বিদেশি উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রে প্রায়ই দেখা যায় অবিকল মানুষে মতো দেখতে রক্তচোষা এক প্রাণী , যারা রাতের আঁধারে সুযোগ পেলেই মানুষের রক্তে নিজেদের তৃষ্ণা মেটায়। এরা হলো ভ্যাম্পায়ার, একটি রক্ত পিপাসু ভৌতিক চরিত্র।
এই চরিত্র নিয়ে আজ অবধি অনেক ভৌতিক সাহিত্য, মুভি, সিরিজ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। কাউন্ট ড্রাকুলা এদের মধ্যে অন্যতম। বিনোদন জগতে এটি যেমন জনপ্রিয় তেমনি বাস্তবেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এমন কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন যারা এখনো ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্বে কঠোর ভাবে বিশ্বাসী। আজ আমরা এই ভ্যাম্পায়ার মিথের ইতিহাস ও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন রীতিনীতি সম্পর্কে জানব।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা প্রাণীর এই মিথ নতুন নয়। বলা হয়, ১৮৯৭ সালে ব্রাম স্ট্রোকারের জনপ্রিয় উপন্যাস “ড্রাকুলা”প্রকাশিত হবার পর থেকেই মানুষের মাঝে ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস শক্ত হয়, তবে এর অনেক আগে থেকেই এধরনের মিথের অস্থিত্ব ছিল।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। ইহুদীদের পৌরানিক কাহিনীতেও এমন রক্তপানকারী চরিত্র রয়েছে। গ্রিক মিথলজিতেও ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব রয়েছে।
প্রাচীন গ্রিসে বিশ্বাস করা হতো জিউসের স্ত্রী হেরা যখন তার স্বামীর গোপন প্রেমিকা লামিয়ার কথা জানতে পারে তখন লামিয়ার সকল সন্তানকে সে হত্যা করে। এরপর থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লামিয়া রোজ রাতের অন্ধকারে শিশুদের রক্ত পান করতে শুরু করে।
এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, অনেক জনগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের মাঝে ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস ভয়ংকরভাবে বেড়ে যায়। একসময় ওই অঞ্চলে প্রায় সব মৃতদেহের মাঝ বরাবর চিরে ফেলা হতো কারন তাদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরে এরা সকলেই ভ্যাম্পায়ার হয়ে ফিরে এসে অন্যদের ক্ষতি করতে পারে।
ভ্যাম্পায়ারের ওপর ১৮১৯ সালে প্রথম বই লেখেন জন পোলিডরি। এরপর ১৮৯৭ সালে ব্রাম স্ট্রোকার লেখেন তার জনপ্রিয় উপন্যাস “ড্রাকুলা” যার মূল চরিত্রে ছিলেন কাউন্ট ড্রাকুলা। এরপর থেকেই মুলত আধুনিক দুনিয়ার হরর স্টোরিতে ভ্যাম্পায়ার চরিত্রটি একটি শক্ত অবস্থান করে নেয়।
বর্তমান সময়ে ভ্যাম্পায়ারদের জীবন নিয়ে অনেক মুভি, নাটক, টিভি সিরিজ নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- টুয়েলাইট, আন্ডারওয়ার্ল্ড, ট্রু ব্লাড, দ্যা অরিজিনালস, দ্যা ভ্যাম্পায়ার ডায়েরিস ইত্যাদি।
ব্রাম স্ট্রোকারের বিখ্যাত উপন্যাস “ভ্যাম্পায়ার” এর প্রধান চরিত্র ছিল কাউন্ট ড্রাকুলা। অনেকের মতে তিনি এ নামকরনের ক্ষেত্রে ভ্লাদ ড্রাকুলাকে অনুসরন করেছিলেন। ইনি অনেকের কাছে “ভ্লাদ দ্যা ইম্পেইলার” বা অভিশপ্ত ভ্লাদ নামেও পরিচিত ছিলেন।
ভ্লাদ ড্রাকুলার জন্ম হয়েছিল রোমানিয়ার ট্রানসালভানিয়ায়। তিনি ১৪৫৬ থেকে ১৪৬২ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার ওয়ালাচিয়া রাজ্য শাসন করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তিনি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও বর্বর শাসক ছিলেন। তিনি অটোম্যান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
কথিত আছে ভ্লাদ ড্রাকুলা তার বন্দী শত্রুদের একটি বিশেষ উপায়ে হত্যা করতেন। তিনি কাঠের একটি খন্ডকে শত্রুদের বুকে নির্মমভাবে বিদ্ধ করে হত্যা করতেন। আরো কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে যে, তিনি শত্রুদের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে রুটি খেতেন।
তবে এগুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না। অনেকেই ধারনা করেন এগুলো ব্রাম স্টোকারের কল্পনাপ্রসূত গল্প। কাউন্ট ড্রাকুলা চরিত্রকে মানুষের কাছে আরো ভয়ংকর ও নৃশংস করে উপস্থাপন করার জন্যই হয়তো তিনি এমন রচনা করেছিলেন।
তবে ড্রাকুলা বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ মিলারের মতে ব্রাম স্টোকার ভ্লাদকে অনুসরন করে কাউন্ট ড্রাকুলার চরিত্রটি তৈরি করেননি। যেসব মিলগুলি এই দুই চরিত্রে পরিলক্ষিত হয় তা নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু এটা বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই বিশ্বাস করেন যে শত্রুদের প্রতি ভ্লাদ প্রচন্ড নিষ্ঠুর ছিলেন।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভ্যাম্পায়ার ভীতি প্রচন্ড ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময় বিভিন্ন মহামারীতে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করছিলেন। ওইসব মহামারীর মধ্যে বুবেনিক প্লেগ অন্যতম। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মুখে প্রায়সই একপ্রকার ক্ষত চিনহ দেখা যেত। অনেক মানুষ তখন এটিকে ভ্যাম্পায়ারের আক্রমন বলে বিশ্বাস করতেন।
এছাড়া পোরফেরিয়া নামক একপ্রকার রক্তের সংক্রমণকেও তারা এই কুসংস্কারের মধ্যে ফেলতেন বলে মনে করা হয়। এর একটি কারন বোধ হয় এই রোগর দ্বারা চামড়ায় সৃষ্ট ক্ষত সূর্যের আলোতেই বেশি চোখে পড়তো। তাই এই রোগীরা সূর্যের আলোয় বেড়োতে পারতেন না।
আবার, টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের অনেকে মারা গেলেও সেটা ভ্যাম্পায়ারের আক্রমন বলে মনে করা হতো। আর এর প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাম্পায়ার সন্দেহকৃত ব্যক্তির মৃতদেহ থেকে হৃদপিন্ড বের করে সেটা পুড়িয়ে তার ছাই গ্রামের অন্য অসুস্থ ব্যক্তিদের খাওয়ানো হতো। আসলে, সেই সময় ভ্যাম্পায়ারে ভীতি এতটাই চরম আকার ধারণ করেছিল যে যেকোনো নতুন রোগ ধরা পড়লেই মানুষ কুসংস্কারের আশ্রয় নিতো।
ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাসে্র ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম রীতিনীতির প্রচলন দেখা যায়। আঠারো শতকের শেষের দিকে আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে মার্সি ব্রাউন নামের একজনকে ভ্যাম্পায়ার মনে করার একটি ঘটনা শোনা যায়। মার্সির পরিবার সে সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
কিন্তু স্থানীয় মানুষ ধারণা করেন মার্সি ভ্যাম্পায়ার হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার আক্রমনেই পুরো পরিবারের মত্যু হয়। এই ধারণা থেকে মানুষ এ পরিবারের সকলের মৃতদেহও পরীক্ষা করা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল কারো দেহে কোনো কামড়ের দাগ আছে কিনা। মার্সির দেহটিও স্বাভাবিক ভাবে সমাহিত করা হয় না। সে যাতে মৃত্যুর পর গ্রামের আর কারো ক্ষতি না করতে পারে তাই সমাহিত করার আগে তার বুক চিরে হৃদপিন্ড বের করে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
খুব বেশি দিন আগে নয়, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে রোমানিয়াতে টোমা পেত্রে নামক এক মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা একবার অভিযোগ করেন যে ইনি ভ্যাম্পায়ার হয়ে গেছেন। সে সময় গ্রামের অনেকে অজানা কারনে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তার আত্মীয়রা অনেকে তাকে স্বপ্নেও দেখছিলেন। এরপর টোমা পেত্রেকে ভ্যাম্পায়ার হওয়া থেকে আটকাতে এবং গ্রামবাসীদের বাঁচাতে তারা তার কবর খুঁড়ে তার মৃতদেহ বের করে আনে।
এরপর বুক চিরে হৃদপিন্ড বের করে পুড়িয়ে সেই ছাই মিশ্রিত পানীয় আক্রান্ত গ্রামবাসীদের খাওয়ানো হয়। ওই সময় উপস্থিত অনেকে বলেন তারা টোমা পেত্রের ভ্যাম্পায়ার হওয়ার প্রমান পেয়েছেন। কারন তারা কবর উন্মোচনের পর দেখেছেন মৃতদেহের দাড়ির বৃদ্ধি হয়েছে এবং মুখের কোনায় রক্তের দাগ।
তবে বিজ্ঞানীদের মতে, মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর চামড়ার সংকোচনের ফলে দাড়ির বৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হতে পারে। আর অভ্যন্তরীন রক্ত ক্ষরনের কারনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর মুখ থেকে এমন রক্ত ক্ষরন হতে দেখা যায়। তাই এটির থেকে ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায় না।
আজ একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই মিথে বিশ্বাস অনেকটাই চলে গেছে। তবু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন বেশ কিছু গুপ্ত সম্প্রদায় এখনো রয়ে গেছে যারা নিজেদের ভ্যাম্পায়ার বলে দাবি করেন এবং এটিকে তারা একটি বিশেষ শক্তি বলে মনে করেন। অনেকে ভুল পথে পরিচালিত হয়ে তাদের নিয়ম অনুসারে অনেক নৃশংস কাজ করে থাকেন। কিছুক্ষেত্রে অল্প পরিমান রক্তও পান করে থাকেন।
রক্তচোষা মানবসদৃশ এই প্রাণীর মিথ বেশ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। প্রকৃ্তপক্ষেই পৃথিবীতে এর অস্তিত্ব থাকুক বা নাই থাকুক, একপ্রকার রক্তচোষা বাদুর অবশ্যই আছে। প্রায় সব গল্পে, সাহিত্যে, সিনেমায় ভ্যাম্পায়ারের প্রতীক হিসেবে এই বাদুরদের দেখা পাওয়া যায়। এরাও সূর্যের আলোর আড়ালে অন্ধকার গুহায় বসবাস করে। এরা রক্তপান করার সাথে সাথে মানুষের দেহে নানা রকম প্রাণঘাতী রোগের বিস্তারও ঘটাতে পারে।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানারকম গল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। এই আধুনিক যুগে আমাদের কাছে এটি হরর মুভির বিনোদন বা হ্যালোইন উদযাপনের একটি অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এমন অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছেন যারা এখনো এই মিথে বিশ্বাসী।
এই বিশ্বাস থেকে তারা বিভিন্ন নৃশংস ও ভয়ংকর আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন যা হয়তো তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তবুও এই ভৌতিক চরিত্র বর্তমান মানুষের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিনোদন জগতের কল্যানে ভবিষ্যতেও যে এর কদর কমবার নয়, তা বলাই বাহুল্য।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন