বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নাম সর্ব স্বীকৃত। তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাত। গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন সংগ্রাম ও গ্রামীণ বিভিন্ন রীতিনীতি তার লেখায় চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। তার রচিত গ্রন্থ সমূহ ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনুবাদ করা হয়েছে। শরৎচন্দ্র রচনাবলী সবচেয়ে বেশি পঠিত ও অনূদিত রচনা হিসেবে স্বীকৃত। জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিকের ৮৩ তম প্রয়াণ দিবস ছিল ১৬ জানুয়ারি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জন্ম হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব পুরুষের নিবাস ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার মামুদপুরে। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই ও বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তার ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে দেবানন্দপুর থেকে পরবর্তীতে তারা ভাগলপুরে তার মাতৃনিবাসে চলে যান।
শিক্ষাজীবন:
৫ বছর বয়সে দেবানন্দপুরে প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় পড়াশুনা শুরু করেন শরৎচন্দ্র। দুতিন বছর সেখানে পড়াশোনার পর ভাগলপুরে চলে যান তারা। তার মামা স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তার বাবার চাকরি চলে গেলে তারা পুনরায় দেবানন্দপুরে চলে যান। নতুন করে তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ফি দিতে না পারায় ১৮৯২ সালে তাকে স্কুল ত্যাগ করতে হয়। এ সময়ে তিনি “কাশীনাথ” এবং “ব্রহ্মদৈত্য” নামে দুটি গল্প লেখেন।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ভাগলপুরে চলে গেলে সেখানকার তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সে স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২য় বিভাগে এনট্রান্স পাশ করে শরৎচন্দ্র ভর্তি হন তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে। সেসময় নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন ছাত্র পড়িয়ে। তবে এতো কিছুর পরেও ফি দিতে না পারায় তিনি এফএ পরীক্ষা দিতে পারেন নি।
চিত্রঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি, সামতাবেড়, হাওড়া
কর্মজীবন:
কলেজের পড়াশোনার ইতি ঘটলে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে খেলাধুলা ও অভিনয় করতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এ সময়টাতে তিনি রচনা করেন বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা ইত্যাদি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোবা, হরিচরণ ইত্যাদি গল্প।
চাকরি জীবনের শুরুতে বনেলী রাজ এস্টেটে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন। তখন পিতার উপর অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান শরৎচন্দ্র। এ ঘটনার কিছুদিন পরে তার পিতার মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধ সেরে তিনি চলে যান কলকাতাতে। সেখানে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক উকিলের বাড়িতে হিন্দি বইকে ইংরেজিতে পড়িয়ে শোনানোর চাকরি পান। সেসময় তার রচিত মন্দির গল্পটি কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়ে বিজয়ী হন।
মূলত এ ঘটনাই তার কোন রচনাকে বিশেষ পরিচিতি পাইয়ে দেয়। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে অডিট অফিসে চাকরি নিয়ে বর্মা চলে যান। কিন্তু ২ বছর পর এ চাকরি চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে রেঙ্গুনে এক অফিসে চাকরি পান। সে চাকরিতে ১০ বছর বহাল ছিলেন তিনি।
লেখক জীবন:
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে রেঙ্গুন থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন শরৎচন্দ্র। তখন যমুনা পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল তাকে অনুরোধ করেন তার পত্রিকায় লেখা পাঠানোর জন্য।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে “রামের সুমতি” গল্পটি পাঠিয়ে দেন যা ১৩১৯ বঙ্গাব্দের যমুনা পত্রিকার ফাল্গুন ও চৈত্র্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকাতেও বিভিন্ন লেখা পাঠান। যমুনার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল শরৎচন্দ্রের “বড়দিদি” পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন।
আরও পড়্নঃ
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এর জীবন কাব্য
বহুমাত্রিক লেখক আহমদ ছফা এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
এছাড়া এমসি সরকার এন্ড সন্স এবং গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তার উপন্যাস প্রকাশ করতে থাকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাংলায় ফিরে আসেন এবং সম্পূর্ণভাবে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
বৈবাহিক জীবন:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনে থাকাকালীন শান্তি দেবী নামে একজনকে বিয়ে করেন। তাদের এক পুত্রসন্তান ছিল । রেঙ্গুনে প্লেগের কারণে শান্তি দেবী ও তাদের এক বছর বয়সী পুত্রের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে ১৪ বছর বয়সী মোক্ষদাকে বিয়ে করেন তার পিতার অনুরোধ রক্ষা করতে। তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
সাহিত্যে অবদান:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তার অনবদ্য সব রচনা দিয়ে। তার রচিত গ্রন্থ সমূহ এতো পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে যে বেশ কয়েকটি ভাষায় সেসব গ্রন্থ অনুবাদ করতে হয়েছে। এছাড়াও বাংলা ভাষায় সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ সমূহের রচয়িতাও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
উপন্যাস:
বড়দিদি, বিরাজ বৌ, বিন্দুর ছেলে, পরিণীতা, পন্ডিতমশাই, মেজদিদি, পল্লী-সমাজ, চন্দ্রনাথ, বৈকুন্ঠের উইল, অরক্ষণীয়া, শ্রীকান্ত, নিষ্কৃতি, দেবদাস, চরিত্রহীন, কাশীনাথ, দত্তা, স্বামী, ছবি, গৃহদাহ, বামুনের মেয়ে, দেনা পাওনা, নব-বিধান, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন, বিপ্রদাস, শুভদা, শেষের পরিচয়।
নাটক:
ষোড়শী, রমা, বিরাজ বৌ, বিজয়া।
গল্প:
রামের সুমতি, পথ-নির্দেশ, আধারে আলো, দর্পচূর্ণ, একাদশী বৈরাগী, বিলাসী, মামলার ফল, হরিলক্ষ্মী, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, অনুরাধা, সতী, পরেশ।
প্রবন্ধ:
নারীর মূল্য, তরুণের বিদ্রোহ, স্বদেশ ও সাহিত্য, স্বরাজ সাধনায় নারী, শিক্ষার বিরোধ, স্মৃতিকথা, অভিনন্দন, ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য, গুরু-শিষ্য সংবাদ, সাহিত্য ও নীতি, সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি, ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত।
সম্মাননা:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি লাভ করেন।
চলচ্চিত্রায়ন:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা সমূহকে বেশ কয়েকবার চলচ্চিত্রে রূপান্তর করা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তার গ্রন্থকে চলচ্চিত্রে পরিণত করা হয়েছে। দেবদাস উপন্যাসের আলোকে বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে আট বার! এছাড়াও বড়দিদি, পরিণীতা, চন্দ্রনাথ, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত, বিরাজ বৌ, দত্তা ইত্যাদি গ্রন্থ কে চলচ্চিত্র আকারে নির্মাণ করা হয়েছে। মেজিদিদি উপন্যাস অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় মাঝলি দিদি নামেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। স্বামী (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৩ সালে তার রচিত নব-বিধান উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে একটি হিন্দি ধারাবাহিকও নির্মাণ করা হয়।
মৃত্যু:
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সময়েই অসুস্থ থাকতেন শরৎচন্দ্র। সেসময় চিকিৎসকের পরামর্শে স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে গিয়ে তিন চারমাস কাটিয়ে আসেন। কিন্তু ফিরে আসার কিছুদিন পর আবার অসুস্থ বোধ করেন। তখন তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে যা পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
চিকিৎসার জন্য প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ৪নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি হন তিনি। অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তার অস্ত্রোপাচার করা হয়। কিন্তু তার চারদিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০ টায় ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে মারা যান জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিক।
বাংলা সাহিত্যকে অপরিমেয় প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার লেখনী মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে পাঠকদের। এমনকি বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের মাঝেও সমানভাবে জনপ্রিয় তার অমর গ্রন্থ সমূহ।
ছবিঃ সংগৃহীত