শহুরে জীবনের কর্ম-ব্যস্ততা, জটিলতা, দূষণ আর দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে অতিষ্ঠ আমরা সবাই। দু দন্ড শান্তির আশা করাও যেন ব্যর্থ প্রচেষ্টা এখানে। দৈনন্দিন জীবনের সকল ব্যস্ততা আর ক্লান্তি থেকে একটু মুক্তি পেতে চায় মন। মনে হয় একটুখানি ঘুরে আসি এমন কোথাও থেকে, যেখানে কোনো কাজের ব্যস্ততা নেই, নেই কোনো লম্বা ট্রfফিক। আছে শুধু মন ভরানো সৌন্দর্য আর অকৃত্রিম পরিবেশ।
আচ্ছা মনে করুন তো আপনি একদিন আপনার সকল কাজ সেরে রাতে ঘুমাতে গেলেন, সকালে চোখ মেলে দেখলেন আপনি এক নতুন রুপকথার রাজ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। যেখানের চারপাশ শুধু সবুজে ভরা, পাখিদের বিচরণ, পাহাড়সম অট্টালিকার ভিড় নেই। আছে শুধু কিছু সংখ্যক মাটির তৈরী একতলা, দোতলা বাড়ি। আর প্রতিটি বাড়ির দেয়াল সুন্দর সুন্দর আলপনায় ভরা। তাহলে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই আনন্দে মন ভরে উঠবে! তাহলে চলুন ঘুরে আসি এমন ই একটি গ্রাম থেকে যার নাম “টিকোইল“।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
উত্তর বঙ্গের বরেন্দ্র জেলা চাপাইনবাব গঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের একটি ছোট গ্রাম নাম “টিকোইল” লোকে ভালোবেসে বলে “আলপনা গ্রাম“। কারণ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে আঁকা আছে সুন্দর সুন্দর আলপনা। আর এই আলপনা গুলো গ্রামটিকে করছে আরো নৈসর্গিক ও অতুলনীয়।
টিকোইল যেতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই যেতে হবে আমের রাজধানী চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায়, সেখান থেকে বাস বা প্রাইভেট কার এ করে সরাসরি পৌছে যেতে পারেন নাচোল আর সেখান থেকে টিকোইল গ্রামে। চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে টিকোইল এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কি.মি।
আর যদি সরাসরি চাপাইনবাবগঞ্জ যাবার গাড়ি না পান তাহলে রাজশাহী হয়েও যেতে পারেন। রাজশাহী হতে কাঁকনহাট সেখান থেকে টিকোইল। মোট দূরত্ব প্রায় ৫৪ কি.মি।
প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে গেলে খরচ হবে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে পাবলিক ট্রন্সপোর্ট এ ভেঙে ভেঙে গেলে অল্প খরচেই যাওয়া যাবে।
এছাড়াও জেলা শহর নওগাঁ থেকে মান্দাপুর হয়েও যাওয়া যায় টিকোইল। নওগাঁ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬৮কি.মি। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে গেলে পনেরোশত থেকে দুই হাজার টাকায় নওগাঁ থেকে টিকোইল যাওয়া যায়।
টিকোইল গ্রামে প্রবেশের কিছু পূর্ব চোখে পরবে এক বিশাল তেঁতুল গাছ যার বয়স প্রায় একশত বছর। টিকোইল গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি দিয়ে বয়ে একটি মাত্র সরু পাকা রাস্তা। অন্য সব রাস্তা গুলো মাটির তৈরি। এখানকার বাড়ি গুলোর অধিকাংশই এই পাকা রাস্তার দুটি পাশে অবস্থিত।
বেশিরভাগ বাড়িই তৈরী করা হয়েছে মাটি দিয়ে। দেয়াল থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত সবই মাটির তৈরি। আর প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালেই রঙতুলি দিয়ে আলপনা করা হয়েছে ।
দেখে মনে হবে যেন , কোনো শিল্পী তার আঁকা ছবির ক্যানভাস গুলো সাজিয়ে রেখেছে। আলপনা করা দেয়ালগুলো দেখে যে কারো মন বিষ্ময়ে ভরে যাবে। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে দেখ যায় যে শুধু দেয়ালেই নয় কিছু কিছু বাড়ির সামনে উঠানে ও আলপনা করা আছে।
এজন্যই গ্রামটির নাম আলপনা গ্রাম। এছাড়াও রাস্তার পাশের ধান ক্ষেত,পুকুর আর সারি সারি গাছের মনোরম দৃশ্য যে কারো মন ভোলাবে। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার ই সনাতন ধর্মাবলম্বী কিন্তু মাঝেমাঝে কয়েকটি মুসলিম পরিবারেরও দেখা মেলে। যুগ যুগ ধরে তারা শান্তি ও সৌহার্দ্যের সাথে বাস করছে এই আলপনা গ্রামে।
স্থানীয়দের মতে অনেককাল আগে থেকেই ঘরের দেয়ালে আলপনা করার রীতি চলে আসছে এই গ্রামে। জানা যায় যে সুদূর অতীতে হিন্দু বাড়ির মহিলারা পুজার সময় বাড়ির দেয়ালে আলপনা করতেন।এছাড়াও বাড়িতে অতিথি আসার আগে এবং ছেলে-মেয়ের বিয়ের আগেও বাড়িতে আলপনা করতেন।
সেই থেকেই শুরু হয় বাড়ির দেয়ালে আলপনা চর্চা।সেই থেকে এখনো পর্যন্ত চলে আসছে এই আলপনা করার রীতি। আর এখন সারা বছরই দেয়াল গুলো আলপনায় ভরা থাকে।
কখনো কখনো আলপনা মুছে গেলে বা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেলে আবারও আঁকা হয় আলপনা। বছরে চার থেকে পাঁচবার আলপনা করা হয় একই দেয়ালে।দেয়াল গুলো কখনোই খালি রাখেনা বাড়ির মহিলারা।
টিকোইল গ্রামের প্রতিটি বাড়িই যেন এক-একটি শিল্পকর্ম। প্রতিটি বাড়ির দেয়ালেই রয়েছে আলপনা করা তবুও কারো আলপনার মধ্যে কোনো মিল নেই। প্রতিটি আলপনাই অনন্য। আলপনা আকার বিষয়টিকে তারা মনস্তাত্ত্বিক স্তরে নিয়ে গিয়েছে। গ্রামের মেয়ে – বধুরা তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে আলপনা তৈরি করে ঘরের দেয়ালে।
শুধু ফুল আর লতা পাতা দিয়ে ই তারা আলপনা করে না।গ্রাম-বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি আর প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আলপনা গুলোতে।সাধারণত ঘরের ভেতর দেয়াল গুলোতে আলপনা করা হয় শিশুদের খেয়াল খুশি মতো।এজন্য এখানে ঘুড়ি, বেলুন,পাখি এমনকি বিশাল মাপের ডায়নোসরের ছবি আঁকা হয়।
আর বাইরের দেয়ালে আঁকা হয় বাড়ির মহিলাদের কল্পনার জগৎ ও পছন্দ অনুযায়ী আলপনা।প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল, গাছ,পাখি ইত্যাদি স্থান পায় বাইরের দেয়ালে। শুধু ঘরের দেয়ালেই নয় বাড়ির পুজোর মন্ডপ থেকে শুরু করে রান্না ঘর, কল পার কোনোকিছুই বাদ যায় না এই আলপনা থেকে।
টিকোইল গ্রামের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র আর আলপনার সৌন্দর্যের কথা শুনে যদি মনে করেন যে, এ গ্রামের সকল বিষ্ময়কর তথ্য জেনে ফেলেছেন তাহলে বলছি খুব ভুল ভেবেছেন। বিষ্মিত হবার এখনো বাকি আছে।
যদি বলি যে, মাটির দেয়ালে এই আলপনা করতে যে রঙ প্রয়োজন তা তারা নিজেরাই তৈরি করে তখন নিশ্চয়ই আরোও অবাক হয়ে যাবেন। হ্যাঁ তারা নিজেরাই তৈরি করে এই রঙ।এই রঙ তৈরির কাচামাল আসে মাটি থেকে।
