অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। রুপে অপূর্বা, নদীমাতৃক এ বাংলার লোক বহমান কীর্তনখোলার তীরবর্তী এক জনপদের নাম বরিশাল। যার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অনন্যতা। বলা হয়ে থাকে, “ধান, নদী, খাল, এই তিনে বরিশাল”।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
বরিশালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর নাম পূর্বে চন্দ্রদ্বীপ, বাকলা ও বাকেরগঞ্জ নামেও পরিচিত ছিল। মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের আমলে রাজা দনুজমুর্দন কর্তৃক চদ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে এ অঞ্চলের নাম ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল।
‘বাকলা’ বলতে বোঝায় শস্য ব্যবসায়ীদের যা আরবি শব্দ হতে আগত। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত অঞ্চলটি ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। ড.কানুনগো নামে এক ব্যক্তি ‘বাকলা’ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে আরব ও পারস্য বণিকরা ব্যাবসা করতো।১৭৯৬ সাল পর্যন্ত এ জেলা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।
১৭৯৭ সালে ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮০১ সালে জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে( গিরদে বন্দর) স্থাপন করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১লা জানুয়ারি বরিশালকে বিভাগ ঘোষণা করা হয়।
বরিশাল নামটি কি করে হলো তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে।কারও মতে,বড় বড় শাল গাছের কারণে এ অঞ্চলের নাম বরিশাল রাখা হয়। কারও ধারণা, এখানে থাকা বড় বড় লবণের গোলার কারণে বরিশাল বলা হয়েছে। পর্তুগিজ বেরী ও শেলীর প্রেমকাহিনী থেকেও এ নামকরণ হয়েছে বলে কারো কারও মত রয়েছে।
গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। লবণের বড় বড় চৌকি আর বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগিজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট’ বলতো। সেখান থেকে নাম পরিবর্তন করে বরিশাল হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
নদীবেষ্টিত এই বরিশাল একসময় “এগ্রিকালচারাল ম্যানচেষ্টার” হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকাল থেকে পলি গঠিত উর্বর এ অঞ্চল কৃষিকাজের জন্য উৎকৃষ্ট ও বসবাসের জন্য উপযুক্ত। দেশের অর্থনৈতিক চাহিদার সিংহভাগ পূ্রণ হতো এখান থেকে। ১৮৫০ সালে পর্যটক রালফ ফিস বাকলাকে অত্যন্ত সম্পদশালী হিসেবে আখ্যায়িত করে এখানকার প্রচুর চাল,রেশম,কার্পাস ও সর্ববৃহৎ ঘরের কথা উল্লেখ করেন।
এ কারণেই এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করে আসছে। আরব বণিকরা সাগরপথে এখানে ব্যাবসা করতে আসে। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের ন্যায় সেকালে এ ভূখন্ডটি ছিল বিশ্ববাসীর অন্যতম লোভনীয় অঞ্চল।
এই বরিশালে এসে এখানকার খাল ও নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একে ইতালির ভেনিস শহরের সাথে তুলনা করে “প্রাচ্যের ভেনিস” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ সম্পর্কে জানুন
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে রয়েছে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের কাহিনী। সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব এই বরিশালে জন্মগ্রহণ করেছেন।
বাংলার বাঘ হিসেবে খ্যাত শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, অশ্বিনী কুমার দত্ত,কবি আসাদ চৌধুরী, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, লেখক গাফফার চৌধুরী,মধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্ত, রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, সাংবাদিক মানিক মিয়ার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা বরিশালে জন্মগ্রহণ করেছেন।
শুধু পুরুষ নয়, এখানের নারীদেরও কীর্তিও কম নয়। কবি সুফিয়া কামাল, কামিনী রায়, কুসুম কুমারী দাশের মতো নারীদের জন্ম এই বরিশালেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশাল ২ নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত ছিল যার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এমএ জলিল। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত ৭ জনের ২ জনই(বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল) বরিশালের।
শুধু তাই নয়, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, হানিফ সংকেত, অভিনেতা মোশাররফ করিম, সুচন্দা, রুবেল, তানিয়া আহমেদ, মিঠুন চক্রবর্তী ,কন্সঠশিল্পহ জুয়েহ, নচিকেতা সহ বহু গুণিজন এই বরিশালে জন্মগ্রহণ করেছেন।
নদীবেষ্টিত বরিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহজেই ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান যার মধ্যে রয়েছে:
কেউ যদি সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বরিশালে আসতে হবে। বরিশালের কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপালি ইউনিয়নে রয়েছে এই সমুদ্র সৈকত। এখানকার পরিচ্ছন্ন বেলাভূমি,অথৈ জলরাশি, একের পর এক ঢেউয়ের তীরে আছড়ে পড়া, সারি সারি ঝাউ গাছ সবমিলিয়ে যেন এক অন্যরকম প্রশান্তির খোঁজ মেলে এখানে। শুধু সমুদ্র সৈকত নয়, এখানে রয়েছে রাখাইন পল্লী, কুয়া, কাউয়ার চর, চর গঙ্গামতী,রুপালী দ্বীপ সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ দিঘি হচ্ছে দূর্গাসাগর দিঘি। যা বরিশাল শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে স্বরুপকাঠী-বরিশাল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। প্রায় ২৭ একর আয়তনের এ দীঘির মাঝখানে রয়েছে ছোট একটি দ্বীপ যেখানে শীতকালে নানা অতিথি পাখি দেখা যায়। এই দীঘির পাশে একটি পার্ক ও রয়েছে। এটিও সৌন্দর্যপিপাসুদের জন্য একটি চমৎকার স্থান।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামে প্রায় ২০০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ শাপলার রাজ্য। এখানের বিলে ফোটে লাল,সাদা ও বেগুনি রংয়ের শাপলা। বিলে ফোঁটা এ শাপলার সৌন্দর্য দেখে মনে হয় এ যেন কোনো রূপকথার রাজ্য। এই বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন স্থানের দর্শনার্থীরা এখানে ছুটে আসেন।
ভাসমান পেয়ারা বাজারের কথা শুনলেই সাধারণত থাইল্যান্ড, ইতালি বা ভারতের পানির উপরে ভেসে ওঠা কোন বাজারের দৃশ্য ভেসে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশেও এমন একটি অসাধারণ স্থান রয়েছে। এ বাজারটি গড়ে উঠেছে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির সীমান্তবর্তী মিলনস্থলে।
এখানে আঁকাবাঁকা খালের ওপর ভাসমান নৌকায় পেয়ারা কেনাবেচা চলে। অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হচ্ছে এই ভিন্নধর্মী বাজার থেকে। দর্শনার্থীরা এখানে ঘুরে তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আরো সমৃদ্ধ করতে পারেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জমিদারি প্রথা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বরিশাল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে লাকুটিয়া গ্রামে ১৭০০ সালে রূপচন্দ্র রায়ের পুত্র রাজতন্ত্র রায়ের হাত ধরে ইট,পাথর আর সুড়কির গাথুনিতে গড়ে উঠেছে ৩০০ বছরের পুরনো লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। এখানে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন মঠ, সুবিশাল দীঘি,মাঠ ও জমিদার বাড়ি।এখানের বৃহৎ পরিবেশে ঘুরে পরিচিত হওয়া যায় ইতিহাসের নানা বিষয়ের সাথে।
এতোদিনের রেললাইন বিহীন এই বরিশালে রেললাইন স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু ও পটুয়াখালীর পায়রা নদীতে স্থাপিত ৩য় সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে দেশের এ দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার সিঙ্গাপুরের মতো সক্ষম হচ্ছে। ২য় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বরিশালের হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরনদী ইউনিয়নের মেঘের চর নামক এলাকায়। সে হিসেবে বলা যায়, বরিশাল অচিরেই হতে যাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় ‘সিঙ্গাপুর’ শহর।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন