পৃথিবীর অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি সভ্যতা হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতা। নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা মিশর এর -এ সভ্যতায় রয়েছে আশ্চর্যজনক স্থাপনা, বিচিত্র সংস্কৃতি এবং রহস্যময় নানান বিশ্বাস ও আচার আচরণ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে মিশরীয় সভ্যতা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন একটি সভ্যতা যার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। তবে প্রথমবারের মত মিশর এর প্রাচীন সভ্যতার কথা জানা যায় হায়ারোগ্লিফিক্স লিপির পাঠোদ্ধার করার পর। রোজেটা স্টোন আবিষ্কারের পর এর সাহায্যে হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে সক্ষম হন গবেষকরা।
মিশরের শাসকদের বলা হয় ফারাও যার অর্থ শাসক বা রাজা। ৩১৫০ খ্রীস্টপূর্বে এখানকার প্রথম রাজবংশ এবং মিশরের প্রথম ফারাও “নার্মার” এর কথা জানা যায়। ৩৩২ খ্রীস্টপূর্বে সম্রাট আলেকজান্ডার মিশর দখল করে নেন।
পরবর্তীতে ৩০ খ্রীস্টপূর্বে রোম সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় মিশর । দীর্ঘদিন রোমের শাসনামলের পর মুসলমানদের শাসনামল শুরু হয়। বেশ কয়েকজন খলিফা একে একে মিশর শাসন করেন ৬৩২ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত।
এরপর ১৫১৭ সালেই সম্রাট সেলিম মিশরে প্রতিষ্ঠা করেন অটোমান সাম্রাজ্য। ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। মাঝে অল্প কয়েক বছর (১৭৯৮-১৮০১) ফ্রান্স মিশর শাসন করে।
অতঃপর ১৮৮২ সালে ব্রিটিশরা মিশর দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে বিপ্লবের ঘটনার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় “কিংডম অব ইজিপ্ট।”
যদিও মিশর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ছিল। ১৯৫৪ সালে অ্যাংলো-ইজিপ্শিয়ান প্রস্তাবনার পর ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
এরপর ২৫০০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত মিশর সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৫৬ সালে। দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট আবদেল নাসের ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।
পরবর্তীতে হোসনি মুবারক ৩০ সাল পর্যন্ত মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০১১ সালের বিপ্লবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পর সেখানকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মরসি।
মিশরের শাসক অর্থাৎ রাজাদের বলা হয় ফারাও। তখনকার মানুষ বিশ্বাস করতো তাদের ফারাওরা সাধারণ মানুষ নন। তারা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত।
সেকারণে তাদের ধারণা ছিল মৃত্যুর পরও ফারাওদের পবিত্রতা বজায় থাকে। তাই কোন রাজার মৃত্যু হলে তার দেহকে মমিতে রূপান্তর করা হত। আর তাদের সমাধিস্থল হিসেবে তৈরি সেসব স্থাপনাকেই আমরা পিরামিড হিসেবে চিনি।
প্রতিটি শবদেহের সাথে তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় নানান উপাদান দিয়ে দেয়া হত এসব সমাধিতে।
২৯৫০ খ্রীস্টপূর্বে একটি রাজকীয় শবদেহ আবিষ্কৃত হয় যা পাথরের তৈরি একটি স্থাপনায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় সেটিই পিরামিডের প্রাচীন রূপ। এসকল স্থাপনাকে বলা হয় “মাস্তাবা”।
সবচেয়ে পুরনো পিরামিড পাওয়া যায় সাক্কারে। ২৬৩০ খ্রীস্টপূর্বের কাছাকাছি সময়ে তৈরি এ পিরামিডকে বলা হয় “স্টেপ” পিরামিড।
