পৃথিবীর বুকে এখনো যেসব প্রাচীন সভ্যতার অমিমাংসিত রহস্য রয়ে গেছে তার মধ্যে পেরুর নাজকা লাইনস অন্যতম। পেরুর রাজধানী শহর লিমা থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মতো দক্ষিনে নাজকা মরুভূমিতে এই রহস্যময় বিশাল ভূচিত্র সমূহের অবস্থান।
নাজকা লাইনস এর বিশালতা ও নিখুঁত জ্যামিতিক কাজ ও নকশা চোখে আসার পর থেকেই মানুষ বিস্মিত হয়েছে। কি এর কাজ আর কিভাবেই বা প্রাচীন নাজকা সংস্কৃতির মানুষ এই বিশাল চিত্রগুলোকে বালির ভিতর ফুটিয়ে তুলেছিল তা নিয়ে তৈ্রি হয়েছে একাধিক মতবাদ।
এমনকি কিছু মতবাদে বিশ্বাস করা হয়, এগুলো একা প্রাচীন নাজকা অধিবাসীদের দ্বারা তৈ্রি নয়, ভিনগ্রহবাসী এলিয়েনদের সহায়তায় এগুলো তৈ্রী করা হয়েছিল।
১৯২৬ সালে আর্কিওলজিস্ট তোরিবিও মেহিয়া কেসপ প্রথম ভূমির ওপর আঁকা এই রেখাসমূহকে কোনো নির্দিষ্ট আকৃ্তির বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলো আকারে এতটাই বিশাল যে ভূমি থেকে এগুলোকে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব।
১৯৩০ সালে যখন ওই অঞ্চল দিয়ে বিমান চলাচল শুরু হয় তখনই মূলত এটি মানুষের চোখে পড়ে। পাইলটরা এই নকশা দেখে প্রথমে অবাক হন, পত্রিকাতেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে অনেকেই এগুলো তখন দৃষ্টিভ্রম বা প্রকৃ্তির নিজস্ব সৃষ্টি বা অনেকে আবার সবই মিডিয়ার বানানো বলে উড়িয়ে দেন।
১৯৪১ সালে আমেরিকান অধ্যাপক পল কসক এবং জার্মান গণিতজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ মারিয়া রাইখ এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। তাদের গবেষণার ফলাফল সামনে আসার পর মানুষের এ বিষয়ে কৌ্তুহল আরো অনেকগুন বেড়ে যায়।
গবেষণার তত্ত্বমতে এই নাজকা লাইনস প্রথম তৈরী হয়েছিল প্রাচীন নাজকা সভ্যতার মানুষদের হাতে খ্রিষ্টপূর্ব সাতশ সালের দিকে বা তারও কিছু আগে। তাদের মতে স্থানীয় মানুষ উপরের আয়রন অক্সাইড সমৃদ্ধ লালচে বালি ও নুড়ি সরিয়ে নিচের অপেক্ষাকৃ্ত হালকা রঙের বালি উন্মোচন করে এই নকশাসমূহ তৈ্রি করেন। আর ওই অঞ্চলের প্রচন্ড শুষ্ক আবহাওয়া এগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষন করে।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। প্রথমত, প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই নকশাগুলোর কোনোটি আছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা। এত বিশাল নকশা ভূমি থেকে দাঁড়িয়ে কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব না। তাহলে প্রাচীন নাজকা সভ্যতার মানুষেরা কিভাবে এই বিশাল নিখুঁত চিত্র্গুলো এঁকেছিল?
কোরআনের আলোকে এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণী
‘এরিয়া-৫১’ রহস্যে মুড়ানো দুর্বোধ্য ঘাটির আত্মকথন! (পর্ব-১)
এই বিস্তৃত নকশাগুলো কিভাবে আঁকা হয়েছে সেই রহস্য সমাধানে যুক্ত কিছু বিজ্ঞানী মনে করতেন, প্রাচীন নাজকা জনগোষ্ঠীর মানুষ হট এয়ার বেলুনের ব্যবহার জানত। তারা হট এয়ার বেলুন ব্যবহার করে উপরে উঠে উঁচু থেকে কাজ পরিচালনা করতো।
কিন্তু এই ধারণা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। নাজকা লাইনস প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালের মধ্যে আঁকা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ওই সময় ওই অঞ্চলে কোনো উড্ডয়নশীল বেলুন ছিল বা এ জাতীয় কোনোরকম প্রযুক্তির অস্তিত্বই প্রাচীন নিদর্শন সমূহের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তাই এধরনের চিত্র কিভাবে প্রাচীন মানুষ আঁকতে সমর্থ হয়েছিল সেই রহস্যের ব্যাখ্যা করতে কিছু বিজ্ঞানী ভিনগ্রহের প্রাণীদের দায়ী করে থাকেন। তাদের ধারনা মতে ভিনগ্রহবাসীদের নির্দেশনাতেই এই চিত্রসমূহ নিখুঁতভাবে আঁকা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া এই বিশাল শুষ্ক সমতল মালভূমি এলিয়েনদের স্পেসশিপ অবতরণের জন্যেও আদর্শ বলে মনে করেন অনেকে।
বিশেষত, দুটি নাজকা লাইন এমন ভাবে আঁকা যেন একটি স্পেসশিপের রানওয়ে এবং অন্যটিকে অনেকটা ভিনগ্রহের কোনো কাল্পনিক প্রাণীর মতো দেখতে। তবে এই দূর্বল ব্যাখ্যা বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মেনে নেন নি।
নাজকা লাইনসের সঠিক রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য অনেক বিজ্ঞানীই সে সময় তৎপর ছিলেন। কি কারনে এই অসংখ্য চিত্র ও সহস্রাধিক রেখা শুষ্ক মালভূমিতে আঁকা হয়েছিল তার একাধিক মতবাদ রয়েছে।
একটি মতবাদ অনুযায়ী এটি নক্ষত্র মন্ডলের অনুকরনে মহাকাশের একটি মানচিত্র হিসেবে আঁকা হয়েছিল। আরেকটি মতবাদে মনে করা হয় এটি আকাশের দেবদেবীদের দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্যে আঁকা হতো।
যেহেতু অত্যন্ত শুষ্ক নাজকা মালভূমিতে কখনো বছরে ১ইঞ্চিরও কম বৃষ্টিপাত হতো, তাই হয়তো এধরনের আচার অনুষ্ঠান পালন করে তারা বৃষ্টির আশা করতো। কিছু মতবাদে আবার বিশ্বাস করা হয় তারা ভিনগ্রহবাসীদের সংকেত প্রদানের উদ্দেশ্যে এই সব বিশাল চিনহ সমূহ এঁকে রাখতেন।
তবে যাইহোক, এত রকম মতবাদের মধ্যেও কিছু মতবাদ আছে যা সব থেকে বেশি গ্রহনযোগ্য। এরমধ্যে একটি ধারনা হলো এই রেখা বা নকশাসমূহ ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা ক্যালেন্ডারের মতো ব্যবহার করতো।
নাজকা লাইনস নিয়ে গবেষণা করা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন মারিয়া রাইখ। তিনি প্রথম খেয়াল করেন এর মধ্যে অনেকগুলি চিত্র এবং লাইন দিগন্তের এমন একটি দিককে নির্দেশ করে, ঠিক যে বরাবর শীতকালীন দূরতম সূর্যোদয় হয়।
এরপর তিনি এমন আরো অনেক ভূচিত্র পেলেন যার সাথে যুক্ত কোনো রেখা এমনই কোনো মহাজাগতিক ঘটনাকে নির্দেশ করে। যেমনঃ হামিংবার্ড, ঈগল ও হেরনের ভূচিত্র। হয়তো এই দূরতম ও নিকটতম সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত থেকে তারা ঋতু বিষয়ক ধারণা পেতেন, যা তাদের কৃ্ষি বিষয়ক কাজে সহায়তা করতো।
