পৃথিবীতে ভূত বা অশরীরী অস্তিত্বের প্রমাণ থাক বা না থাক, মানুষের মনে এসব ব্যাপারে রয়েছে সীমাহীন কৌতূহল। বিভিন্ন স্থানকে বিভিন্ন সময়ে ভূতুড়ে বলে অভিহিত করা হয়ছে। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভের আশায় সেসব স্থানকে ঘিরে থাকে মানুষের তুমুল আগ্রহ। এমনই এক স্থান ইতালির দ্বীপ পোভেগ্লিয়া; যার রয়েছে একটি চমকপ্রদ ইতিহাস।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
১৭ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এ ভূতুড়ে দ্বীপটি উত্তর ইতালির ভেনিস এবং লিডো এর মাঝে অবস্থিত। লেগুন সেইন্ট মার্ক্স চত্বরে অবস্থিত ছোট এ দ্বীপ ভেনিস হতে তিন মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। একটি খাল একে দুইভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। একে পোভেগ্লিয়া ভেনিস এবং ইজোলা দি পোভেগ্লিয়া নামেও ডাকা হয়।
৪২১ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম বসতি গড়ে ওঠার তথ্য পাওয়া যায়। নবম শতকের দিকে এখানকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় পোভেগ্লিয়া পোদেস্টা শাসনের অধীনে ছিল। ১৩৭৯ সালে ভেনিস এবং জেনিসের অধিবাসীদের মধ্যে এ দ্বীপের দখল নিয়ে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
যুদ্ধে ভেনিস জয়ী হলে সরকার দ্বীপটির নিরাপত্তার স্বার্থে এর প্রবেশদ্বারে সৈন্য নিয়োগ এবং চারপাশে খাল খনন করে। কিন্তু যুদ্ধের সময় এখানকার অধিবাসীদের Giudecca নামে এক শহরে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ দ্বীপটি জনশূন্য হয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক শতকেও যা জনমানবহীন থাকে।
১৫২৭ সালে ইতালির এক সাধু গোত্রকে যারা Camaldolese Monks বলে পরিচিত, পোভেগ্লিয়ায় থাকার জন্য অনুরোধ করা হয় যা তারা প্রত্যাখান করে। ১৬৪৫ সাল থেকে ভেনিস সরকার দ্বীপটির সম্মুখে পাঁচটি অষ্টভুজাকৃতির দুর্গ নির্মাণ করে।
পোভেগ্লিয়া অক্টাগন নামে এ দুর্গ পৃথিবীতে থাকা চারটি অক্টাভুজের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে ১৭৭৬ সালে দ্বীপটি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে চলে গেলে এখানে একটি চেক পয়েন্ট গঠন করা যায়। এটি ব্যবহৃত হত ভেনিসগামী জাহাজগুলোর মালামাল পরিদর্শন করে পাঠানোর কাজে।
১৭৯৩ সালে দুটি জাহাজে কয়েকজন বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে এ দ্বীপটিকে সাময়িক ভাবে ইতালির বিভিন্ন শহরে প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে এ ব্যবস্থাকে স্থায়ী করে দেয়া হয় ১৮০৫ সালে। তখন নেপোলিয়ন বোনাপার্তের অধীনে এ সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের এ দ্বীপেই সমাধিস্থ করা হত। ১৮১৪ সালে এ ব্যবস্থাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
দ্বীপে ছিল ১১টি ভবন বা কাঠামো যার অন্তর্ভুক্ত একটি করে চার্চ, হাসপাতাল, মানসিক আশ্রয়স্থল, বেল-টাওয়ার, কিছু পরিত্যক্ত বাড়ি ও প্রাক্তন প্রশাসনিক ভবন। দ্বাদশ শতকে নির্মিত বেল-টাওয়ারটি বর্তমানে দ্বীপের প্রধান দৃশ্যমান কাঠামো।
মূলত এটি ছিল সান ভিট্যালে চার্চের একটি অংশ। চার্চটিকে নেপোলিয়ন ধ্বংস করে ফেলেছিলেন ১৮০৬ সালে। এরপর থেকে টাওয়ারটি সমুদ্র পথের বাতিঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বীপের মূল ভবন এবং গাছপালা ও মাঠের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি সেতু রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে একাধিক প্লেগ পিট অর্থাৎ প্লেগে মারা যাওয়া মানুষদের গণ কবর।
ছবিঃ মূল ভবন এবং গাছপালা ও মাঠ সংযোগকারী সেতু
১৯২২ সালে পোভেগ্লিয়ায় টিকে থাকা ভবনগুলোকে মানসিক হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। একে পরবর্তীতে নার্সিং হোমেও পরিণত করা হয়েছিল। হাসপাতালটি ১৯৬৮ সালে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।
ছবিঃ পোভেগ্লিয়ার মানসিক হাসপাতাল
ভূতুড়ে বলে আখ্যায়িত হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে এ দ্বীপের। স্থানীয় সূত্র মতে, ১৪ শতকে সংঘটিত যুদ্ধের কামান গোলার শব্দ এখনও দ্বীপটিতে গেলে পাওয়া যায়।
গভীর রাতে পাওয়া যায় মানুষের গোঙানির শব্দ। অনেকে বলে থাকে, প্লেগে মারা যাওয়া মানুষের আত্মারা আজও এ দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়। সেখান থেকে দ্বীপটির নামকরণ করা যায় আইল্যান্ড অব ডেড বা মৃতদের দ্বীপ।
এছাড়াও প্লেগে বহু মানুষ মারা গেলে তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কঙ্কাল দ্বীপটিতে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে। এমনকি এখানে প্রতিষ্ঠিত মানসিক হাসপাতাল ঘিরেও বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। ডাক্তার ও নার্সরা এখানে চাকরি করতে চাইতেন না।
রোগীরা মানসিক সুস্থতা অর্জনের পরিবর্তে আরও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বলে উল্লেখ রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক এখানকার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার পর হাসপাতালটিকে আর টিকিয়ে রাখা যায়নি। এসব ঘটনার পুরোপুরি সত্যতা যাচাই করা না গেলেও পৃথিবীর অন্যতম ভূতুড়ে স্থান হিসেবে দ্বীপটি পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে।
পোভেগ্লিয়াকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য দুটি টেলিভিশন শো ‘ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চারস’ এবং ‘স্ক্যারিয়েস্ট প্লেসেস অন আর্থ’ এ দ্বীপটিকে ভূতুড়ে বলে দেখানো হয়েছে। রোমান গ্রাফিক উপন্যাস ‘আর ইউ অ্যালাইভ?’ এবং আরও দুটি গ্রাফিক উপন্যাস ‘এন্ডলেস নাইটস’ এবং ‘ক্যাসেল ওয়েটিং’ এর ঘটনা গড়ে তোলা হয় এ দ্বীপকে কেন্দ্র করেই।
২০১৪ সালে ইতালির সরকার একটি নিলামের আয়োজন করে যাতে পোভেগ্লিয়াকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ ইতালির এক ব্যবসায়ী নিলামে দ্বীপটিকে কিনে নিলেও পরবর্তীতে এর প্রতি আর আগ্রহ দেখান নি। ২০১৫ সালে একটি প্রাইভেট গ্রুপ ২৫-৩০ মিলিয়ন ইউরো ব্যবহার করে দ্বীপটিতে পার্ক, রেস্টুরেন্ট এবং হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও পোভেগ্লিয়ায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
পোভেগ্লিয়ায় সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। কিন্তু বিশেষ ভাবে অনুমতি প্রাপ্ত কয়েকজন লেখক এবং চিত্রগ্রাহকদের দ্বীপে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছিল। এদের বর্ণনা ও ছবিই জনসাধারণ দেখে থাকে।
অতিপ্রাকৃত বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। এসব কাহিনী অনেক সময়ই মানুষের মুখে মুখে অতিরঞ্জিত হয়ে ব্যাপক হারে পরিবর্তিত হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় ভূতুড়ে কাহিনী বলে পরিচিত গল্পগুলোর একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা ছিল। কিন্তু মানুষ অশরীরী কল্পনা করতে যে রোমাঞ্চ অনুভব করে তা কমার নয়। পোভেগ্লিয়া দ্বীপটিও এর ব্যতিক্রম নয়। অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে থাকুক বা এসব ঘটনা কেবল গল্পই হোক, কৌতুহল প্রিয় মানুষের কাছে এটি অন্যতম একটি ভূতুড়ে স্থান হিসেবেই পরিচিত থাকবে।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
মন্তব্য লিখুন