এধরনের পিরামিডগুলো সাধারণত ৬ স্তর বিশিষ্ট পাথরের তৈরি হয়। সর্বাধিক প্রাচীন এ পিরামিডের উচ্চতা ৬২ মিটার। তবে প্রকৃত সমাধির মত করে তৈরি প্রথম পিরামিড বলা হয় “রেড” পিরামিডকে।
এটি চতুর্থ রাজবংশের প্রথম রাজার শবদেহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
সবচেয়ে পরিচিত পিরামিড বলা হয় গিজার পিরামিডগুলোকে। নীলনদের পশ্চিমে কায়রোর উপকন্ঠে এর অবস্থান। প্রধান তিনটি পিরামিড ও বেশকিছু ছোট পিরামিড নিয়ে এটি গঠিত।
প্রধান এবং সবচেয়ে দীর্ঘ পিরামিডটির নাম Great Pyramid যার উচ্চতা ১৪৭ মিটার। চতুর্থ রাজবংশের অষ্টম রাজা Khufu’র সমাধি হিসেবে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
গ্রেট পিরামিডের পাশে আরও তিনটি ছোট পিরামিড রয়েছে রাণীদের জন্য। অবশিষ্ট দুটি পিরামিড রাজা Khufu’র ছেলে ও পৌত্রের সমাধিস্থল।
এক গ্রিক পন্ডিতের মতে এই গ্রেট পিরামিড তৈরিতে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন পাথর খন্ড এবং ১০০,০০০ মানুষের শ্রমের প্রয়োজন হয়েছিল।
যদিও ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা ২০,০০০ মানুষ প্রয়োজন হয়েছিল এটি তৈরিতে। গ্রেট পিরামিডই পৃথবীর একমাত্র প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য যা এখনও অক্ষত আছে।
২০০৮ এর নভেম্বরের একটি জরিপে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত মিশরে আবিষ্কৃত মোট পিরামিডের সংখ্যা ১১৮। Pyramid of Djedefre, Pyramid of Sahure, Pyramid of Amenemhet, Piye’s Pyramid মিশরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পিরামিড।
কয়েকজন ফারাও এর মমির জন্য মিশর বেশ আলোচিত। বিভিন্ন পিরামিডে পাওয়া এসব মমি অনেক সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। সেরকমই আলোচিত একটি মমি তুতেনখামেনের মমি।
মাত্র ৯ বছর বয়সে ক্ষমতায় অসীন হওয়া এই ফারাও ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার মৃত্যু এবং মমি উভয় নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। ১৯২২ সালে Howard Carter এর নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয় তুতেনখামেনের মমি।
দলটির সদস্য Lord Carnarvon আবিষ্কারের কিছুদিনের মধ্যে মশার কামড় থেকে সৃষ্ট ইনফেকশনে মারা গেলে মমির অভিশাপে মৃত্যু হয়েছে বলে অনেকে দাবি করে।
আরও পড়ুনঃ জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ “তিন গোয়েন্দা” এর ৩৫ বছর
আরেকটি আলোচিত মমি রাজা দ্বিতীয় রামেসিসের মমি। ৬০ বছর ক্ষমতায় থাকা এই ফারাও ৯০ বছর বয়সে মারা যান। তার মমিটি বর্তমানে কায়রো জাদুঘরে রয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মমির অভিশাপের নানান কাহিনী শোনা যায়। যদিও নির্ভরযোগ্য কোন প্রমাণ নেই এসব ঘটনার। Ginger, Vladimir Lenin, Rosalia Lombardo উল্লেখযোগ্য কিছু মমি।
পৃথিবীর অতি প্রাচীন এ সভ্যতার ইতিহাস অত্যন্ত বিচিত্র এবং বিস্তৃত। প্রায় সারাবছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এ দেশের সমৃদ্ধ সভ্যতা দেখার জন্য।
২০১৮ সালে মিশরে প্রায় ৯ মিলিয়ন পর্যটকদের ভ্রমণ করার তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন ট্যুরিজম সাইট থেকে। প্রাচীন স্থাপনা ও রহস্যে ঘেরা এ দেশটি প্রাচীন সভ্যতায় আগ্রহী ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য একটি অভাবনীয় স্থান।
মন্তব্য লিখুন