আমরা বিশ্বের দৃষ্টিনন্দিত ও মনভুলানো পাহাড়ের আর্শিবাদ পেয়েছি। অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে দেশের সেরা উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ গুলো সম্পর্কে জানার। বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য দীপ্তোজ্জ্বল পর্বতশৃঙ্গ এর কারুকার্য। আর সেই কারুকার্যের স্বর্গরাজ্যই যেন চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামের স্বপ্নিল ভূমির আদলে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে দেশের উঁচু পর্বতশৃঙ্গের সমাহার। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা ঢাল, বৃক্ষরাজি, পাখির কিচিরমিচির শব্দ যেন বাংলাদেশের প্রকৃতির দীপ্তময় স্বাক্ষর। পাহাড়ের রুপের জ্বলক যেন পর্যটকদের পুলকিত দৃশ্যপট তাইতো পর্যটকদের সমাগমে মুখরিত থাকে চট্টগ্রাম।
পাহাড়ের কৃতিত্ব ও বিশালতা পরিমাপ হয় তার উচ্চতার উপর ভিত্তি করে। পর্বত দেখা ও বিশ্লেষণ যেন বাঙালির চিরন্তন স্বভাব তাইতো সবাই প্রশ্ন খুজে পাহাড়ের বিশালতা ও অবস্থানের। তাই কৌতুহলী হৃদয়ের উত্তর খুজতে আলোকপাত করা হয়েছে বাংলাদেশের সেরা উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ সম্পর্কে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড়ের কৃতিত্ব ধারন করে আছে সাকা হাফং নামক এই পর্বতটি। চট্টগ্রাম বিভাগের বান্দরবান জেলায় এর অবস্থান। গতানুগতিক ধারনা অনুযায়ী কেওক্রাডং বা তাজিংডং কে সর্বোচ্চ শিখর মনে করা হতো ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত পরবর্তীতে ডিজিটাল পরিমাপের ফলে এখন সাকা হাফংকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিখর ঘোষণা করা হয়।
জিং ফ্লিন নামক এক ইংরেজ পর্বত আরোহী ২০০৫ সালে সর্ব প্রথম এই পাহাড়ে আহরন করেন। তখন তিনি এর শীর্ষের উচ্চতা পরিমাপ করেছিলেন ১০৬৪ মিটার বা ৩৪৫১ ফুট। রাশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্রের ক্রমধারায় স্থানাঙ্ক অনুযায়ী এর অবস্থান ২১.৭৮৬৩৯° উত্তর এবং ৯২.৬২° পূর্ব।
পরবর্তীতে এটি গুগল ম্যাপ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক মানচিত্র দ্বারা যাচাই করা হয়। এখানে মূলত ত্রিপুরা উপজাতির বসবাস তাদের নামের ধারা অনুযায়ী এই পর্বতের নাম সাকা হাফং রাখা হয়। ইয়াহিয়া খানের নির্দেশনায় তৎকালীন সময়ের মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ী সজল খালেদ সহর্চাযে ২০০৭ সালে প্রথম বাংলাদেশী দল এই পর্বতে আহরন করে।
সম্প্রতি ট্রাকিং ক্লাবের দুটি দল ২০১১ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিখরের উচ্চতা ৩৪৮৮ ফুট ও ৩৪৬১ ফুট পরিমাপ করেন। সর্বশেষ আপডেট সাপেক্ষে এর উচ্চতা ৩৪৬৫ ফুট বা ১০৫৬ মিটার। সাকা হাফংকে মূলত বাংলাদেশের এভারেস্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাকা হাফং যাওয়ার এই ট্রাকিং পথকে পর্বত প্রেমী মানুষের কাক্ষিত ট্রাকিং রুট হিসেবে অ্যাখায়িত করা হয়।
আপনি যদি কোন পাহাড় অনুসন্ধানী মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে এই স্বপ্নিল চূড়ায় যেতে চাইলে প্রথমে বান্দরবান আসতে হবে। তারপরে থানচি, রুমা বাজার, রেমাক্রি এই তিন রুট ব্যবহার করে সাকা হাফং যেতে পারবেন।
বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ এর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়ার কৃতিত্ব ধারন করে আছে এই পর্বত। দীর্ঘদিন ধরে জনগন মনে করে আসত জো তল্যাং হচ্ছে বাংলাদেশের উচ্চতম শিখর। তবে নাসার উপগ্রহের তথ্য অনুযায়ী স্পষ্ট হয় এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চূড়া।
আবার কয়েকটি স্যাটেলাইটের তথ্য অনুযায়ী দুমলং দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং জো তল্যাং তৃতীয় বৃহত্তর। জো তল্যাং মূলত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের পূর্ব দিগন্তকে রক্ষন করেছে। বান্দরবান জেলার থানচিতে অবস্থিত এই সুবিশাল পর্বত।
জো তল্যাং এর জো শব্দের অর্থ হলো বাওম ভাষায় মিজো যা ভারতের মিজোরাম থেকে উদ্ভব হয় কারন তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ বৃহত্তর ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর তল্যাং দ্বারা পাহাড় নির্দেশিত হয়। অ্যামেরিকা ও রাশিয়ার টপোগ্রাফিক মানচিত্র অনুসারে জো তল্যাং কে মোদক মুয়াল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অনেক পারর্দশী পর্বত আরোহীর ধারনা মতে এই পাহাড়ে বনরাজির সমাবেশ তুলনামূলক বেশি। সমস্ত পর্বত ভ্রমনকারীরা নির্দ্বিধায় বলতে বাধ্য হবে যে জো তল্যাং এর সর্বোচ্চ স্থানে আহরণ করা দেশের অন্যান্য পর্বতের তুলনায় বেশ কঠিন।
২০১৪ সালের তথ্য সাপেক্ষে এই সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ার দৈর্ঘ্য ৩৩৫৩ ফুট বা ১০২১.৯৯ মিটার। জো তল্যাং স্থানাঙ্ক অনুসারে অবস্থান যথাক্রমে ৪০.০৩৪° উত্তর এবং ৯২.৬° পূর্ব। এই শীর্ষ স্থান টিতে সর্বপ্রথম দুই পর্বত প্রেমী সুব্রত দাস নীতীশ ও বিজয় শঙ্কর আহরণ করেছিলেন। পর্বতরাজির সৌন্দর্যের ধারার অন্যতম স্বাক্ষর যেন জো তল্যাং ই রাখে।
সর্বপ্রথম বান্দরবান যেতে হবে পরবর্তীতে বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়ার জন্য বাস বা জিপ পাওয়া যায়। তারপরে থানচি থেকে নৌকায় করে রেমা ক্রি বাজার। এরপর দালায়ন পাড়া পর্যন্ত ৪ ঘন্টা হেটে যেতে হবে। এভাবে একদিনের মধ্য এই সৌন্দর্যময় পর্বত ঘুরে আসা সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ স্বপ্নের ভূবণ গ্রীনল্যান্ড এর আত্ম পরিচিতি
বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত হলো দুমলং। ব্যাক্তিগত ভাবে দাবি করা হয় এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। তবে পরিমাপের ধারনা সাপেক্ষে জো তল্যাংই হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিখর। এই সুবিশাল পর্বত বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়িতে অবস্থিত।
এটি রাঙ্গামাটি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত যার শিখরেরে উচ্চতা ৩৩১৪ ফুট বা ১০১০ মিটার। তবে জিপিএস রিডিং দ্বারা এর উচ্চতা ৩৩১৫ ফুট পাওয়া যায়। দুমলং এর স্থানাঙ্ক অনুযায়ী অবস্থানের সমন্বয় ২২.০৪১৪° উত্তর এবং ৯২.৫৮° পূর্ব। দুমলং এর পুরাতন নাম হলো রংটলাং।
এটি মূলত ছোট পাহাড়ি নদী ঝিরিবার পাশে অবস্থিত যা কয়েক কিলোমিটার উত্তরে রায়খান নদীর সাথে মিশে গিয়েছে। দুমলং পিকের উচ্চতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই এটি ২ য় না ৩ য় তার সঠিক ধারনা পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৪ সালের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী জো তল্যাং ই ২য় শিখর।
দুমলং পর্বত মূলত রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে অবস্থিত, বিলাইছড়িতে যাওয়া দুর্লভ কারন দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে রুমা বাজার থেকে খুব অল্প সময়েই যাওয়া যায়। তাহলে প্রথমে বান্দরবান থেকে বগা লেকে যেতে হবে এবং সেখান থেকে যে কোন একদিনের ভিতরই দুমলং থেকে ঘুরে আসতে পারবেন এবং বগা লেকে থাকার সুব্যাবস্থা রয়েছে।
নয়ন অবিরাম পর্বত রাজির অন্যতম পর্বত জোগি হাফং বান্দরবান ও মায়ানমার সীমান্তের ঠিক পাশেই অবস্থিত। বান্দরবান জেলার থানচি তে এর অবস্থান। বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ এর মধ্যে চতুর্থ চূড়া হিসাবে বিবেচিত এই জোগি হাফং।
এই সুবিশাল পর্বতের উচ্চতা ৩২৫১ ফুট বা ৯৯০.৯ মিটার। জোগি হাফং এর সৌন্দর্য ও কঠিন উপায়গুলোর কারনে পর্বত প্রেমীদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকে নিরন্তন। এই সৌন্দর্যময় চূড়াটি খুবই প্রতত্ন্য অঞ্চলে অবস্থিত ও মোদক রেঞ্জ নিয়ে গঠিত।
চমকপ্রদ বিষয় হলো এটি মোদক রেঞ্জ এর আওতাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিখর। এই পাহাড়ের বিশেষত্ব হলো এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কে খুব কাছ থেকে বিভক্ত করেছে। এর অবস্থান ও খ্যাতির জন্য পাহাড়টি বেশ জনপ্রিয়। স্থানাঙ্ক অনুযায়ী এর অবস্থান ২১.৭০° উত্তর এবং ৯২.৬° পূর্ব।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রুপের আভা ছড়ানোর দ্বীপ্তমান শিখা হিসাবে আলোড়িত রয়েছে এই পর্বত। এখানে যেতে হলে সর্বপ্রথম বান্দরবান যেতে হবে। সেখান থেকে বাস বা জিপে করে থানচি, তারপর থানচি থেকে নৌকা ব্যবহার করে রেমা ক্রি বাজার। রেমা ক্রি বাজার থেকে ২-৩ ঘন্টা হাঁটার পর দালায়ন পাড়া। এভাবে আপনি জোগি হাফং এর সৌন্দর্যময়তা এক দিনের মধ্য দেখে আসতে পারবেন।
বাংলাদেশের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীর অন্যতম একটি পর্বত হলো কেওক্রাডং। এটি বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ এর বিবেচনায় দেশের ৫ম বৃহত্তর চূড়া হিসাবে বিবেচিত। এই পর্বত মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি বান্দরবান জেলার রুমাতে অবস্থিত। কেওক্রাডং নামটি মূলত উপজাতিদের দেওয়া মারমা ভাষায় এর অর্থ হলো সর্বোচ্চ পাথরের পাহাড়।
দূর থেকে কেওক্রাডংকে দেখলে মনে হয় আকাশরেখার সমতূল্য। হ্যান্ড হেল্ড জিপিএস দ্বারা এর উচ্চতা পরিমাপ করা হয় ৩২৩৫ ফুট বা ৯৮৬ মিটার। এই পর্বতের সংলগ্নতায় দেশের সবচেয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ পর্যবেক্ষন করা যায় বলে এটি পর্বত প্রেমীদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা।
স্থানাঙ্ক বিবেচনায় এর অবস্থান ২১.০০° উত্তর আর ৯২.০০° পূর্ব। কেওক্রাডংয়ের শীর্ষে একটি ছোট আস্তানা ও সেনাবাহিনীর একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে যার উচ্চতা ৯৬৭ মিটার বা ৩১৭৩ ফুট। পর্বত আরোহীদের কাছে কেওক্রাডং ট্রাকিং রুট অন্যতম জনপ্রিয় ট্রাকিং রুট হিসাবে বিবেচিত।
দেশের যে কোন জায়গা থেকে কেওক্রাডং আসতে হলে প্রথমে বান্দরবান যেতে হবে। সেখান থেকে পরবর্তীতে সেখান থেকে রুমা বাজার। তারপর বগালেক এখানে আদিবাসিদের কটেজে থাকার সুবস্থাও রয়েছে। বগালেক থেকে সহজেই কেওক্রাডং যাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্ব অংশে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে অবস্থিত এই পাহাড়। বাংলাদেশের ৬ ষ্ঠ সর্বোচ্চ পর্বত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় এই পর্বতকে। দুমলং এর পরে এই শিখর রেং তল্যাং রেঞ্জের ২য় সর্বোচ্চ শিখর। মাইথাই জামা হাফং নামটি ত্রিপুরা ভাষা থেকে এসেছে যার অর্থ গাছপালার জন্য খারাপ পাহাড়ি জায়গা।
ত্রিপুরা ভাষায় হাফং দ্বারা পাহাড় বুযায়। শীর্ষ থেকে শিখরকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য স্ট্রিমের ঝিরি রুটটি অসাধারণ। গ্রামীন জিপিএস রিডিং অনুযায়ী এর উচ্চতা ৩১৭৪ ফুট বা ৯৬৭.৬ মিটার। স্থানাঙ্ক অনুযায়ী এর অবস্থান ২২° উত্তর এবং ৯২.৫৯° পূর্ব।
মাইথাই জামা হাফং যেতে হলে প্রথমে চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি থেকে বিলাইছড়ি হয়ে যেতে হবে।
থিংদৌল তে তল্যাং বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিখর। এই চূড়াটি লম্বোক সারি ব্যাপ্তির সর্বোচ্চ পয়েন্ট এবং দেশের সম্ভাব্য সপ্তম চূড়া হিসাবে বিবেচ্য। এটি বান্দরবান জেলার রুমাতে অবস্থিত।
এই পাহাড়ের তটভূমিতে রয়েছে থিংদৌল গ্রাম যার নাম অনুসারে এই পাহাড়ের নামকরন করা হয়। জি পি এস রিডিং অনুসারে এর চূড়ার দৈর্ঘ্য ৩১৪৯ ফুট বা ৯৬০ মিটার।ভৌগোলিক মানচিত্র অনুসারে এর অবস্থান ২১.৯১° উত্তর আর ৯২.৫৮° পূর্ব।
বাংলাদেশের উচ্চতম সাতটি পর্বতশৃঙ্গ এর মধ্যে সর্বোচ্চ পাহাড়ের স্বীকৃতি ছিল তাজিংডং এর। তবে ডিজিটাল পরিমাপের ধারায় এর উচ্চতা ৩০০০ ফুট এর কম হওয়ায় সর্বোচ্চ দশটি শিখরের মধ্য নেই।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন