বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন বলা হয়ে থাকে। জীবকূলের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য পানি অপরিহার্য। কিন্তু, দৈনন্দিন সময়ে পানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যা গোত্র ছাড়িয়ে দেশে তথা বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
পানি বা জল হলো একটি অজৈব, স্বচ্ছ, স্বাদহীন, গন্ধহীন এবং প্রায় বর্ণহীন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা পৃথিবীর বারিমণ্ডলের (hydrosphere) ও যেকোনো জীব-কোষ বা উদ্ভিদ-কোষের একটি প্রধান উপাদান। জীবকোষের অন্যতম গঠন উপাদান হলো প্রোটোপ্লাজম এবং এই প্রোটোপ্লাজমের বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে পানি।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, পৃথিবীর ৩ ভাগ জল ও ১ ভাগ স্থল। কথাটি দ্বারা পৃথিবীর পৃষ্ঠতল (Surface) এর পানি ও স্থলভাগের বিষয়টি বোঝানো হয়। এত বিশাল পানির সম্ভার থাকার পরেও কেনো বৈশ্বিক পানি সমস্যা?
পৃথিবীর এই ৩ ভাগ পানির বড় একটা অংশ ব্যবহারের অনুপযুক্ত পানি। সোজা কথায়, আমরা সব পানিকে সুপেয় পানি বলতে পারিনা। সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি, দূষিত পানি বাদ দিলে যে স্বল্প পরিমাণে পানি আমাদের পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকে, সেটুকু পানি দিয়েই সমগ্র মানব জাতির পানাহার থেকে দৈনন্দিন সুপেয় পানির চাহিদার সিংহ ভাগ পূর্ণ হয়।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এর ঘনত্ব ৯৯৭ kg/m³, পেষক ভর: ১৮.০১৫ g/mol, রাসায়নিক সংকেত H2O এর মাধ্যমে লেখা হয়। দুই অণু হাইড্রোজেন এবং এক অনু অক্সিজেন মিলিত হয়ে পানি তৈরী করে। স্ফুটনাঙ্ক ১০০ °C এবং গলনাঙ্ক: ০ °C। পানি একটি তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ এবং বিদ্যুৎ পরিবহন করতে সক্ষম।
পানি সংকটের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য একটি জরিপই যথেষ্ট। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াশ মানুষই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে প্রায় বৈশ্বিক ৭৬ কোটি জনগণ।
বিপুল এই জনগোষ্ঠী স্বল্প পানিতে দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও এর সুদূর প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে তাদের জীবনের উপর। স্বাস্থ্যহানি থেকে পরবর্তী প্রজন্মের সমস্যা – সবই কোনো না কোনো ভাবে পানি দ্বার প্রভাবিত হচ্ছে।
ইউনিসেফের একটি জড়িপ অনুসারে, এশিয়া মহাদেশের তথা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর অঞ্চল চীনের ১০ কোটি ৮০ লাখ; দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী সম্পন্ন ভারতের ৯ কোটি ৯০ লাখ ও আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়ার ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে ইথিওপিয়ায় ৪ কোটি ৩০ লাখ; ইন্দোনেশিয়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ ও পাকিস্তানে ১ কোটি ৬০ লাখ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশেও আছে চরম সংকট। এখানে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী পানি সংকটের মধ্যে জীবন যাপন করে।
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) হিসাবে সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। পৃথিবীর এতগুলো দেশের ভিতরে আমাদের দেশে সুপেয় পানির অভাবের চিত্র নিশ্চই পরিস্কার এবার।
জাতিসংঘের ভাষ্যমতে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ পায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯শ’ ৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭শ’ কোটিই পানির সমস্যায় পড়বেন। এই পানিকে কেন্দ্র করে ঘটতে পারে বৈশ্বিক বড় রকমের দাঙা। হয়ে যেদে পারে শতাব্দীর সেরা ভয়ানক আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ।
২০১৮ সালের ১৫ ই জুন বিবিসি নিউজ একটি প্রতিবেদন তৈরী করে ভারতের পানি সমস্যাকে কেন্দ্র করে। সেখানে বলা হয়, ২০২০ সাল নাগাদ ভারতের ২১ টি নগরী চরম পানি সংকটের মুখে পড়বে। এবং সেই সতর্কবার্তাকে সত্য করে দিয়ে ২০২০ সালেই ভয়ানক পানি সমস্যায় পড়ে ভারত। কারণ, ভারতের রাজ্যগুলোতে ৮০ শতাংশ পানিই ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজের জন্য।
এর ফলে খুব দ্রুতই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। হরিয়ানা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ড – এসব রাজ্য আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ভয়াবহ পানি সমস্যার চিত্র দেখতে পাবে।
বিশ্বের অন্যতম সুপেয় পানির আধার যে কয়টি দেশে রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় আয়তন অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় সুপেয় পানির পর্যাপ্ততা থাকা সত্ত্বেও ভয়ানক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন। গর্ভাবস্থায় এসব নারী লবণাক্ত পানি পান করেন। এতে তাঁদের খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান বেশি মারা যায়।
বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো হতে সংগৃহীত এক তথ্য মতে, বাংলাদেশের পানিদূষণের আরেকটি কারণ হিসেবে কৃষিকাজে মাটিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারকে দায়ী করা হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বে গড়ে প্রতি হেক্টর জমিতে ৬৮ দশমিক ৭৫ কেজি ইউরিয়া, ২৯ দশমিক ৪৮ কেজি ফসফেট ও ২৩ দশমিক ৭৬ কেজি পটাশিয়াম সার ব্যবহার করা হয়।
আর বাংলাদেশে তা যথাক্রমে ১৪৫ কেজি, ৬৫ কেজি ও ৪১ কেজি ব্যবহৃত হয়। ইউরিয়া ও ফসফেট ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চীনের পরেই, আর পটাশিয়ামে তৃতীয়। এসব সার ব্যবহারে শীর্ষ রয়েছে চীন।
এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা শহরের পানির স্তর এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে। রাজশাহীতেও পানির স্তর ১৮ থেকে ২৯ ফুট নিচে চলে গেছে। ফলে সাগরের লোনা পানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে এখন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মিঠা পানিভিত্তিক ইকোলজি পরিবর্তিত হয়ে লবণ পানি হয়ে যেতে পারে। ফলে বর্তমানের গাছপালা বিলীন হয়ে যাবে ও চিরচেনা শস্য বিন্যাস হারিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
পৃথিবীর যত পানি তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ পানের বা চাষের অযোগ্য সমুদ্রের লোনা পানি। মিষ্টি বা স্বাদু পানির মোট পরিমাণ আড়াই শতাংশের মতো হবে। এই আড়াইভাগ পানির দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি পানি বরফ হয়ে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে।
বর্তমান সময়ে সেটাও হচ্ছে না বলে জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বাকি পানির তিন-চতুর্থাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি। মাত্র ০.৩ ভাগ পানি থাকে নদ-নদী, খাল-বিল পুকুর, নালা, জলাশয় ইত্যাদিতে। অতএব ,পৃথিবীর মোট পানির শতকরা একভাগেরও কম পানি পানযোগ্য।
সমাধানের পথে হাঁটতে গেলে সর্বপ্রথম জনসচেতনতার কথাটি চলে আসবে। বৈশ্বিকভাবে পদক্ষেপ নিলেও আমরা যদি সচেতন না হই, ভবিষ্যতের কথা না চিন্তা করে অকপটে পানি অপচয় করতে থাকি, আমরা সামনের দিনগুলোতে অন্ধকার দিন ছাড়া আর কিছুই দেখবোনা।
২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমনের উপরে স্থান দেয়া হচ্ছে৷ সুতরাং, সর্বপ্রথম বিষয়টির ভয়াবহতা সবাইকে বোঝাতে হবে।
ক্লাউড ফিশার টেকনোলজি সাহারা অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। কৃত্রিম মেঘ সৃষ্টি করে সুপেয় পানি প্রাপ্তির বিজ্ঞানভিত্তিক এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করা যেতে পারে।
এছাড়া বৃষ্টির পানির ব্যবহার করা যেতে পারে। সুপেয় পানির জন্য বৃষ্টির পানি থেকে পানি সংগ্রহ করে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে পরিশোধন করা যেতে পারে। এতে করে পানিচক্রে অসাম্যবস্থা সৃষ্টির একটা আশংকা করে এক শ্রেণির বিজ্ঞানীরা।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বলতে গেলে নৈতিকতার পরিপন্থী একটি কাজ। এমতাবস্থায় পানির অপচয় রোধ এবং যথাযথ ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে উপযুক্ত পাঠ্যসূচি যদি প্রস্তুত করে পরবর্তী প্রজন্মের বাতিঘরের কাছে সরবেরাহ করা যায়, তাহলে অবশ্যই একটু দেরিতে হলেও একটা সচেতন মহল গঠিত হবে।
আসুন, নিজে পানির অপচয় না করি এবং অন্যকে অপচয় করতে দেখলে নিষেধ করি।
তথ্য সহায়তা:
ছবি: ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন