কোন মানুষই চিরদিন বেঁচে থাকতে পারে না। তাই মৃত্যু সর্বদা বিষণ্ন এবং বেদনার হয়। কিন্তু এই অনিবার্য সত্য কি কখনো সুন্দর হতে পারে? নিশ্চয়ই না। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এক সুন্দরতম মৃত্যুর কথা রয়েছে। স্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়; বরং একটি আত্মহত্যাকে সুন্দর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মূলত এভিলিন ম্যাকহেল নামক এক তরুণীর আত্মহত্যার পরমুহূর্তে তোলা একটি আলোকচিত্রকে বলা হয় “ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা “।
এভিলিন ম্যাকহেল ১৯২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। হেলেন এবং ভিনসেণ্ট দম্পতির নয় সন্তানের মধ্যে এভিলিন একজন। তার পিতা ১৯৩০ সালে ফেডারেল ল্যান্ড ব্যাংকের পরীক্ষক নিযুক্ত হলে তাদের পরিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে আসে। এভিলিনের মা হেলেন দীর্ঘদিন যাবত গুরুতর মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকার ফলশ্রুতিতে এভিলিনের বাবা মাকে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আদালতের রায়ে এভিলিনের বাবা নয় সন্তানের অভিভাবকত্ব লাভ করেন এবং নিউইয়র্কে চলে যান।
হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ হলে এভিলিন নারীদের সেনাবাহিনীতে পুলিশ হিসেবে যোগদান করেন এবং মিসৌরির জেফারসনে কর্মরত থাকেন। পরবর্তীতে তিনি এ চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে আসেন। এখানে এসে তার এক ভাইয়ের সাথে থাকতেন। সেসময় পার্ল স্ট্রিটের একটি বইয়ের দোকানে কাজ করতে থাকেন এভিলিন। তখন তার সাথে পরিচয় হয় ব্যারি রোডসের সাথে যিনি বিমান বাহিনী থেকে কার্যচ্যুত হয়ে কলেজে পড়াশোনা করছিলেন। কিছুদিন পর তারা বাগদান সম্পন্ন করেন।
১৯৪৭ সালের ৩০ এপ্রিল এভিলিন নিউইয়র্ক থেকে পেনিসিলভানিয়া যান ব্যারির বাড়িতে। পরদিন অর্থাৎ ০১ মে সকাল ৭টার ট্রেনে তিনি নিউইয়র্ক ফেরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ব্যারি তদন্তকারীদের জানান এভিলিনকে সেই সকালে বিদায় জানানোর সময়ে তিনি তার মাঝে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ দেখেননি।
তবে এভিলিনের ট্রেন সকাল ৯টা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছানোর পর সেখানেই তিনি তার সুইসাইড নোটটি লেখেন বলে ধারণা করা হয়। ঠিক কি কারণে মাত্র ২ ঘন্টার এক সফরে তিনি আত্মঘাতি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সে রহস্যের আর সমাধান করা যায়নি।
সকাল ১০টার পর তিনি অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ৮৬ তলার পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, এভিলিন লাফিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে মাত্র ১০ ফুট দূরে একজন নিরাপত্তারক্ষী দাঁড়িয়ে ছিলেন।
Image: The most beautiful suicide (1947)
এভিলিন ১৯৪৭ সালের পহেলা মে অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি বিল্ডিংয়ের নিচে ৩৪ নং স্ট্রিটে পার্ক করে রাখা জাতিসংঘের একটি লিমুজিনের উপর পতিত হন। তার মৃত্যুর প্রায় চার মিনিটের মাথায় রবার্ট সি ওয়াইলস নামক এক শিক্ষানবিশ আলোকচিত্রী তার একটি ছবি তোলেন যা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা এবং আলোচিত একটি আলোকচিত্র হিসেবে স্বীকৃত।
ছবিটির বিশেষত্ব হচ্ছে এভিলিনের শান্ত এবং স্বাভাবিক মুখ। আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যুর পরেও তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কেবল ঘুমিয়ে আছেন; মোটেও মৃত নন। তবে তার আশেপাশের ভাঙ্গা কাচ ও গাড়ির দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ছাদ থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় কত ভয়ংকর ছিল তার মৃত্যু।
আরও পড়ুনঃ
রবার্টের তোলা এই ছবির নাম দেয়া হয় The most beautiful suicide তথা ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা। সে বছরের ১২ মে LIFE ম্যাগাজিনে এ ছবিকে পিকচার অব দ্য উইক হিসেবে প্রকাশ করা হয়। এটি ছিল রবার্ট ওয়াইলসের প্রকাশিত প্রথম এবং শেষ আলোকচিত্র।
ডিটেকটিভ ফ্র্যাঙ্ক ম্যুরে অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ৮৬ তলার সেই পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে এভিলিনের কোট এবং একটি পকেটবুক পান যাতে তার শেষ কথাগুলো ছিল। এভিলিন তার বোন হেলেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-
“আমি চাই না আমার পরিবার বা পরিবারের বাইরের কেউ আমার কোন অংশও দেখুক। তুমি কি আমার মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলতে পারবে? আমি তোমাকে এবং আমার পরিবারকে মিনতি করে বলছি আমার জন্য কোন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিংবা স্মরণ সভার আয়োজন করবে না। আমার বাগদত্তা আমাকে জুনে বিয়ের জন্য বলেছে। আমি মনে করিনা আমি কারো যোগ্য স্ত্রী হতে পারবো। সে বরং আমাকে ছাড়াই বেশি ভালো থাকবে। আমার বাবাকে জানিও, আমার মাঝে মায়ের প্রবৃত্তিগুলো একটু বেশিই ছিল।”
এভিলিনের বোন হেলেন ব্রেনার তার মৃতদেহ শনাক্ত করেন। তারই শেষ ইচ্ছা অনুয়ায়ী তার দেহ পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। কোন কবর কিংবা স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়নি। তার বাগদত্তা ব্যারি পরবর্তীতে ফ্লোরিডায় চলে যান। জানা যায়, তিনি কখনো বিয়ে করেন নি।
ধারণা করা হয়, এভিলিনও তার মায়ের মতই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তবে তার আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ আর কখনোই জানা যাবেনা। মৃত্যু কখনো সুন্দর হতে পারেনা। রবার্টের এ আলোকচিত্র কেবল শিল্পের বিচারে সুন্দর বলে বিবেচিত হয়েছে। এ শিল্পের কারণেই সাধারণ এক তরুণী তার মৃত্যুর পর আলোচিত হয়ে ওঠে তারই মৃতদেহকে কেন্দ্র করে তোলা ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা নামক আলোকচিত্রের জন্য।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন