সাধারণত আমরা রাতের বেলায় ঘুমাই। আবার কেউ কেউ রাত জেগে দিনের বেলা ঘুমিয়ে পুশিয়ে নেন। কিন্তু দিনের ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে এই কথা কি কেউ কখন ও শুনেছেন যে, মানুষ যেকোনো অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়তে পারে। কেউ গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েন, কেউ স্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে, কেউ হাঁটতে হাঁটতে আবার কেউ বা মটর সাইকেল চালাতে গিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
ছোট বেলায় রুপকথার গল্পে নিশ্চয়ই এমন শুনেছেন যে সোনারকাঠি বা রুপোরকাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত এবং তারা অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকত। এ মায়াপুরী শহর কেবল রুপকথাই সম্ভব। বাস্তবে কি এমন কোনো কিছু আছে যেখানে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে? এর উত্তর হবে “ঘটে”।
আমাদের পৃথিবীতেই এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কাজাকিস্তানে এমনই এক গ্রাম রয়েছে যেখানে মানুষ যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
উত্তর কাজাকিস্তানের এমন এক প্রত্যন্ত গ্রাম “কালাচি“। যেখানকার মানুষ এমন অদ্ভুত বিরল রোগে ভুগছেন। তাই এই গ্রামের বাসীন্দাদের অন্তঃসারশূন্য তন্দাচ্ছন্ন মানুষ বলেও অভিহিত করা হয়।তাছাড়া এই রোগ কালাচির পাশের শহর ক্রাসনোগোরস্কতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১০ সালে প্রথম দেখা যায় এই অদ্ভুত ব্যাপারটি। আর ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে সেটা ক্রমেই বাড়ছে।চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ওই অঞ্চলের মানুষের মস্তিষ্কে অত্যাধিক জলীয় পদার্থের উপস্থিতির কারণে এমনটি হতে পারে।
এই বিরল রোগে আক্রান্ত হলে কেউ কেউ দুুই থেকে আট দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। এবং জেগে উঠে তাদের স্মৃতি ভ্রম হয়।এছাড়া ঘুম থেকে উঠে প্রচন্ড দুর্বল,মাথা ঝিম ধরে থাকা, বমি-বমি ভাব, ঠিক মতো দাঁড়াতে না পারা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায় আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে।
কালাচিতে এই রোগের হার ১৪ শতাংশ। এই গ্রাম ও পাশের শহর মিলিয়ে মোট ৬০০ এর বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। কাজাকিস্তানের রাজধানী শহর আস্তানা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কালাচি গ্রামের মানুষের মাঝে এখন আতঙ্ক বিরাজ করেছে।
এই রোগ বিগত সাত বছর ধরে প্রকট হচ্ছে। হঠাৎ এক দিন স্কুলের এসেম্বলিতে আট জন শিশু ঘুমিয়ে পড়ে এবং তাদের হসপিটালে ভর্তি করা হয়। এর কয়েক মাস পরে একদিনে ৬০ জন মানুষ একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তাদের হসপিটালে ভর্তি করা হয়। তাদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে অত্যাধিক তরলের উপস্থিতি পাওয়া যায়। আক্রান্ত লোকদের দাঁড়াতে অক্ষমতা, মাথা ঝিমঝিম ধরা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।অনেকের ক্ষেত্রে আবার দৃষ্টিভ্রম ও দেখা যায়।
তবে বিজ্ঞানীরা এর স্পষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পান নি এখনও। অনেকে মনে করেন মেননজাইটিস ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে এমনটি হতে পারে।কিন্তু এখানকার মাটি ও পানি পরীক্ষা করে এমন কোনো উপাদান পাওয়া যায় নি।
তবে স্থানীয়দের মতে তৎকালীন সভিয়েত ইউনিয়ানের ইউরিনিয়াম খনির তেজস্ক্রিয়তার কারণে এমনটি হতে পারে। সেই সব খনিগুলা এখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এক গবেষনায় দেখা গেছে, খনির আশেপাশে বা ভিতরে যে পরিমাণ তেজস্কিয় পদার্থের বিকিরণের মাত্রা রয়েছে,কালাচি গ্রামেও সেই পরিমাণ বিকিরণের মাত্রা পাওয়া গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, খনিতে যারা কাজ করতেন তাদের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হন নি।
কাজাকিস্তানের জাতীয় নিউক্লিয়ার সেন্টারের রেডিয়শন সেফটি এন্ড ইকোলজি ইন্সটিটিউটের পরিচালক সার্গেই লুকাশেঙ্কো বলেছেন যে, তিনি মনে করেন ব্যাপারটি বর্ণহীন, তেজস্ক্রিয় গ্যাস রোডনের কারণে হচ্ছে না।
সার্বিয়ান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এটা কার্বন মনোক্সাইডের কারণে হতে পারে। এই অঞ্চলের অদ্ভুত অবস্থান ও আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে আমাদের কেউ কেউ এমন সন্দেহ করছে। এখানে চিমনির ধোঁয়া ওপরে উঠে যাওয়ার বদলে নিচে ও চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
কার্বন মনোক্সাইডের কারণে প্রায়ই মাথাব্যাথা, বমি ও অবসন্ন ভাব আসতে পারে। কিন্তু এই উদ্ভট ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা সেটা দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না।কারণ এর সাথে হঠাৎ ঘুুুমিয়ে পড়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
গত গ্রীষ্মে এই ঘুম-রোগের শিকার হন ভিক্টর কাজাচেঙ্কো নামের এক ব্যক্তি। তিনি কাছাকাছি এক শহরে যাবার জন্য রওয়ানা হন তার পুরনো মোটরবাইকে করে। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ করেই অতল ঘুমে তলিয়ে যান তিনি।
২৮ আগস্ট ঘুমিয়ে যাবার পর তার এই ঘুম ভাঙ্গে ২ সেপ্টেম্বর। জেগে ওঠার পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে। তবে এতে তিনি তেমন আহত হননি। এটাই প্রথম নয়, এর আগেও এমনভাবে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে যান তিনি এবং জেগে ওঠেন তিন দিন পর। এর পর তিনি নিজের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখতে পান। তার রক্তচাপ বেড়ে যায় আর ঘন ঘন মাথাব্যাথা হতে থাকে। এই শহরের অন্যান্যরা জানায়, তাদের মাথা ঘোরা, বমি ভাব এবং স্মৃতিবিলুপ্তির মতো ঘটনা ঘটছে।
২০১৩ সালের এই ঘটনার সাথে মানুষ পরিচিত হতে থাকে। এ সময় থেকে ওই শহরের ১২০ জন বাসিন্দা ১৫২ বার এমন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে দিনের পর দিন কাটাতে হয়। এই গ্রামের ও পাশের শহরের মানুষ এখন দুঃশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। কেননা এই ঘুমে তারা যেকোনো সময় আচ্ছন্ন হয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে যেতে পারেন। কেউ কেউ তাদের সন্তানদের নিয়ে পাশের বিভিন্ন শহরে পারি জমাচ্ছেন।কেউ বা তাদের এই জন্মস্থান ছেড়ে যেতে চাইছেন না।
এক সময়ের অত্যন্ত ব্যস্ত শহর ক্রানোগোরস্ক,এখন প্রায় জন শূন্য শহরে পরিণত হয়েছে।দিন- দুপুরে সেখানে সুনশান নিরাবতা।মনে হয় এটা কোনো প্রেতপুরী।
তাছাড়াও কালাচি গ্রাম থেকেও মানুষ চলে যাওয়ায় গ্রাম জনমানব শূন্য হয়ে যাচ্ছে।একে কোনো ভুতুড়ে গ্রাম বললেও ভুল হবে না।কারণ সেখানকার যেকোনো কোনো মানুষ যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারেন।
বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত এর কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে বের করতে পারেন নি।তাই এই গ্রাম থেকে গেছে অমিমাংশিত রহস্য হিসেবেই। তাই একে মায়াপুরীর গ্রাম বলা চলে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন