন কে সন্তুষ্ট রাখতে চান,তাদের জন্য প্রকৃতি দর্শন এক সুবর্ণ সুযোগ।তাইতো রোমান দার্শনিক সেনেকা বলেছেন “ভ্রমণ ও স্থান পরিবর্তন মনের মধ্যে নতুন প্রানশক্তি তৈরি করে”। পাহাড়- পর্বত ভ্রমণে আপনার যেমন খুব কাছে থেকে মেঘ দেখা এবং ছোঁয়ারও সুযোগ থাকছে। আর, সমুদ্র ভ্রমণ করলে আপনি নীল আকাশ এবং পানির মিতালী দেখতে পারেন। অপরদিকে, যদি আপনি “বিল ভ্রমণ” করেন তাহলে চারপাশে সবুজের অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ভ্রমণ গুলোর মধ্যে “বিল ভ্রমণ” সত্যিই খুবই আনন্দের।
আপনি যদি ভ্রমণ পিপাসু হয়ে থাকেন, আর যদি ভালবাসেন পানির সাথে আকাশের নিবিড় অথচ সুক্ষ্ম মিতালী। আরো যদি ভাললাগে, চারপাশে থাকা গাছগাছালি আর পানির উপরে নৈসর্গিক ভাবে উঁকি দেয়া শাপলা এবং পদ্মফুল।
আবার পানির স্বচ্ছ পরিবেশে জলজ জীব গুলো দেখার অপার আনন্দ লাভ এর সুযোগ যদি না হারাতে চান। এক কথায় সবুজ আর নীল এর সমারোহতে নিজেকে আবিষ্কার করে, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য যদি উপভোগ করতে চান, তাহলে বিল ভ্রমণ আপনার জন্য।
বাংলাদেশ যেহেতু নদীতে পরিপূর্ণ, তাই প্রায় সব জায়গায়ই পানির উপস্তিতি লক্ষ্য করা যায়। আর একারণেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বিল। নদনদীর সাথে বিল গুলোর সংযোগ রয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তাই এখানে রয়েছে “বিল ভ্রমণ” এর সহজতর পরিবেশ এবং একই সাথে মনরোম দৃশ্য দেখার দারুণ সুযোগ। চলুন প্রথমেই জেনে নেই, বিল কী এবং কীভাবে বিলের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে-
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
বিল হচ্ছে এমন এক ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অভ্যন্তরীণ ও পৃষ্ঠ নিষ্কাশনের মাধ্যমে প্রবাহমান পানি একত্রিত হয়ে থাকে। বিলকে এক ধরনের অবভূমি বলা হয়। এর মানে অবনমিত ভূমি, যা দ্বারা ভূ -পৃষ্ঠ থেকে নিচু জায়গা কে নির্দেশ করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি ক্ষয় এর ফলে বিল এর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচুর পরিমাণে নদী থাকার কারণে অনেক বিল দেখা যায়। এর কারণ, কোনো কোনো বিল আগে নদীর অংশ ছিলো।
আবার কিছু ক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে বিল এর সৃষ্টি হয়। এই বিল শব্দ টি সাধারণত বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা, কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চল এ বেশি লক্ষ্য করা হয়। তাহলে চলুন, এবার জেনে নেওয়া যাক, বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এবং আকর্ষণীয় পাঁচটি বিল সম্পর্কে।
চিত্র :চলন বিল
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এই চলন বিল। বর্তমানে এই বিল এর আয়তন প্রায় ১১৫০ বর্গ কিলোমিটার। দেশের উত্তর এর প্রধানত নাটোর জেলায় এর অবস্থান। নাটোর, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলার অনেক গুলো ছোট ছোট খাল পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বিশাল আকৃতির বিল এর সৃষ্টি হয়েছে। যার আত্রাই নদীর সাথে যোগসূত্র রয়েছে।
নয়ানাভিরাম এই চলন “বিল ভ্রমণ” করলে আপনি ছোট ছোট সবুজে ঘেরা গ্রাম কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।বর্ষায় অথৈ জল এর সাথে বিভিন্ন মাছ এর সাথে পরিচিত হতে পারবেন। কিংবা শীতকাল এ পাখিদের সমারোহ তো রয়েছেই। বিল ভ্রমণ এর জন্য চলন বিল একটা আদর্শ বিল।আরো রয়েছে চলন বিল জাদুঘরও।
রাজশাহী জেলা থেকে খুবই কাছে চলন বিল। এছাড়াও ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেন যেকোনো উপায় এ ই যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলি বা মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে রাজশাহীগামি বাস এ যেতে পারেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে থেকেও রেলগাড়ী তে যাওয়া যায়। প্রায় ১৯০ কিলোমিটার দূরত্ব এর পথে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে যমুনা সেতু।
চিত্র :আড়িয়াল বিল
আড়িয়াল বিল এবং আড়িয়াল খাঁ নদী এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যদিও অনেকেই বিষয় দুইটা মিশিয়ে ফেলেন। আড়িয়াল খাঁ নদী বাংলাদেশ এর ফরিদপুর -মাদারিপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান একটি নদী । আর আড়িয়াল বিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থানরত চমৎকার একটি বিল।এর আয়তন প্রায় ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার।
দেশের মধ্য অঞ্চল এর সবচেয়ে বড় বিল এই আরিয়াল বিল। বিল ভ্রমণ এর জন্য এই বিল এক কথায় অনবদ্য। কেননা এই বিল এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে সবুজ এ বিস্তৃত চারপাশের পরিবেশ এর সাথে পাখিদের কিচিরমিচির এবং চোখ জুড়ানো এক বিস্ময়কর জলাশয়। শীতকাল এ এখানে সবজি উতপাদন করা হয়। আর বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে মাছ এর দেখা পাওয়া যায়। আপনি যদি এর অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাহলে নৌকায় বিল ভ্রমণ করতে পারেন।
ঘুরে আসুন সাগরকণ্যা কুয়াকাটা -নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
ঢাকা থেকে খুব কাছে এই বিল। আপনি ইচ্ছে করলেই সকালে গিয়ে বিকালে ফিরতে পারেন। ঢাকা -মাওয়া মহাসড়ক এর যেকোনো বাস এ যেতে পারেন। বাস থেকে শ্রীনগর এ গিয়ে ছোট যান এর মাধ্যমে খুব সহজেই চলে যেতে পারেন আরিয়াল বিল।
চিত্র: তেরোখাদা পদ্মবিল
দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম বিল এই তেরোখাদা বিল। এই বিল ভূতিয়ার পদ্মবিল নামেও পরিচিত। খুলনা জেলার তেরোখাদা উপজেলায় অবস্থিত বিলটি খুলনা শহরের খুব কাছে।
এই বিল এর প্রধান আকর্ষন এর কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে পদ্ম ফুল। নৌকায় ভ্রমণ করে এই বিল এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও আপনি এই বিল ভ্রমণ করলে, সরাসরি জেলেদের মাছ ধরা দেখতে পারবেন। সাথে পানিতে ভাসমান শাপলা ফুল, কচুরিপানাও রয়েছে।
চিত্রঃ ডাকাতিয়া বিল
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল হচ্ছে ডাকাতিয়া বিল ।এই বিল এর অবস্থান খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার মাঝে।এই বিল এর চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট সবুজে ছাওয়া গ্রাম। প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় এখানে। যেকোনো ভালো নৌযান এ এই বিল ঘুরে দেখতে পারেন আপনি।
ঢাকা থেকে আপনি যদি যেতে চান, তাহলে গাবতলী অথবা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে খুলনাগামি বাসে যেতে পারেন। আনুমানিক ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগবে। ঢাকা থেকে খুলনাতে রেলপথেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর খুলনা শহর থেকে খুব শীঘ্রই যেতে পারবেন বিল ভ্রমণ করতে। খুলনা অঞ্চলে একই সাথে দুইটি বিল ভ্রমণ এর সুযোগ রয়েছে।
চিত্র: সাতলা শাপলা বিল
দেশের দক্ষিণ অঞ্চল এ অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় বিল এই সাতলা শাপলা বিল। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলায় এই বিল এর অবস্থান। আপনি যদি জাতীয় ফুল শাপলা এর নানা রঙের রূপ দেখতে চান, তাহলে এই বিল এর তুলনা হয় না। সাদা, বেগুনি, লালসহ বিভিন্ন ধরনের শাপলা ফুল এর দেখা পাওয়া যায়। তবে লাল শাপলা এর প্রাধান্য বেশি। প্রকৃতির অপার লীলাভূমি উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে এই সাতলা শাপলা বিল ভ্রমণ করার মাধ্যমে।
ঢাকা থেকে বরিশালগামী বাসে যেতে পারেন, ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। এছাড়াও সদর ঘাট নৌ বন্দর থেকে লঞ্চে প্রথম এ বরিশাল সদরে এসে তারপর শহর থেকে ১ ঘন্টা থেকে ২ ঘন্টা এর মধ্যে সাতলা শাপলা বিলে পৌছাতে পারেন।
যেহেতু বিল এর প্রান হচ্ছে পানি।আর নৌকায় করে সমগ্র বিল ভ্রমণ করতে না পারলে পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ হয় না।তাই বর্ষা মৌসুমে বিল ভ্রমণ এর উপযুক্ত সময় বলা যায়। কেননা এ সময় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে। আর শীতকালে পানি কম থাকে। যদিও শীতকালে ভ্রমণ করলে, অতিথি পাখিদের দেখা যায় বেশি ।আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে বিলগুলো ঘুরে দেখার আদর্শ সময়।
আপনি দূরের যেখানেই ভ্রমণ করেন না কেন,কিছু জিনিস আপনার সাথে অবশ্যই রাখা প্রয়োজন এবং একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত।
১) যদি আপনি চশমা ব্যবহার করে থাকেন,তবে এক জোড়া অতিরিক্ত চশমা সাথে রাখতে পারেন।
২) মোবাইল, ইয়ারফোন, এর সাথে একটি পাওয়ার ব্যাংকও সঙ্গে রাখুন।
৩) একটি মানানসই ব্যাগ সাথে নিন।
৪) এক সেট পোশাক অতিরিক্ত রাখতে পারেন ব্যাগে।
৫) ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখে রাখতে, একটি ডায়েরি এবং কলমও নিন।
৬) রোদ থেকে চোখ এর সুরক্ষার জন্য সানগ্লাস,ছাতি ব্যবহার করতে পারেন।
৭) একটি লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখতে পারেন। সাতার শিখে যাওয়া ভালো।
৮) শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে রাখুন।
৯) একটি ক্যামেরা সঙ্গে নিন,দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক ছবি তুলে রাখতে পারেন।
১০) প্রয়োজন এর অতিরিক্ত অর্থ সাথে রাখুন ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আপনি বিল ভ্রমণ করুন বা যেখানেই ভ্রমণ করুন না কেন, যাত্রার আগে ওই স্থান সম্পর্কে ধারণা নিন এবং তথ্য সংগ্রহ করে নিন।
চিন্তার পরিধি বাড়িয়ে তুলতে, মনের গভীরতা বিশাল করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আপনি যেমন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারবেন একই সাথে বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে আপনার। প্রকৃতির অন্যতম মোহনীয় সব উপাদান একসাথে দেখা এবং উপভোগ করার জন্য “বিল ভ্রমণ” করা অবশ্যই প্রয়োজন।
ছবি: সংগৃহীত
তথ্য সূত্র: বাংলাপিডিয়া; উইকিভয়েজ; ভ্রমণগাইড; আদারবেপারি
মন্তব্য লিখুন