“সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল” মানুষের চিন্তা আর জ্ঞানের জগতে তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সক্রেটিসের মধ্যে যে চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল; প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাকেই সুসংহত দর্শনের রূপ দিলেন। এরা শুধু যে গ্রিসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক তাই নয়, সমগ্র ইউরোপের জ্ঞানের জগতে যুগপুরুষ।
প্লেটো ছিলেন সেই সব সীমিত সংখ্যক মানুষের একজন যারা ঈশ্বরের অকৃপণ করুণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে। অপরূপ ছিল তার দেহলাবণ্য, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, সক্রেটিসের মতো গুরুর শিষ্যত্ব লাভ করা, সবকিছুতেই তিনি ছিলেন সৌভাগ্যবান।
পিতা ছিলেন এথেন্সের বিশিষ্ট ব্যক্তি। কিন্তু আভিজাত্যের কৌলীন্য তাকে কোনো দিন স্পর্শ করেনি। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন উদাসীন। বাস্তব জীবনের জটিলতা, সমস্যার চেয়ে জ্ঞানের সীমাহীন জগৎ তার মনকে আরো বেশি আকৃষ্ট করতো। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক আর কল্পনাপ্রবণ। এক সময় এথেন্স সর্ববিষয়ে সমৃদ্ধ ছিল। প্লেটো যখন কিশোর সেই সময় সিসিলির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এথেন্স। এই যুদ্ধের পর থেকেই শুরু হলো এথেন্সের বিপর্যয়। দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বৈরাচারী শাসন। সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা দিল অবক্ষয় আর দুর্নীতি।
প্লেটো বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন। তাদের কারো কাছে শিখেছেন সঙ্গীত, কারো কাছে শিল্প, কেউ শিখিয়েছেন সাহিত্য আবার কারো কাছে পাঠ নিয়েছেন বিজ্ঞানের। সক্রেটিসের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই ছিল প্লেটোর গভীর শ্রদ্ধা।
সক্রেটিসের জ্ঞান, তার শিক্ষাদানের পদ্ধতির প্রতি কিশোর বয়সেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। কুড়ি বছর বয়সে তিনি সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তরুণ প্লেটো অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। গুরুর বিপদের মুহূর্তেও প্লেটো ছিলেন তার নিত্যসঙ্গী।
বিচারের নামে মিথ্যা প্রহসন করে সক্রেটিসকে হত্যা করা হলো। সক্রেটিসের মৃত্যু হলো কিন্তু তার প্রজ্ঞার আলো জ্বলে উঠল শিষ্য প্লেটোর মধ্যে। প্লেটো শুধু যে সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন গুরুর জ্ঞানের ধারক-বাহক। গুরুর প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা খুব কম শিষ্যের মধ্যেই দেখা যায়।
প্লেটো যা কিছু লিখেছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার প্রধান নায়ক সক্রেটিস। এর ফলে উত্তর কালের মানুষদের কাছে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সক্রেটিসকে কেন্দ্র করে প্লেটো তার সব সংলাপ তত্ত্বকথা প্রকাশ করেছেন। সব সময়ই প্লেটো নিজেকে আড়ালে রেখেছেন, কখনোই প্রকাশ করেননি।
সক্রেটিসের জীবনের অন্তিম পর্যায়ের যে অসাধারণ বর্ণনা করেছেন প্লেটো তার ‘সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন’ গ্রন্থে, জগতে তার কোনো তুলনা নেই। প্লেটোর মতো প্রতিভাবান পুরুষ যে শুধুমাত্র সক্রেটিসকে অন্ধ অনুসরণ করে তার অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন এ কথা মেনে নেয়া কষ্টকর।
তার কথোপকথনগুলো দীর্ঘকাল ধরে রচনা করা হয়েছে। প্লেটোর মতো একজন মহান চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সমস্ত জীবন ধরে শুধু সক্রেটিসের বাণী প্রচার করবেন, একথা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। তাই পণ্ডিত ব্যক্তিদের ধারণা, প্লেটো তার নিজের অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন।
তার এই সব অভিমতের উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে সক্রেটিসের জীবন ও তার বাণী। গুরুর মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন প্লেটো। তার কয়েক বছরের মধ্যেই এথেন্স স্পর্টার হাতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলো। আর এথেন্সে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে বেরিয়ে পড়লেন প্লেটো।