নাজকা লাইনস নিয়ে এই তত্ত্বটি অনেকের কাছে গৃহিত হলেও, অন্য আরো শত শত চিত্রসমূহ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই তত্ত্ব থেকে অল্প কিছু চিত্র সম্পর্কে আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু ওই অঞ্চলে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অন্য রেখা সমূহের কোনো কারন এই তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায় না।
সাম্প্রতিক কালের কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন এই রেখাসমূহ ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের সাথে যুক্ত। যেহেতু পেরুর ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান খুবই কম, তাই পানির ব্যবহারে তাদের যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠতে হয়েছিল।
প্রচন্ড শুষ্ক মরুভূমিতে পানির উৎস বলতে মূলত তাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে থাকতে হত। তাই মরুভূমির কোন কোন অংশে সহজেই বালি খুঁড়ে পানি পাওয়া যায় তা মনে রাখা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল।
অনেক রেখা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেস্থানে রেখা সমূহ মিলিত হচ্ছে সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বেশ ওপরে। অর্থাৎ সেখানে বালি খুঁড়ে পানি উত্তোলন করা বেশ সহজ।
তাছাড়া অনেক রেখা আছে যেগুলো সমুদ্রের দিক নির্দেশ করে। আর সমুদ্রের পারেও দেখা যায় একটি বিশাল ক্যাকটাসের ভূচিত্র।
এছাড়াও, একটি নাজকা চিত্রে দুপায়ে দাঁড়ানো মানুষের মতো একটি অবয়ব দেখা যায়, যেটিকে অনেকে প্রাচীনকালে পৃথিবীতে আসা কোনো এলিয়েন বলে মনে করেন। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি হয়তো সেইকালের একজন মৎস্যজীবীর প্রতিরূপ। কারন, প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী এই অঞ্চলের মানুষের ওপর সমুদ্র যথেষ্ট প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
নাজকা লাইনসের অনেক রহস্য নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। ধারণা করা হয় এর মধ্যে অনেক লাইনসমূহ হয়তো নাজকাদেরও আগে এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্যারাকাস জনগোষ্ঠীর লোকেরা করেছিলেন। কিভাবে এগুলো আঁকা হয়েছিল তার সব থেকে নির্ভর যোগ্য উত্তর হয়তো দড়ি ও লাঠি ব্যবহার করে মাপ নিয়ে করা। এবং কিছুটা উঁচু ভূমিতে একজনকে রেখে তার নির্দেশনায় আঁকা।
নাজকা লাইনস নিয়ে মানুষের আগ্রহ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই বিশাল নিদর্শন সমূহ ১৯৯৪সালে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
পরবর্তীতে আরো বেশ কিছু নকশা ও লাইন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা এই রহস্যের প্রতি বিজ্ঞানীদের আরো আকৃ্ষ্ট করে। তবে এই রহস্যের সমাধান যে কোনো এলিয়েন বা ভীনগ্রহের প্রাণীর সাথে যুক্ত নয়, তা এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ গবেষকেরাই মেনে নিয়েছেন।
এ পর্যন্ত যা গবেষণা হয়েছে তাতে ধারণা করা যায় এই রহস্যের সমাধান একটি নয়। এই চিত্র ও রেখাসমূহ হয়তো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তৈ্রী হয়েছিল। যেমন- ভূগর্ভস্থ পানির সন্ধান, মহাজাগতিক ক্যালেন্ডার, সমুদ্রের দিক নির্দেশক বা কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান।
তবে যে কারনেই তারা এই বিশাল বিস্তৃত ভূচিত্রগুলো তৈ্রী করে থাকুক না কেন, তা তাদের শ্রম, মেধা আর একতার পরিচায়ক, যা আজও আধুনিক মানুষের কাছে এক বিস্ময়।
মন্তব্য লিখুন