একসময় আলপনা করা হতো শুধু লাল ও সাদা রঙ দিয়ে। লাল রঙ তৈরি করা হয় লাল মাটি দিয়ে অথবা পুঁই এর বিচি থেকে এবং সাদা রঙ তৈরি হত মাটির সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে অথবা চক থেকে।
কিন্তু এ রঙ বেশি দিন স্থায়ী হতো না।তাই বর্তমানে গিরিমাটি ও খড়িমাটির সাথে শুকনো বরই চূর্ণের আঠা, কলাগাছের আঠা, আমের পুরাতন আঁটির শাঁসের গুঁড়া, চক,মানকচু, ইত্যাদির মিশ্রন চার থেকে পাঁচ দিন ভিজিয়ে রেখে টেকসই রঙ তৈরি করা হয়।এই রঙ গুলো বেশ অনেক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
আসলে প্রকৃতির মানুষের প্রকৃতির উপাদান ব্যবহারের চমৎকার নিদর্শন এটি। তবে বর্তমানে বাজারে রাসায়নিক রঙ এর বৃদ্ধির কারণে কেউ কেউ এর প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে।
বহুযুগ ধরে এই টিকোইল গ্রামে আলপনার চর্চা হয়ে আসছে। অতীতে শুধু ফুল, লতাপাতা দিয়েই আলপনা করা হতো। কিন্তু আলপনায় ফুল আর লতাপাতা ছাড়াও গাছ,পাখি, প্রাণী, দৃশ্য আর নিজের কল্পনা মিশিয়ে আলপনা আঁকার প্রচলন শুরু করেছিলেন যে ব্যক্তিটি তার নাম শ্রীমতী দেখন বর্মন।
নিতান্তই শখের বসে হলেও দেখন বর্মন দেবী যেন নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন বিশাল শিল্পকর্ম।এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকারি অনুদান হিসেবে পেয়েছেন একটি ইটের বাড়ি, পেয়েছেন সোলার প্যানেল ও আরো অনেক সম্মাননা। তার এই বাড়িটির নাম আলপনা বাড়ি।
টিকোইল বা এই আলপনা গ্রাম নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অনেক প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়া প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ঘুরতে আসে এই গ্রামে আলপনা দেখতে। তারা আলপনার ছবি তোলে, ভিডিও করে নিয়ে আসে।
আর টেলিভিশন ও ইন্টারনেট এর সুবাদে টিকোইল এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও পরিচিতি। প্রতি বছর বিদেশ থেকেও অনেক দর্শনার্থী এসে ভিড় জমায় এই আলপনার রাজ্য টিকোইলে।
এই দেখন বর্মনের বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে একটি পরিদর্শন খাতা।দর্শনার্থীরা মনোমুগ্ধকর আলপনা দেখে তাদের বিভিন্ন মন্তব্য লিখে রেখে যায় এই পরিদর্শন খাতায়।
চাপাইনবাবগঞ্জ জেলাটি সুস্বাদু আমের জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত। তার উপর এই আলপনা গ্রাম চাপাইনবয়াবগঞ্জ জেলার সুখ্যাতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রাম্য মনোরম পরিবেশের পাশাপাশি অনন্য আলপনা গুলো মানুষের মন ভালো করে দেয়। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি অনেক দর্শনার্থী আসে এখানে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে টিকোইল গ্রামটিকে একটি বড় মানের দর্শনীয় স্থানে পরিনত করা যেতে পারে, এতে করে টিকোইল গ্রামের মানুষের আলপনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরবে এবং দেশের অর্থনৈতিক লাভেরও সম্ভাবনা রয়েছে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন