আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ । তিনি তার কবিতায় প্রকৃতির এক অনন্য চিত্ররুপময়তার জগৎ সৃষ্টি করেছেন। বাংলার রূপবৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার চোখে অনন্য হয়ে ধরা দিয়েছিলো।
এদেশের নদী, মাঠ, ধানক্ষেত, লক্ষ্মীপেঁচা, শালিক ও শঙখমালাদের কবি আপন করে নিয়েছিলেন। প্রকৃতিকে তিনি খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছিলেন। তাই কবি মৃত্যুর পরেও এই বাংলায় বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন, শঙখচিল-শালিখের বেশে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী (৬ ফাল্গুন ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) বরিশাল জেলা শহরের বগুড়া রোডে জন্মগ্রহন করেন। তিনি সত্যানন্দ -কুসুমকুমারী দাশ দম্পত্তির জ্যেষ্ঠ সন্তান।
পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের পদ্মা তীরবর্তী গাউপাড়া গ্রামে।পিতা সত্যানন্দ ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ও “ব্রহ্মবাদী” পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
মাতা কুসুমকুমারী দাশ একজন স্বভাবকবি ছিলেন।তিনি বহু বিশ্রুত “আদর্শ ছেলে” কবিতার রচয়িত্রী। কবি জীবনানন্দ দাশের ডাকনাম মিলু।
কবি জীবনানন্দ দাশের শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে তার মায়ের তত্ত্বাবধানে। ১৯০৮ সালে কঠিন অসুখ হয় ছোট্ট জীবনানন্দর। প্রায় জীবন মরন সমস্যা। কুসুমকুমারী মুমূর্ষু সন্তানকে নিয়ে ঘুরেছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসে,আগ্রা গিরিডিতে।সঙ্গে ছিলেন দাদামশায় চন্দ্রনাথ।
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে প ঞ্চম শ্রেনিতে ভর্তি হন।১৯১৫ সালে বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয় হতে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
১৯১৭ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন।১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সসহ বি.এ পাস করেন।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ২য় শ্রেনিতে এম.এ পাস করেন। এম.এ এবং ল পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হার্ডিঞ্জ ছাত্রাবাসে ইথাকতেন।পরীক্ষার পূর্বে কিছুদিন “ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি” রোগে অসুস্থ ছিলেন তাই আশানুরূপ ভালো ফল করতে পারেন নি।
১৯২২ সালে কবি জীবনানন্দ দাশ সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগে টিউটর পদে কর্মজীবন শুরু করেন। এ সময় তিনি হ্যারিসন রোডে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং এ থাকতেন।
১৯২৮ সালে তিনি সিটি কলেজের চাকরী থেকে বরখাস্ত হন।জীবনানন্দ সিটি কলেজের কনিষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন।নানা কারনে সেখানে ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিলো।
স্বরস্বতী পুজাকে কেন্দ্র করে দুই দলের গোলমাল দেখা দিলে কলেজে ছাত্রসংখা কমে গিয়ে কলেজ কতৃপক্ষ অর্থনৌতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরে।একারনে তিনি চাকরীচ্যুত হন।
১৯২৯ সালে তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগদান করেন।সেখানে তিনি মাত্র কয়েকমাস অধ্যাপনা করেন।পরে তিনি কলকাতায় ফেরত আসেন।অর্থ রোজগারের প্রয়োজনে তখন তিনি গৃহশিক্ষকতা করতেন।
একই বছর ডিসেম্বরে তিনি দিল্লীর রামযশ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। মাত্র কয়েকমাস সেখানে অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি বরিশালে ফিরে আসেন।
পরবর্তী ৫ বছর তিনি বেকার ছিলেন। এরপর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন।
এবছরই জুন মাসে তিনি ব্রজমোহন কলেজের চাকরীতে ইস্তফা দেন।এসময় তিনি হুমায়ুন কবির প্রতিষ্ঠিত “স্বরাজ” পত্রিকায় রবিবাসরীয় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
সম্ভবত জুন মাসে তিনি একাজ ছেড়ে দেন।১৯৫২ সালের নভেম্বরে তিনি বরিষা কলেজে অধ্যাপনা কাজে যোগ দেন।১৯৫৩ সালে বরিষস কলেজের অধ্যাপনার কাজ থেকে চ্যুত হন।
এ বছরই জুলাই মাসে তিনি হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।ইংরেজি বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় এসময় তিনি অতিরিক্ত মাসিক ৫০ টাকা ভাতা পেতেন।
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৩০ সালের ৯ই মে খুলনা জেলার সেনহাটির রোহিনীকুমার গুপ্ত ও সরযুবালার দ্বিতীয় কন্যা শ্রীমতী লাবণ্য’র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
ঢাকার রামমোহন লাইব্রেরিতে বিবাহবাসরে বুদ্ধদেব বসু,অজিতকুমার দত্ত প্রভৃতি কবিবন্ধুরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি দুই সন্তনের জনক ছিলেন।মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ দাশ।
বৈবাহিক জীবনে তিনি অসুখী ছিলেন। এ সময় তিনি বারবার আত্মহত্যার কথা ভাবতেন।
১৯১৯ সালে ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় “বর্ষ-আবাহন” নামে প্রথম মুদ্রিত কবিতার মাধ্যমে কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যজীবনে প্রবেশ ঘটে।
১৯২৫ সালে দেশবন্ধু মিত্রের প্রয়ানে তিনি রচনা করেন “দেশবন্ধু” কবিতা। ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি ‘বঙ্গবানী’ পত্রিকায় শ্রাবন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
কবিতাটি সম্পর্কে কবি কালিদাস রায় বলেছিলেন,কবিতাটি পড়ে তার মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত কোন প্রবীন কবি ছদ্মনামে লিখেছেন। ‘ব্রহ্মবাদী‘ পত্রিকায় পরপর তিন সংখ্যায় স্বর্গীয় কালিমোহন দাশের শ্রদ্ধাবাসরে’ শীর্ষক সধুভাষায় রচিত নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
১৯২৬ সালে ‘কল্লোল‘ পত্রিকায় তৃতীয় বর্ষ একাদশ সংখ্যায় তার “নীলিমা” কবিতাটি প্রকাশিত হয়।একই বছর ‘কালিকলম” পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামের অধীনে ‘পতিতা‘ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালে প্রগতি পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে তার ‘খুশ-রোজী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এবছরই কবি জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ‘ঝরাপালক‘ কাব্যগ্রন্থে কবীর পদবীর ‘গুপ্ত শব্দটি বর্জিত হয়।
আরও পড়ুনঃ সত্যেন্দ্রনাথ বসু -গল্পে গল্পে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবন কল্প
১৯৩২ সালের মার্চ আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ‘প্রেতনীর রুপকথা’ও ‘নিরুপম ‘যাত্রা’ রচনা করেন।যা তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালের মার্চ মাসে তিনি “রুপসী বাংলা” কাব্যের কবিতাগুলো লেখেন,যা তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় তার ‘মৃত্যুর আগে‘ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।’কবিতা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় তার বহুবিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
১৯৩৬ সালে তার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ “ধুসর পান্ডুলিপি” প্রকাশিত হয়।১৯৪০ সালে ‘নিরুক্ত’ পত্রিকায় তার ‘গতিবিধি কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগে ‘ এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত “বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪৪ সালে পূর্বাশা লিমিটেড কতৃক “মহাপৃথিবী” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ পায়।
১৯৪৮ সালে তিনি ‘মাল্যবান‘ ও ‘সুতীর্থ‘ কবিতা রচনা করেন যা তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।১৯৫২ সালে সিগনেট প্রেস থেকে তার “ বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ এবং এটি ১৪৫৯ বঙ্গাব্দের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে “ নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন” কতৃক পুরস্কৃত হয়।
১৯৫৪ সালের ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সিনেট হলে কবি সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বনলতা সেন কবিতাটি পাঠ করেন।মে মাসে নাভানা প্রকাশন কতৃক “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তার অসাধারণ কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বুদ্ধদেব বসু তাকে “নির্জনতম কবি” হিসেবে উল্লেখ করে।এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবি প্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করেন।রুপসী বাংলার কবি হিসেবে কবি জীবনানন্দ দাশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেন।
১. ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থ
২. ধূসর পান্ডুলিপি
৩. রূপসী বাংলা
৪. বনলতা সেন
৫. মহাপৃথিবী
৬. সাতটি তারার তিমির
৭. বেলা অবেলা কালবেলা
এছাড়াও মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১ টি উপন্যাস ও ১২৬ টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন।
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৫২ সালে “রবীন্দ্র স্মৃতি পুরষ্কার” ও ১৯৫৫ সালে “সাহিত্য অকাদেমী পুরষ্কার” লাভ করেন।
১৯৫৪ সালের ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে কবি সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৩ই অক্টোবর বেতারে কবি সম্মেলনে “মহাজিজ্ঞাসা কবিতাটি পাঠ করেন।
১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় দেশপ্রিয় পার্কের কাছে সান্ধ্যব্রাশনের সনয় রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাম দূর্ঘটনায় গুরুতররুপে আহত হয়ে শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে ভর্তি হন।
এই দুর্ঘটনার ফলে তার পাজর, কন্ঠী ও ঊরুদেশের হাড় ভেঙে যায়। ২২শে অক্টোবর শুক্রবার (বাংলা ৫ই কার্তিক ১৩৬১) রাত ১১ঃ৩৫ মিনিটে তিনি ওই হাসপাতালে মৃত্যুবরন করেন।
পরের দিন এক নাতিদীর্ঘ শোকযাত্রাসহ মরদেহ কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশ তার জীবদ্দশায় যে অমর কীর্তি রচনা করেছেন, তা চিরকাল তাকে পাঠক হৃদয়ে বাচিয়ে রাখবে অসীম ভালোবাসায়। রূপসী বাংলার কবি হিসেবে তিনি বেচে থাকবেন অনন্তকাল।
মন্তব্য লিখুন