আমারা হয়তো অনেকেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহীনিতে মানুষখেকো গাছের কথা শুনেছি । কৌতূহলের মাত্রা যোগ করতে মানুষ খেকো গাছের কথা হয়তো যোগ করা হয়েছে বিভিন্ন ভৌতিক গল্পেও । কিন্তু বাস্তবে কি আসলেই এইরকম আমিষ ভোজী উদ্ভিদ আছে ? তারা আসলে কাদেরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে? আঁকারে তারা কি বিশাল বড়?
মাংস খেকো উদ্ভিদের কথা চিন্তা করলে স্বাভাবিক ভাবেই এরকম কিছু কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় । এসব প্রশ্নের উত্তর যদি দিতে হয় তাহলে বলতে হবে , “ হ্যাঁ , আসলেই এইরকম মাংসখেকো উদ্ভিদের অস্তিত্ব আছে আমাদের এই পৃথিবীতে !” এই ভূতেরে উদ্ভিদ কে পিচার প্ল্যান্ট বলে ডাকা হয় । পিচার প্ল্যান্ট পোকামাকড় জাতীয় প্রাণী খেয়ে তার আমিষের চাহিদা মেটায়।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
নাম শুনে অনেকেই হয়ত ধারনা করতে পেরেছেন এর আকৃতি কেমন হতে পারে। আসলে তার নামের মধ্যেই রয়েছে তার আকৃতির বৈশিষ্ট্য । পিচার ( Pitcher) শব্দের অর্থ কলসি বা পানি রাখার পাত্র । পানির পাত্রের আকৃতির জন্যই এরকম নাম রাখা হয়েছে।
পিচার প্ল্যান্ট অপেক্ষাকৃত মাঝারি আকৃতির লতানো উদ্ভিদ । আঁকারে এরা ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে । এরা স্বাভাবিক উদ্ভিদের মতো জীবন ধারন করে না । সাধারণ উদ্ভিদ যেমন সূর্যের আলোক রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে পাতার মাধ্যমে খাদ্য উৎপন্ন করে এরা কিন্তু শুধু সেরকমটা করে না । মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণের অভাবে এরা অন্য এক অভাবনীয় পদ্ধতির আশ্রয় নেয় । এরা নানা রকম উড়ন্ত অথবা হামাগুড়ি দিয়ে চলা পোকামাকড় শিকার হিসেবে বেঁছে নেয় । অবশেষে পোকামাকড় কে এরা কলস আকৃতির পরিবর্তিত পাতার মধ্যে হজম করে ফেলে । মাংস ভোজী এই উদ্ভিদগুলো কেরিওফিলালেস (Caryophyllales) বর্গের নেপেন্থেসিয়া (Nepenthaceae) ফ্যামিলির সদস্য ।
পিচার প্ল্যান্টের একশোর বেশী প্রজাতি রয়েছে আস্টেলিয়া , মাদাগাস্কার , পাপুয়া নিউ গিনি, সিশেলস, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় । এদেরকে সাধারনত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। এরা অল্প জায়গার মধ্যেই বেড়ে উঠতে পারে । একই স্থানে কয়েকটি প্রজাতি একত্রেও বসবাস করতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে এরা খুবই পটু । নাইট্রোজেন উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য এক অপরিহার্য উপাদান। এই চালাক প্রজাতির উদ্ভিদগুলো যে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান খুবই কম সেই পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে ।
অনুর্বর মাটিতে নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে এদের রয়েছে আসাধারন এক কৌশল । এই অসাধারন এবং চালাক উদ্ভিদগুলো তাদের ঝুলে থাকা ফুলদানি আকৃতির পরিবর্তিত পাতাকে কাজে লাগায়। নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে এদের এই উজ্জ্বল রঙিন , মাতাল করা মিষ্টি ঘ্রানযুক্ত পরিবর্তিত পাতা যেকোনো পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করতে বাধ্য ।
অত্যন্ত পিচ্ছিল এক প্রকার আবরক যা এই কলসি আকৃতির উপরের পরিধি বরাবর ঘিরে থাকে ।
চিত্রঃ পিচার প্ল্যান্ট ; Photograph: Patrick D Moldowan, The Guardian
এটা এতটাই পিচ্ছিল যে কোনো পোকামাকড় একবার পা দিলেই পিছলিয়ে চলে যাবে ভিতরের টক্সিক দ্রবণের মধ্যে। এই আবরক অনেক প্রজাতিতে দাঁত বা খাঁজ যুক্ত থাকে । অসতর্ক পোকামাকড় একবার এই এসিড দ্রবনে পড়ে গেলেই খেলা শেষ ! মুখ বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনিই । কোন ভাবেই পিচ্ছিল এই কলস আকৃতির মরণফাঁদ থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারে না।
পিচার প্ল্যান্টের কলসি আকৃতির পাতাটি তাদের পাকস্থলির মতো কাজ করে। আমাদের পাকস্থলিতে যেমন এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা খাদ্য পরিপাক হয় পিচার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে । বলা যায় এটাই তাদের পাকস্থলি । এসিডিক তরলে থাকা ব্যাকটেরিয়া শিকারকে হজম করে ফেলে । ফলে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের চাহিদা এখান থেকেই তারা মেটায় ।
তবে কিছু কিছু প্রজাতির উদ্ভিদরা পোকামাকড় শিকার করে না । নাইট্রোজেনের ঘাটতি মেটাতে তারা অন্য ইউনিক পদ্ধতি ব্যাবহার করে । এদের অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির মুখ দিয়ে পতনশীল অন্য গাছের পাতা ধরে তাকে পচিয়ে নাইট্রোজেন উৎপন্ন করে । এতে করে তাদের পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করার কোন পদ্ধতি অবলম্বল করার প্রয়োজন পড়ে না ।
ফলে এসব প্রজাতি সুগন্ধযুক্ত সুবাস ও উজ্জ্বল রঙিন বৈশিষ্ট্য থাকে না । আবার কিছু অল্প সংখ্যক প্রজাতি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আকর্ষণ করে। তারা আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে না । বরং তাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে ফেলে যাওয়া বিষ্ঠা যা নাইট্রোজেন উৎপাদনে সাহায্য করে ।
কিছু অরগানিজম যেমন ব্যাকটেরিয়া , কিছু অমেরুদণ্ডী যেমন লার্ভা এবং কিছু প্রজাতির ব্যাঙ এই কলসি আকৃতির পাত্রের মধ্যে বসবাস করে জীবন ধারন করে । শুনতে অবাক লাগলেও ব্যাঙের মতো কিছু প্রজাতি এই এসিডিক মরণ ফাঁদে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে নেয়া শিখেছে । কয়েকটি প্রজাতির মশার লার্ভা এই তরলেই বেড়ে ওঠে অন্য লার্ভা ভক্ষন করে । অনেক সময় পিঁপড়ারা এই ফাঁদে পড়া শিকার কে খেয়ে বেঁছে থাকে ।
পিচার প্ল্যান্ট এক অভাবনীয় মাধ্যমে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকে এবং নিজের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়। এর শিকার ধরার কৌশল আমাদেরকে সাইন্স ফিকশন বা ভুতুরে গল্প মনে করিয়ে দেয়। পিচার প্ল্যান্ট প্রথমে কোন উদ্ভিদকে লতার মতো পেঁচিয়ে অবলম্বল হিসেবে বেঁছে নেয় ।
পরবর্তীতে এর লতানো আগ্রভাগ স্ফীত হয়ে ঝুলে পড়ে এবং কলস আকৃতির মরণ ফাঁদে পরিনত হয় । দুই প্রকারের পিচার প্ল্যান্ট আছে , এক প্রকার যেগুলো উঁচুতে জন্মায় এবং অন্য প্রকার যেগুলো ভুমিতে জন্ময়। ভুমিতে জন্মানো পিচার প্ল্যান্ট বৈশিষ্ট্যে একটু আলাদা এমনকি তাদের শিকার ও আলাদা।
নেপেনথিস (Nepenthes) প্রজাতির পিচার প্ল্যান্টে উভয় রকম ফুল অর্থাৎ পুরুষ ফুল এবং মহিলা ফুল একই গাছে উৎপন্ন হয় না । বিভিন্ন পতঙ্গের দ্বারা পুরুষ এবং মহিলা পিচার প্ল্যান্টের পরাগায়ন হয়। অদ্ভুত বিষয় এই যে যাদেরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে তাদেরকেই কাজে লাগায় পরাগায়নে !
অল্প সংখ্যক পিচার প্ল্যান্টের বিকাশ অল্প হলেও বেশিরভাগ তাদের টেন্ড্রিলের মাধ্যমে গাছের ডালপালা কে ভিত্তি করে বেড়ে ওঠে । কিছু কিছু প্রজাতি ৪৭ ফুট উঁচু গাছকে জড়িয়ে বিকাশ লাভ করে । অনেক ক্ষেত্রেই এরা অন্য উদ্ভিদের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকে । মাটিতে পুষ্টিগুণ কম এমন স্থানে এদের জন্মাতে দেখা যায় বলে বৃদ্ধি হার কমে যায় অনেক ক্ষেত্রেই । পাশাপাশি এরা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমেও খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে ।
পিচার প্ল্যান্ট আদ্র এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠে । পিচার প্ল্যান্টকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় তাদের খুঁজে পাওয়ার স্থান অনুযায়ী । উচ্চ ভুমিতে খুঁজে পাওয়া এবং নিন্ম অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া অনুযায়ী এদের পরিচর্যার পার্থক্য দেখা যায়। অনেকে ইচ্ছা করলেই ঘরোয়া পরিবেশে পিচার প্ল্যান্টের চাষ করতে পারেন। এরা লতানো প্রকৃতির উদ্ভিদ বলে খুব সহজেই চাষ সম্ভব । যেকোনো গাছের সাথেই টবে এদের রোপণ করা যায়।
আন্তর্জাতিক মার্কেটে কিছু বিরল প্রজাতির এই উদ্ভিদ সুউচ্চ মূলে কেনা বেচা হয় । তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ি উপযুক্ত নিয়ম না মেনেই এসব উদ্ভিদ তাদের জন্ম স্থান থেকে তুলে এনে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করছে । যা কিছু প্রজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে ।
১০৪ টির মতো নেপেন্থেস প্রজাতি হুমকির মুখে আছে । ৬৩ টি প্রজাতি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে IUCN এ নাম লেখানো হয়েছে এবং ৯ টি প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তীর পর্যায়ে রয়েছে । কিছু উদ্ভিদতত্ত্ববীদরা বিরল কিছু প্রজাতিকে বাঁচাতে কৃতিম ভাবে এসব উদ্ভিদের চাষ করছেন । এই অদ্ভুত প্রজাতির উদ্ভিদ যাতে পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায় সেজন্য আমাদের আরও সোচ্চার হওয়া জরুরি ।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ
www.animals.sandiegozoo.org
www.britannica.com
মন্তব্য লিখুন