আজকের যুগে এসে অনেকই হয়তো ভাবতে পারেন যে আমরা এই মহাবিশ্বের প্রায় সব কিছুই জেনে ফেলেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান বলে এই প্রকৃতি “এক রহস্যের সমুদ্র” আর আমরা বড়জোর তার এক ফোঁটার সমাধান পেয়েছি। প্রকৃতি জুড়ে এমন অনেক রহস্যই এখনো রয়ে গেছে যা এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও সমাধান করা সম্ভব হয় নি। এমনই একটি রহস্য রয়েছে আমাদের দেশের দক্ষিনাঞ্চলে, যা সারা বিশ্বে ‘বরিশাল গানস’ বা, ‘দ্যা গানস অফ বরিশাল’ নামে খ্যাত। অপরূপ প্রাকৃ্তিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি এই দক্ষিন বঙ্গের একটি অমীংসিত রহস্য এই বরিশাল গানস, যা এই অঞ্চলকে করে তুলেছে সারা বিশ্বের কাছে রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু!
সর্বপ্রথম বরিশাল গানসের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় সম্ভবত ১৮৭৬ সালে, একজন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রকাশিত বই ‘ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ’ থেকে। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে তখন বাংলাদেশসহ পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশদের দখলে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান যে সে সময় খুব উন্নত ছিল না তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি চলমান ছিল বিভিন্ন ধরনের বিদ্রোহ। ফলে অশিক্ষা ও কুসংস্কার ছিল এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী।
এরকমই এক সময়কার কথা। বর্ষা আসতে তখনো বেশ দেরি। একদিন হঠাৎ পুরো বরিশাল অঞ্চলের মানুষ সচকিত হয়ে উঠল এক বিকট কান ফাটানো শব্দে। কোথা থেকে এই শব্দ হলো কেউ জানে না। গগনবিদারী সেই শব্দ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিল। কারন সে সময় বড় বড় যুদ্ধে কামান ব্যবহার করা হতো। এ শব্দ তাদের কামানের কথাই মনে করিয়ে দিল। কিন্তু আশেপাশে অনেক খোঁজ নিয়েও কোথাও কোনো যুদ্ধের সংবাদ না পেয়ে অবশেষে সবাই একটু আশ্বস্ত হল।
এরপর দিন বরিশাল অঞ্চল যখন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, মানুষ আবার যখন অন্য সব দিনের মতোই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তখন পুনরায় ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে। আগের দিনের মতো প্রায় একই সময়ে আবারো বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে কামান দাগার মতো আওয়াজ হয়। এবার একবার নয় বেশ কয়েকবার। এঘটনায় চারিদিকে সারা পড়ে গেল। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা চারিদিকে এর উৎস জানার জন্য হন্যে হয়ে খোঁজ করতে লাগলেন।
সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যুরা মাঝে মাঝেই সমুদ্র পথে আক্রমন করে বসতো। সোনা যা্ পর্তুগিজরা নাকি বঙ্গোপসাগর থেকে নদীতে আসার জন্য একটা খাল খনন করেছিল। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় পটুয়াখালী। যাই হোক, বঙ্গোপসাগরে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো কোনো শত্রু জাহাজ আছে নাকি। কিন্তু না, কোথাও সেরকম কিছুর খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন কিছু মানুষের কাছে জানা যায় বহু বছর পূর্বে তাদের পূর্বপুরুষে্রাও নাকি এধরনের ঘটনার সাক্ষী ছিলেন এবং এ অঞ্চলে এটি ‘বরিশাল কামান’ নামে পরিচিত। তবে সেই শব্দের উৎস কেউই জানেন না। আর সেই থেকেই শুরু হয় এই শব্দের উৎসের সন্ধানে নানা রকমের গবেষণা।
‘বরিশাল গানস’ এর সেই প্রচন্ড শব্দের উৎস যে আসলে কি তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। হেনরি বেভারিজ নামের সেই ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটই প্রথম তার বই ‘ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ’এ ‘গানস অব বরিশাল’ নামটি ব্যবহার করেন। তার সেই বই থেকে জানা যায় ফেব্রুয়ারী থেকে অক্টোবর মাসে বরিশাল থেকে দক্ষিনে বা দক্ষিন পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে কামান দাগানোর মতো আওয়াজ শোনা যেত। কখনো একবার আবার কখনো বা একসাথে একাধিকবার সমুদ্র থেকে এই শব্দ শোনা যেত।
বাটারফ্লাই ইফেক্ট: ক্ষুদ্র পরিবর্তনের বৃহদাকার প্রভাব
বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ সম্পর্কে জানুন
ইতিহাসের পাতায় ‘আন্টাঘর ময়দান’ থেকে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’
এই শব্দের উল্লেখ আরেকজন বিশেষ ব্যক্তির আত্মজীবনীতেও আমরা দেখতে পাই। নারীজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ সাহিত্যিক সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন ২০ জুন, ১৯১১ সালে বরিশালের শায়েস্তাবাদে, তার মামারবাড়িতে। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘একালে আমাদের কাল’এ উল্লেখ করেন যে শৈশবে বয়স্কদের মুখে এই অঞ্চলে এরকম অদ্ভুত আওয়াজের কথা তিনি অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু তিনি এটাও লিখেছেন ১৯৫০ সালের পর এখানে আর এমন শব্দ শোনা যায় নি।
‘বরিশাল গানস’ নিয়ে অনেক রকম মত রয়েছে কিন্তু কোনোটিকেই এখনো একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায় নি। প্রথমে অনেকে এটিকে জলদস্যুদের কামানের আওয়াজ মনে করলেও সমুদ্রে অনেক খোজাখুজির পর এই ধারণা একেবারে ভেঙ্গে যায়। পরে ব্রিটিশ ভূবিজ্ঞানীদের ধারণা হয় বঙ্গোপসাগরের গভীরে হয়তো কোনো আগ্নেয়গিরি রয়েছে। কিন্তু এটিও পরে ভুল প্রমানিত হয়।
আরেক বিজ্ঞানী দলের মতে এই অঞ্চলের সাগরতীরে হয়তো কোনো বৃহৎ মৃত গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে, যার শব্দ এটি। কিন্তু উক্ত স্থানে কোনো গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এছাড়া ভূঅভ্যন্তরস্থ ট্যাকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলেও এটি হতে পারে বলে একটা ধারণা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সাথে সুনামি ও ভূমিকম্প হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এগুলো না থাকায় এটিও সম্ভাবনা থেকে বাদ পড়ে যায়।
আরেকটি ধারণা অনুযায়ী কুয়াকাটা, কলাপাড়া, আর মঠবাড়িয়ার সংযোগস্থল একস্থানে সাগরের সাথে যুক্ত। সেখানে একসময় জোয়ারে প্রচন্ড পানি বাড়ত। এই জোয়ারের স্রোতকেই অনেকে শব্দের উৎস বলে মনে করেন। পরবর্তীতে ওই স্থান পলি জমে অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারেও আগের মতো আর পানির স্রোত আসে না।
১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী বরিশাল, নোয়াখালী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ সহ প্রভৃতি স্থানে বরিশাল গানস এর মতোই শব্দ শোনা গিয়েছে। ১৮৯০ সালের ‘ব্রিটিশ এসোসিয়েশন অব এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’ এর একটি বার্ষিক অধিবেশনে উল্লেখ করা হয়, ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপেও কয়েকবার এধরনের শব্দ শোনা গিয়েছে। বর্তমানে কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে এ ঘটনাকে ‘মিসপুফার্স’ বা ‘স্কাই কোয়াক’ বলে। বরিশালের মতোই ভারতের গঙ্গা নদী, হিমাচল প্রদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ আরো বেশ কিছু দেশে এরকম শব্দের কথা নথিবদ্ধ আছে। সাম্প্রতিক কালে জাভা দ্বীপে এধরনের শব্দ শোনা গেছে বলে জানা যায়।
বরিশাল অঞ্চলের অতীতে শোনা এই অদ্ভুত শব্দের উৎপত্তি নিয়ে এখনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু এই রহস্য আমাদের বিপুল সমৃদ্ধ জলরাশির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।অনেকেই হয়তো জানেন না যে ‘দি গানস অব বরিশাল’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইন্সট্রুমেন্টাল ব্যান্ড দল রয়েছে।যদিও এই অমীমাংসিত রহস্যের এখনো কোনো কার্যকর সমাধানের পাওয়া যায় নি, তবু বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানমহলে আজও চর্চিত হচ্ছে এই ‘বরিশাল গানস’।
মন্তব্য লিখুন