তিনি যখন যে দেশেই গিয়েছেন সেখানকার জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এতে একদিকে যেমন তার দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের প্রসার ঘটেছিল, অন্যদিকে তেমনি পণ্ডিত দার্শনিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি সমমান একটু একটু করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কয়েক বছরের মধ্যেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রবাস জীবন কাটিয়ে অবশেষে ফিরে এলেন এথেন্সে। মহান গুরুর মহান শিষ্য। ভ্রমর যেমন ফুলের সুবাসে চারদিক থেকে ছুটে আসে দলে দলে, ছাত্ররা এসে ভিড় করল প্লেটোর কাছে।
সক্রেটিস শিষ্যদের নিয়ে প্রকাশ্য স্থানে গিয়ে শিক্ষা দিতেন কিন্তু প্লেটো উন্মুক্ত কল-কোলাহলে শিক্ষাদানকে মেনে নিতে পারতেন না। নগরের উপকণ্ঠে প্লেটোর একটি বাগানবাড়ি ছিল, সেখানেই তিনি শিক্ষাকেন্দ্র খুললেন, এর নাম দিলেন একাডেমি।
এই একাডেমির ছাত্রদের কাছেই প্লেটো উজাড় করে দিলেন তার জ্ঞান চিন্তা মনীষা। তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, সিসিলি দ্বীপের শাসকদের আহ্বানে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে সেখানে যান। তিনি চেয়েছিলেন সিসিলিকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কিন্তু দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনার সাথে রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তা-ভাবনার কোনো দিনই মিল হয় না। তাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলেন এথেন্সে। তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন “রিপাবলিক” গ্রন্থ এক আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে। আসলে প্লেটোর আগে দর্শনশাস্ত্রের কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। তিনিই তাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করলেন। জীবনব্যাপী সাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষকে দিয়েছেন এক নতুন প্রজ্ঞার আলো। ইউরোপ তাকে বর্জন করলেও আরবরা তাকে গ্রহণ করল। আরব পণ্ডিতরা তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল।
আবার চারদিকে প্রচারিত হলো তার আদর্শবাদ। ইউরোপের মানুষের চিন্তা-ভাবনার মননের জগতে যে দুজন মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাদের একজন প্লেটো, অপরজন অ্যারিস্টটল। প্লেটোর চিন্তা-ভাবনা তার যুগকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে এক চিরকালীন সত্য।
প্লেটোর চিন্তা-ভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তার রিপাবলিক গ্রন্থে। বিশ্বসাহিত্যের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যদিও বইখানিতে মূলত রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনে এখানে নানা প্রসঙ্গ এসেছে। মানব জীবন এবং সমাজ জীবনে যা কিছু প্রয়োজন-শরীরচর্চা, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, এমনকি সুপ্রজননবিদ্যা-এছাড়া কাব্য অলঙ্কার নন্দনতত্ত্ব এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন-(১) শাসক সম্প্রদায় (২) সৈনিক (৩) জনসাধারণ ও ক্রীতদাস।
রাষ্ট্র তখনই সুপরিচালিত হয় যখন তিন বিভাগের কাজের মধ্যে সুসামঞ্জস্য বর্তমান থাকে এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। তিনি বলেছেন, শাসক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন জ্ঞান, শাসন ক্ষমতা-সৈনিকদের চাই সাহস, বীরত্ব, জনগণের প্রয়োজন সংযম ও শাসকদের প্রতি আনুগত্য।
রাষ্ট্রের উন্নতি-অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে শাসকদের ওপর। তাই প্লেটো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শাসক নির্বাচনের ওপর। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রক্ষমতায় কোনো স্বৈরাচারীর স্থান নেই। ‘রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শুধু জীবন ধারণের জন্য নয়।
যতদিন মানুষ জীবিত থাকবে তত দিনই সে শ্রেষ্ঠ জীবন যাপন করবে। তার রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচু-নিচের ভেদ থাকবে না, থাকবে পারসপরিক সৌহার্দ্য ও প্রীতির সম্পর্ক। “দি লস” গ্রন্থে তিনি বলেছেন, নগরবাসীরা সকলে পরস্পর্কে জানবে বুঝবে। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর কিছুই হতে পারে না। সুপ্রজননবিজ্ঞান-প্রাচীন গ্রিসের মানুষরা সুস্থ সবল দেহের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত। তারা দুর্বল অসুস্থ শিশুকে জীবিত রাখার পক্ষপাতী ছিল না। প্লেটো এই অভিমত সমর্থন করতেন।
তাই তিনি বলেছেন, যাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্ত তাদের কোনো সন্তান প্রজনন করা উচিত নয়। আপাত দৃষ্টিতে প্লেটোর অভিমত নিষ্ঠুর বলে মনে হলেও সামাজিক বিচারে তা একেবারে মূল্যহীন নয়। সঙ্গীতের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর আকর্ষণ।
তিনি বিশ্বাস করতেন সঙ্গত মানব জীবনকে পূর্ণতা দেয়, মানবিক গুণকে বিকশিত করে। নারীদের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাদের শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি উদার নীতিতে বিশ্বাস করতেন। সেই যুগে অনেক মহিলাই পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি মনে করতেন পুরুষরা অহমিকাবশত নারীদের উপেক্ষা করে। গ্রিসের পুরুষদের এই অহমিকা প্লেটোকে স্পর্শ করেনি। তিনি দেখেছেন বিভিন্ন গ্রিক মনীষীর প্রেরণার উৎসই হচ্ছে নারী।
প্লেটো তার সমস্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে এক আদর্শ রাষ্ট্র, মানব সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জীবনের অন্তিম পর্বে এসে বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, রিপাবলিকের মধ্যে তিনি যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তা কোনো দিনই বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি লিখলেন তার “আইন গ্রন্থ”।
এতে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন, তার কল্যাণের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রের আদর্শের কথা বলেছেন। দার্শনিক প্লেটোর আরেক দিক তার কবিসত্তা। তার প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জ্ঞান, গভীরতা, প্রজ্ঞা, অন্যদিকে ফুটে উঠেছে অনুপম লালিত্য।
দর্শনের ভাষা যে এমন প্রাণবন্ত, কাব্য সৌন্দর্যে অতুলনীয় হয়ে উঠতে পারে, প্লেটোর রচনা না পড়লে তা অনুভব করা যায় না। প্লেটো কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না কিন্তু তার রচনার মধ্যে কবি আর দার্শনিক সত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তাই তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রাসেল বলেছেন, ‘প্লেটো শুধু ভাবুক ছিলেন না-ছিলেন কলাকুশলী। তার প্রতিটি রচনাই সাহিত্যিক নিপুণতার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কোথাও তার রচনা নাটকীয়, কোথাও ঐতিহাসিক ঘনঘটায় আচ্ছন্ন।
ভোরের আলোছায়ার মতো তার রচনায় হাস্যরস, গাম্ভীর্য, করুণ রস একই সাথে পরাস্পরকে অনুগমন করেছে। বিষয় বৈচিত্র্যে রচনাশৈলীর সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতায় প্লেটোর নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য স্রষ্টাদের পাশে অমর হয়ে থাকবে।’
প্লেটো ছিলেন একেশ্বরবাদী। তার ঈশ্বর মঙ্গলময়, তিনি মানুষের কল্যাণ করেন। তিনি পূজা পাঠ উপাসনাকে স্বীকার করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রদ্ধা আর পবিত্র চরিত্র। সেই সাথে প্রজ্ঞা, জ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের পূজা করতে হয়।
একদিন তার এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার কলকোলাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বিশ্রাম নেয়ার জন্য পাশের ঘরে গেলেন কিন্তু আনন্দ উল্লাসের শব্দ ক্রমশই বেড়ে চলছিল। উপস্থিত সকলেই ভুলে গিয়েছিল বৃদ্ধ দার্শনিকের কথা।
এক সময় বিবাহ শেষ হলো। নব দম্পতি আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য প্লেটোর কক্ষে প্রবেশ করল। প্লেটো তখন গভীর ঘুমে অচেতন। পৃথিবীর কোনো মানুষের ডাকেই সে ঘুম ভাঙবে না।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও অনলাইনস জার্নাল
মন্তব্য লিখুন