ভালো অভিনেতা হবার জন্য যে সবসময়ই নায়ক হিসেবে পর্দায় হাজির হবার প্রয়োজন হয় না সেটা অনেক অভিনেতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাদেরই একজন হলো জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা “ইরফান খান”। বলিউডের প্রচলিত রোমান্টিক হিরো অথবা অ্যাকশন হিরোর তকমা না পেলেও অভিনয়ের জন্য অভিনেতার রাজমুকুট কিন্তু তার দখলেই ছিলো। অভিনয় জীবনের শুরুতেই নায়ক হতে না পারলেও পূর্ণমাত্রায় অভিনেতা হতে পেরেছিলেন তিনি । পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “পদ্মশ্রী”।
ইরফান খানের পূর্ণ নাম “সাহেবজাদা ইরফান আলী খান”। ১৯৬৭ সালের ৭ই জানুয়ারি রাজস্থানের টঙ্ক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম জাগিরদার খান এবং মাতার নাম বেগম খান।ইরফান খানের মায়ের পরিবারের সাথে রাজপরিবারের সম্পর্ক ছিল। ইরফান খানের বাবা ছিলেন একজন টায়ারের ব্যবসায়ী।
ইরফান খান তার নাম থেকে পরিবারের গৌরবময় পরিচায়ক ‘সাহেবজাদা’ অংশটি অনেক পূর্বেই পরিত্যাগ করেন। কারণ তার ধারণা ছিলো রাজকীয় পরিবারের পরিচয় তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
️অভিনয়ের এই মহান জাদুকর কিন্তু ছোটবেলা থেকেই অভিনেতা হতে চায়নি, চেয়েছিলেন ক্রিকেটার হতে। বহু ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও ম্যাচে অংশ নিয়েছেন তিনি। ভারতের সুপরিচিত সিকে নায়ুডু টুর্নামেন্টে অনুর্ধ্ব ২৩ দলের জন্য সিলেক্ট হয়েছিলেন ইরফান খান। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে তিনি এই দলে খেলতে পারেননি।
খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় তিনি অভিনয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ১৯৮৪ সালে নয়া দিল্লির (এন এস ডি) ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি পায়।
ইরফান খান অভিনয়ের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন যে, এন.এস.ডি তে বৃত্তির জন্য আবেদন করার সময় মিথ্যা তথ্য দেন যে, “তার থিয়েটারের অভিজ্ঞতা আছে”, যেন তাকে বৃত্তি দেয়া হয়।
১৯৮৭ সালে এন.এস.ডি থেকে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করেন। ডিগ্রি শেষে ইরফান খান সোজা মুম্বাইয়ে চলে আসেন অভিনেতা হবার আশায়। পরের বছর ১৯৮৮ সালেই বলিউডে তার অভিষেক ঘটে মিরা নায়ার পরিচালিত “সালাম বম্বে” সিনেমায় খুব ছোট একটা চরিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে চুড়ান্ত কাটে তার অভিনীত দৃশ্যগুলো জায়গা পায়নি। তারপর, বছরের পর বছর শুধু অপেক্ষা করে ছিলেন সুযোগের আশায়। এরমধ্যে টিভি সিরিয়াল ও সিনেমায় ছোট ছোট চরিত্রে কম বেতনে অভিনয় করে গেছেন শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য। তবু তিনি হাল ছাড়েননি।
তার অভিনীত সিরিয়াল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- চাণক্য, চন্দ্রকান্তা, ভারত এক খোঁজ, সারা জাহাঁ হামারা ইত্যাদি। এই সকল সিরিয়ালে তার অভিনয় অনেক দর্শক ও ফিল্ম মেকারদের চোখে পড়ে।
অবশেষে ২০০১ সালে সুযোগ আসে নিজেকে প্রমাণ করার। ব্রিটিশ-ভারতীয় সিনেমা “দ্য ওয়ারিয়র”এ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান ইরফান খান।
তারপর আরো কিছু সিনেমায় কাজ করে ব্যর্থ হয়ে “হাসিল“(২০০৩) এবং “মকবুল” (২০০৪) চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করেন এবং বেশ প্রসংশিত হন তিনি। এমনকি “হাসিল” সিনেমায় খল চরিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ খল অভিনয়শিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৫ সালে রোগ সিনেমায় প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ করেন ইরফান খান। এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। ২০০৭ সালের “লাইফ ইন এ মেট্রো” সিনেমাটি ইরফান খানের জন্য খুবই সৌভাগ্যজনক ছিলো। এই চলচ্চিত্রটির সফলতা ইরফানের অভিনয় জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সহ আরো বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেন।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক ভালো সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন তিনি। “পান সিং তোমার” (২০১১), “লাঞ্চবক্স”(২০১৩), “হায়দার” (২০১৪), “পিকু”(২০১৫),”ব্লাকমেইল” (২০১৮) ইত্যাদি। ইরফান খান অভিনীত সর্বোচ্চ ব্যবসা সফল হিন্দি সিনেমা হলো কমেডিড্রামা “হিন্দি মিডিয়াম” (২০১৭)।
এই সিনেমাটি ভারত ও চীনে স্লিপার হিট তকমা লাভ করে। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ আরো কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেন। ঐ একই বছরে তিনি বাংলাদেশী সিনেমা নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ডুব” নো বেড অফ রোজেস সিনেমায় কাজ করেন। যা তাকে বাংলাদেশী ভক্তদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। ইরফান খান অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা হলো “আংরেজি মিডিয়াম” (২০২০)।
ইরফান খান শুধু মাত্র বলিউডেই নয় হলিউডে ও তার বেশ খ্যাতি ছিলো। হলিউডের কিছু নামকরা সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ (২০০৯), দ্যা অ্যামেজিং স্পাইডার- ম্যান (২০১২), লাইফ অব পাই (২০১২), জুরাসিক পার্ক (২০১৫), ইনফার্নো (২০১৬) ইত্যাদি।
এছাড়াও কিছু আন্তর্জাতিক সিনেমা যেমন, “দ্য ওয়ারিয়র” (২০০১), “দ্য নেমসেক” (২০০৬), ” স্লাম ডগ মিলিয়নিয়ার” (২০০৯),এ মাইটি হার্ট, দ্য দার্জিলিং লিমিটেড ইত্যাদি সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে কোটি দর্শকের মন জয় করেছেন তিনি ।বলিউডের অনেক অভিনেতাই হলিউডে কাজ করেছেন কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ইরফান খানের মত সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে খুব কম সংখ্যক অভিনেতা। ২০১১ সালে ভারত সরকার ইরফান খানকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “পদ্মশ্রী” প্রদান করে।
একজন অভিনেতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো তার কাজের প্রশংসা পাওয়া। এদিক থেকে ইরফান খান সবসময় এগিয়ে ছিলো। বলিউড এবং হলিউড উভয় স্থানেই তার অভিনয়ের প্রশংসা পেয়েছেন তিনি।তিনি তার অভিনয়ের প্রশংসার সাথেহ সাথে তার চোখের প্রশংসা ও কুড়িয়েছেন।
রোগ সিনেমায় তার অভিনয় দেখে স্ম্যাশহিটস প্রশংসা করে বলেন, “ইরফানের চোখ তার শব্দের চেয়ে জোড়ে কথা বলে এবং যতক্ষন তাকে পর্দায় দেখা যায় সে তার অভিনয়ের নৈপুন্য দেখাতে থাকেন“।
স্লাম ডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমার পরিচালক ড্যানি বয়েল তার সম্পর্কে বলেন, ” কোনো চরিত্রের নৈতিক কেন্দ্রবিন্দু খোঁজা ইরফান খানের সহজাত কৌশল এবং তিনি সেই সকল অ্যাথলেটদের মত যারা একই কাজ সঠিকভাবে বারবার করতে পারেন”।
ব্যাক্তিগত জীবনে ইরফান খান ছিলো বেশ লাজুক এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সে তার লক্ষ্যে সবসময় স্থির থাকতো। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও ভীষণ সৌখিন ছিলো সে। শুধুমাত্র রোমান্টিক সিনেমা অথবা অ্যাকশন সিনেমায় নিজেকে বেধে রাখেনি ইরফান খান। যেখানেই অভিনয়ের ভিন্নতা পেয়েছেন সেখানেই কাজ করেছেন তিনি। তাইতো কখনো নায়ক,কখনো ভিলেন,কখনো ক্রীড়াবিদ আবার কখনোবা কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইরফান খান।
১৯৯৫ সালে ইরফান খান তার এন এস ডি’র সহপাঠী সুতপা সিকদারকে বিয়ে করেন। ইরফান ও সুতপা দম্পতির দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে।
সিনেমার যেসব চরিত্র মানুষের ধর্ম বা সংস্কৃতিতে আঘাত করে সেসব চরিত্রে কাজ করতেন না ইরফান খান। যেমন দীপা মেহতার ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ এবং মিরা নায়ারের ‘রিলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট।
২০১২ সালে ইরফান খান তার নামের ইংরেজি বানানে একটি অতিরিক্ত (r) যুক্ত করেন,ফলে তার নাম Irrfan এ পরিবর্তিত হয়। নিজের নাম থেকে পারিবারিক পদবি সাহেবজাদা তো আগেই বাদ দিয়েছিলেন, ২০১৬ সালে নিজের নাম থেকে খান অংশটি ও বাদ দেন। এ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে,”আমি চাই আমার কাজের জন্য লোক আমাকে মনে রাখুক, আমার নামের জন্য না”
গুনী এই অভিনেতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পরেছেন। মহররমের সময় পশু কোরবানির সমালোচনা করতে গিয়ে ইসলামিক নেতাদের রোষানলেও পড়েন একসময়।এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে, “আমরা এসব রীতি পালন করি এর পেছনের অর্থ না জেনেই।” এছাড়াও তিনি যে সকল সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলোতো কাজ করেছেন তা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় অনেক সমালোচনার স্বীকার হয়েছিলেন।
হিন্দি মিডিয়াম সিনেমার সাফল্যের পর যখন ইরফান খান সকলের প্রশংসায় ভাসছিলেন,তখনই ২০১৮ সালে তার দেহে নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার শনাক্ত হয়। যা রক্তে হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে ইরফান কে দূর্বল করে ফেলছিলো।
অসুস্থতার জন্য লন্ডনে ১ বছর চিকিৎসা নিয়ে ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসেন ইরফান খান। দেশেই চলতে থাকে তার চিকিৎসা। এর মধ্যে ২০২০ সনে আংরেজি মিডিয়াম সিনেমার কাজ শেষ করেন তিনি। হঠাৎ বেশি অসুস্থ হওয়ায় ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল ভারতের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরের দিন ২৯ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে অজস্র ভক্তকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেয় ইরফান খান।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও ভক্তরা হয়তো আর ইরফান খানের নতুন সিনেমা দেখতে পাবে না। কিন্তু তিনি যেসকল সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন সেগুলো তাকে তার ভক্তদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।
২০২১ সালের ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র পুরস্কার(মরনত্তর) লাভ করেন তিনি। তার পুত্র বাবিল খান বাবার হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করে। এছাড়াও লাইফ টাইম এচিভমেন্ট সম্মাননা প্রদান করা হয় ইরফান খান কে
মন্তব্য লিখুন