বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশুপাখিদের জন্য অনেক অভয়ারণ্য রয়েছে। যেখানে প্রাণীরা মুক্ত বনে নিজেদের মতো বসবাস করে থাকে। তবে পৃথিবীর একমাত্র পানিতে ভাসমান অভয়ারণ্য “কেইবুল লামজাও” রয়েছে ভারতের মনিপুর রাজ্যের বিষ্ণুপুর জেলার লোকটাক হ্রদে। বাংলাদেশের সিলেট জেলা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩৬০ কি.মি.। সারা বিশ্বেই বনভূমির পরিমান প্রতিনিয়ত কমে আসছে। বনের পশুপাখিরা বাসস্থান সংকটে লোকালয়ে প্রবেশ করছে, অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রাণীদের আবাস্থল হিসেবে ভাসমান অভয়ারণ্য হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান। আজ আমরা এই ভাসমান অভয়ারণ্যের বিষয়েই জানব।
ভাসমান অভয়ারণ্য হচ্ছে এমন একটি বন যেটি মূলত কোনো ভুমির ওপর গড়ে ওঠে না, ভাসমান কোনো মাধ্যমের ওপর গড়ে ওঠে এই বন। যেমন আমাদের দেশে নৌকার ওপর ভাসমান বাজার, বা ভাসমান বাসস্থানও দেখা যায়। তো বিষয়টা অনেকটা এরকমই কিন্তু এই বন কোনো নৌকার ওপর গড়ে ওঠে না। এই বনের ভাসমান মাধ্যম মূলত তৈ্রি করা হয় কয়েক বিশেষ প্রজাতির ঘাস দিয়ে, যা ওই অঞ্চলে বেশ সহজলভ্য। এই ঘাসের তৈরি মাধ্যমগুলো অনেক ওজন নিয়েও খুব সহজেই পানিতে ভাসতে পারে। এই বিশেষ রকমের ঘাসের তৈরি মাধ্যমের ওপর মানুষ বাসস্থানও তৈরি করতে পারেন।
জানা যায়, মান শর্মা নামের একজন ব্যক্তি কেইবুল লামজাও উদ্যানটির সৃষ্টি করেছিলেন। উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পচনশীল জৈব পদার্থ এবং বিভিন্ন রকমের ঘাস দিয়ে বানানো হয় এই উদ্যান যা স্থানীয়ভাবে ফামডিশ নামে পরিচিত। এরপর এতে মাটিতে গাছ লাগানোর মতোই বিভিন্ন রকম গাছ লাগানো যায়। নিচে থাকা পানির উৎস থেকে গাছগুলো প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে বেড়ে উঠতে পারে।
বিশ্বের এই একমাত্র ভাসমান অভয়ারণ্যতে রয়েছে প্রায় ২৩৩ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১০০ প্রজাতির পাখি এবং ৪২৫ প্রজাতির পশু। এই বনেই রয়েছে বিপন্ন প্রায় মনিপুরি সাংহাই হরিণ। এছাড়া আরো রয়েছে হগ হরিণ, সাম্বার হরিণ ও মান্টজ্যাক। এই বনের রয়েছে নিজস্ব খাদ্য শৃঙ্খল। ফলে বলা যায় এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বনভূমি। ১৯৭৭ সালে এই বনটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই কেইবুল লামজাও অভয়ারণ্য আয়তনে প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। চারিদিকে পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকার কারণে এই ভাসমান অরণ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়। যার কারণে অবৈধ চোরা শিকারিদের কারবার এখানে নেই বললেই চলে। আবার, এই ব্যবস্থার কারণে এই দ্বীপ বনাঞ্চল থেকে প্রাণীরা বাইরের এসে মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। ফলে প্রাণী বৈচিত্র রক্ষার জন্য এই স্থান একেবারেই আদর্শ।
লোকটাক হ্রদে ভাসমান এই অভয়ারণ্য ছাড়াও আরো রয়েছে বেশ কিছু গোলাকার ভাসমান দ্বীপ। এই দ্বীপগুলোতে কিছু মানুষ পরিবার সহ বসবাস করছেন। অসাধারণ সুন্দর দৃষ্টিনন্দন এই গোলাকার দ্বীপগুলি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একদম আদর্শ স্থান।
এই দ্বীপগুলোতে বসবাসকারী পরিবারগুলো মূলত মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রত্যেক পরিবারের মাছ ধরার জন্য হ্রদের আলাদা আলাদা স্থান তারা নিজেরাই চিহ্নিত করে রেখেছেন। এই ভাসমান ঘাস দিয়েই গোলাকৃতির স্থান চিনহিত করা হয়। যা, দূর থেকে দেখলে আমাদের অপরিচিত চোখে এক অপার্থিব সৌ্ন্দর্যের সাথে ধরা দেয়। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় নৌকা। এখানে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এখানে ভাসমান স্কুলের ব্যবস্থাও রয়েছে। এই হ্রদের বাসিন্দাদের ছেলে মেয়েরাই এখানে পড়তে আসে। শিক্ষক- শিক্ষার্থী সকলেই এখানে আসেন নৌকায় করে।
স্বচ্ছ মিঠা পানির এই লোকটাক হ্রদে বসবাসকারী পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা এই ভাসমান দ্বীপগুলোর মতোই সুন্দর। কুয়াশা মাখা সকালে বা গোধুলীর রাঙা আলোয় এই হ্রদে যেন এক মায়াময় সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটে। তার সাথে বিভিন্ন বিপন্ন প্রায় পাখপাখলির মেলা হ্রদের সৌন্দর্য্যে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে।
ভারতের বৃহত্তম স্বচ্ছ পানির হ্রদ এই লোকটাক হ্রদ। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৫ কি.মি. এবং প্রস্থে ১৫ কি.মি.। তিন দিক পাহাড়ে ঘেরা থাকার কারণে বাইরের ব্যস্ত আধুনিক জনজীবন থেকে এই হ্রদ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। আর একারনেই হয়তো মানবসৃষ্ট দূষণ থেকে রক্ষা পেয়েছে এই হ্রদের মিঠা পানি। সাথে এই ভাসমান দ্বীপে আশ্রয় পেয়েছে বিপন্ন কিছু প্রজাতির প্রাণী।
স্বচ্ছ পানির জন্য ভারতের এই মনিপুর ও মেঘালয় রাজ্য বেশ বিখ্যাত। মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট থেকে উৎপন্ন ডাউকি নদীর একটি শাখা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এই নদীটি সিলেট জেলার জাফলং এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই পানিতে পলি কম থাকায় ও তলদেশের অসংখ্য উচু নিচু পাথর এই নদীর পানিকে ফিল্টার করে দেয়। যার ফলে এই নদীতে কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি দেখা যায়। স্বচ্ছ পানির কারণে আন্তর্জাতিক ভাবেই এই নদী বিখ্যাত।
প্রতি বছর দেশ- বিদেশের অসংখ্য পর্যটক আসেন এই জলধারার কাছে শুধু একবার এর কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ পানি অবলোকন করার জন্য। এই নদীকে দূষনমুক্ত রেখে এর সৌন্দর্য্য ধরে রাখা আমাদেরই কর্তব্য। সাথে প্রাণীবৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে কেইবুল লামজাও ভাসমান অভয়ারণ্য হতে পারে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন