পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় স্থানের কোন কমতি নেই। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ সকল স্থান মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সবসময়। তেমনই এক বিস্ময়কর স্থান ‘ইস্টার আইল্যান্ড’ । এখানকার সুবিশাল পাথরের মূর্তিগুলো মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ইস্টার আইল্যান্ডের স্থানীয় নাম রাপা নুই। মূলত এখানকার প্রাচীন অধিবাসীরা রাপা নুই বলে পরিচিত। এজন্য তারা এই দ্বীপটিকে রাপা নুই নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। এরা পলিনেশিয়ান আদিবাসী। তারা প্রথম কবে এই দ্বীপে এসেছিলো তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
২০০৭ সালের এক গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, পলিনেশিয়ান আদিবাসীরা ১২০০ সালে এখানে প্রথম বসবাস শুরু করে। ১৭২২ সালে ইউরোপীয়ান অধিবাসীরা যখন এই দ্বীপে আসে, তখন এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ২০০০-৩০০০ ছিলো। ১৮৮৮ সালে চিলি ইস্টার আইল্যান্ডকে নিজেদের সাথে সংযুক্ত করে নেয়।
পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে এখানকার অধিবাসীদেরকে এখানকার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ২০০৭ সালে ইস্টার আইল্যান্ড চিলির সংবিধানে চিলির সাথে সংযুক্ত “বিশেষ এলাকা” হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৭ সালে চিলির আদমশুমারী ইস্টার আইল্যান্ডে ৭,৭৫০ জনকে গণনা করেছে যাদের মধ্যে ৩,৫১২ জন নিজেদেরকে প্রাচীন রাপা নুই আদিবাসী বলে দাবি করেছিলো।
ইস্টার আইল্যান্ড নামটি দিয়েছিলেন ডাচ্ অনুসন্ধানী Jacob Roggeveen। তিনি ১৭২২ সালের ৫ এপ্রিল এই দ্বীপটি আবিষ্কার করেছিলেন। সে দিনটি ছিলো ইস্টার সানডে। সেখান থেকেই দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। এর সরকারি স্প্যানিশ নাম “Isla de Pascua” যার অর্থও ইস্টার আইল্যান্ড। এ দ্বীপের পলিনেশিয়ান নাম রাপা নুই।
ইস্টার আইল্যান্ডকে পৃথিবীর অন্যতম জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এর আশেপাশে কোন লোকালয় নেই। সবচেয়ে কাছের লোকালয় হিসেবে রয়েছে Pitcairn নামের একটি দ্বীপ। যদিও এর অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৫০ জন।
এটি ইস্টার আইল্যান্ড থেকে ২,০৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সবচেয়ে কাছের শহর Rikitea যার অধিবাসী সংখ্যা ৫০০ জনের কিছু বেশি। এই শহরটি ইস্টার আইল্যান্ড থেকে ২,৬০৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এসব কারণেই এ দ্বীপটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলা হয়।
ইস্টার আইল্যান্ড বিখ্যাত হওয়ার পেছনের প্রধান কারণটি হচ্ছে এখানকার সুবিশাল পাথরের মূর্তিগুলো। রাপা নুই ভাষায় যাদেরকে মোয়াই বলা হয়। কার্বন পরীক্ষা থেকে ধারণা করা হয়, এ সকল মূর্তি খোদাই করা হয়েছিলো ১১০০-১৬৮০ সালের মধ্যে। এখন পর্যন্ত ৮৮৭ টি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে এই দ্বীপে এবং বিভিন্ন জাদুঘরে।
প্রায় সময় এসব মূর্তিকে “ইস্টার আইল্যান্ডের মাথা” বলে অভিহিত করা হয়। পরিপূর্ণ মূর্তির সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগ মূর্তিই কেবল মস্তক অথবা উরু পর্যন্ত খোদাই করা। পরিপূর্ণ মূর্তিগুলো হাঁটু গেড়ে বসার ভঙ্গিতে খোদাই করা আছে। ৯৫% মোয়াই তৈরি করা হয়েছে ইস্টার আইল্যান্ডে অবস্থিত আগ্নেয়গিরি রানো রারাকু থেকে।
এই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হতে প্রাপ্ত ঘনীভূত লাভা খোদাই করে এ সকল মোয়াই তৈরি করা হয়েছিলো। ৫/৬ জন লোকের একটি দলের এরকম একটি মোয়াই তৈরি করতে সময় লাগত প্রায় এক বছর। কেবলমাত্র চারভাগের একভাগ মোয়াই দ্বীপটিতে স্থাপন করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক মোয়াই রয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে। বাকি মূর্তিগুলো রানো রারাকু আগ্নেয়গিরির খাদে রয়ে গিয়েছে।
ইস্টার আইল্যান্ডে অবস্থিত সবচেয়ে দীর্ঘ মোয়াইটির নাম “পারো”, যা লম্বায় ৯৮৯ সে.মি.। মোয়াই পারোর ওজন প্রায় ৮২ টন। এই মোয়াইটির মাথায় রয়েছে একটি লাল রঙের সছিদ্র লাভাপিন্ড যা এর ওজনকে আরও ১১-১২ টন বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এ সকল মূর্তিগুলোকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, এসব মূর্তি খোদাইকারীরা ছিল পবিত্র আত্মাদের ভান্ডার। পলিনেশিয়ান ধর্মমতে এসব মোয়াই এর মাঝে “মানা” নামক একটি পবিত্র আত্মার সত্তা অবস্থান করে। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস এ সকল মোয়াই পলিনেশিয়ান সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতিনিধিত্ব করে।
পাথরের তৈরি যেসকল সমতল মঞ্চের মত কাঠামোর ওপর মোয়াই থাকে তাদেরকে আহু বলা হয়। জানামতে ইস্টার আইল্যান্ডে আহু আছে ৩১৩ টি। এদের মধ্যে ১২৫ টি আহু মোয়াই বহন করছে। সাধারণত একটি আহুতে একটি মোয়াই অবস্থান করে। মোয়াই এর সংখ্যা এবং বিভিন্ন স্থানে থাকার কারণে বাকি আহুগুলো অব্যবহৃত আছে। রানো রারাকু আগ্নেয়গিরি থেকে এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে আহু টোঙ্গারিকি, যাতে সবচেয়ে লম্বাকৃতির মোয়াই রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আহু হল আকিভি, নাউনাউ, তাহাই, ভিনাপু ইত্যাদি।
ইস্টার আইল্যান্ডের আরকটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় বস্তু হচ্ছে এখানকার পাথরে তৈরি দেয়াল। আহু ভিনাপুর নিকটবর্তী একটি পাথরের দেয়াল এই দ্বীপটির অন্যতম স্থাপনা।
রাপা নুই এ দুই ধরনের প্রাচীন বাড়ির ধারণা পাওয়া যায় যা পাথরের তৈরি। যাদের মধ্যে উপবৃত্তাকার ঘরগুলোকে Hare Paenga বলা হয়। আরেক ধরনের ঘর যেগুলো বৃত্তাকার, সেগুলোকে Hare Oka বলা হয়। এছাড়াও প্রায় একই রকম বৃত্তাকার কিছু ঘরকে Tupa বলা হয়। এসব Tupa তে মূলত জ্যোতিষী ও ধর্মীয় গুরুরা বাস করতেন।
ইস্টার আইল্যান্ড এবং পার্শ্ববর্তী Motu Nui দ্বীপের মধ্যে বেশ কিছু গুহা আবিস্কৃত হয়েছে । এদের মধ্যে কিছু গুহায় মানুষের ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয় গুহাগুলো ব্যবহৃত হত বৃক্ষ রোপণের স্থান এবং দূর্গ হিসেবে। এমনকি সৈন্যদের অবস্থানের গোপন স্থানও রয়েছে এসব গুহায়। অনেক গুহাকে ঘিরে রয়েছে রাপা নুই অধিবাসীদের বিভিন্ন মিথ।
রাপা নুই অধিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের নাম Tapati যা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি ১৯৭৫ সাল থেকে ইস্টার আইল্যান্ডে পালিত হয়ে আসছে। উৎসব চলাকালীন সময়ে দ্বীপের অধিবাসীরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতিটি দলে একজন করে রাণী থাকে দলনেতা হিসেবে। এ দুই দলের মাঝে বিভিন্ন খেলাধুলা, নাচগান, কাঠের মূর্তি খোদাই করা সহ আরও নানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিজয়ী দলকে দ্বীপের রাণী উপাধিতে ভূষিত করে মুকুট পড়িয়ে দেয়া হয়।
ইস্টার আইল্যান্ডের ঐতিহ্যগত ভাষা হচ্ছে রাপা নুই ভাষা। এটি পূর্ব পলিনেশিয়ার একটি ভাষা। এ ভাষার সাথে হাওয়াই এবং তাহিতির ভাষার কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। তবে ইস্টার আইল্যান্ডের সরকারি ভাষা স্প্যানিস। ধারণা করা হয়, ২,৭০০ রাপা নুই অধিবাসী তাদের ঐতিহ্যগত ভাষা জানে। তবে রাপা নুই ভাষাটি বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। যেহেতু এটি অধিবাসীদের সরকারি ভাষা নয়, তাই খুব একটা ব্যবহার করা হয়না। যার কারণে ভাষাটি বিলুপ্তির পথে।
ইস্টার আইল্যান্ডকে ঘিরে থাকা রাপা নুই ন্যাশনাল পার্ককে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কোর ১৯ তম অধিবেশনে এ ঘোষণা দেয়া হয়। রাপা নুই ন্যাশনাল পার্কে প্রতিবছর বহু পর্যটকের পদচারণা লক্ষ করা যায়। ২০১২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে বছর এই পার্কে ৫২,২০২ জন পর্যটক এসেছিলেন।
ইস্টার আইল্যান্ডে অবস্থিত মোয়াই সব সময় কৌতুহলী মানুষের কাছে একটি দর্শনীয় বস্তু হিসেবে পরিচিত। লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের পাথরের মূর্তিগুলোই মূলত পৃথিবীর সাথে ইস্টার আইল্যান্ডকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে।
ইস্টার আইল্যান্ডের বাইরে বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে কিছু মোয়াই থাকলেও মানুষের সীমাহীন কৌতুহল পরিপূর্ণ রূপে মেটাতে পারে কেবল এ দ্বীপে অবস্থিত মোয়াইগুলো। যে কারণে প্রায় প্রতি বছরই বহু মানুষ ছুটে যায় ইস্টার আইল্যান্ডে বিস্ময়কর সব পাথুরে স্থাপনা দেখতে।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ইনফরমেটিভ আর্টিকেল।ধন্যবাদ