সালাতে হাত বাঁধার নিয়ম নিয়ে আমাদের দেশে কম বিতর্ক নেই৷ আসলে এসকল বিষয় কখনোই বিতর্কের কোনো বিষয় নয়। বরং আমরা হাদিসের আলোকে দেখতে পাই এখানে বেশ উদারতা রয়েছে। হাত বাঁধা নিয়ে তেমনি আরও একটি প্রশ্ন হচ্ছে সালাতে রুকুর পরে হাত বাঁধা নিয়ে।
এ বিষয় নিয়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) ও শাইখ নাসিরউদ্দিন আলবানী (রহ.) ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। তাই তাদের এ ফতোয়া নিয়েও বেশ আলোচনা রয়েছে। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.) তাঁর রচিত “সালাতের মধ্যে হাত বাঁধার বিধান” বইয়ে তাদের মতামত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখান থেকেই এই দুই মহান মনিষীর মতামত হুবহু তুলে ধরছি।
তবে প্রথমেই বলে রাখি সালাতে হাত বাঁধা একটি মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নত। আর হাদিসের আলোকে ইমামদের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকায় তাদের মত অনুযায়ী আমল করলেও কোনো সমস্যা হবে না। আর মূল কথা হলো সালাতে হাত যদি কেউ নাও বাঁধে তাহলে সালাতের কোনো সমস্যা হয় না। তবে আমাদের উচিত দলিলের দিক থেকে উত্তম আমল কে অনুসরণের চেষ্টা করা।
সালাতে রুকুর পরে হাত বাঁধা নিয়ে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতামতঃ
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার লিখছেন, যেহেতু রুকুর পরে হাত ঝুলিয়ে রাখার কথা হাদীসে নেই সেহেতু এ সকল হাদীস থেকে প্রতীয়মান যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগণ রুকুর আগের ন্যায় রুকুর পরেও হস্তদ্বয় একত্রিত রাখতেন এবং উভয় সময়ে এরূপ করা এ সকল হাদীসের নির্দেশনা ।
সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায (রহ.) এবং সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফকীহগণ রুকুর পরে হস্তদ্বয় একত্র করে দেহের উপর রাখাকে ‘সুন্নাত’ বা সুন্নাহ নির্দেশিত ‘মুসতাহাব’ বলে গ্রহণ করেছেন।
এর বিপরীতে আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) এ কর্মটিকে একটি ‘বিভ্রান্তিময় বিদআত’ বলে উল্লেখ করেছেন । ‘সিফাতু সালাতিন নাবিয়্যি (নবীজির সাঃ এর নামায) গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেন:
“রুকুর পরে দাঁড়ানো অবস্থায় হস্তদ্বয় বুকের উপর রাখা বিদআত ও বিভ্রান্তি, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই । কারণ সালাত বিষয়ক হাদীসের সংখ্যা অনেক; কিন্তু কোনো হাদীসে এ কথা বর্ণিত হয় নি। এর কোনো ভিত্তি থাকলে একটি সূত্র হলেও তার বর্ণনা আমরা পেতাম । আমার জানা মতে সালাফ সালিহীনের কেউ এ কর্ম করেন নি এবং কোনো মুহাদ্দিস এ বিষয়টি উল্লেখ করেন নি।”
এর বিপরীতে শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায (রহ.) ‘রুকু থেকে উঠার পর মুসল্লী হস্তদ্বয় কোথায় রাখবে’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন । এ পুস্তিকায় তিনি রুকুর পরে দাঁড়ানো অবস্থায় হস্তদ্বয় একত্রিত করে দেহের উপর রাখাই সুন্নাত বলে মত প্রকাশ করেছেন। শাইখ আলবানী (রহ.) এর আপত্তিগুলো তিনি আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
“আমাদের ভাই আল্লামা শাইখ নাসিরুদ্দীন এ কথা বলেছেন…। তাঁর বক্তব্যের উত্তরের কয়েকটি দিক রয়েছে । প্রথমত তিনি রুকুর পরে দাঁড়িয়ে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখাকে বিভ্রান্তিময় বিদআত বলে নিশ্চিত করেছেন । এটি সুস্পষ্ট ভুল।
আরও পড়ুনঃ
আমাদের জানা মতে তাঁর পূর্বে কোনো আলিম এ কথা বলেন নি । তাঁর এ বক্তব্য ইতোপূর্বে আলোচিত (সালাতের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় হস্তদ্বয় একত্রিত রাখার) হাদীসগুলোর বিপরীত। তাঁর ইলম, মর্যাদা, অধ্যয়নের ব্যাপকতা এবং সুন্নাত বিষয়ে তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । মহান আল্লাহ তাঁর ইলম ও তাওফীক বৃদ্ধি করুন।
তবে তিনি এ মাসআলায় সুস্পষ্টভাবে ভুল করেছেন । আর প্রত্যেক আলিমেরই কিছু কথা গ্রহণযোগ্য ও কিছু কথা অগ্রহণযোগ্য থাকে । এ বিষয়ে ইমাম মালিক বলেছেন: ‘আমাদের প্রত্যেকেই অন্যের কিছু কথা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমাদের কিছু কথা প্রত্যাখ্যান করা হয় । একমাত্র ব্যতিক্রম রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।’ তাঁর আগে ও পরে আলিমগণ একই কথা বলেছেন । এতে তাঁদের অমর্যাদা বা অবমূল্যায়ন হয় না। বরং তাঁরা একটি বা দুটি পুরস্কারের মধ্যে থাকেন।
(শাইখ আলবানীর বক্তব্য বিস্তারিতভাবে খণ্ডন করার পর তিনি বলেন) আমাদের এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আমাদের ভাই মর্যাদাময় শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন এ মাসআলায় যা বলেছেন তা তাঁর মত প্রমাণ করে না, বরং তাঁর মত খণ্ডন করে ।
আলিমদের অনুসৃত মূলনীতিগুলো লক্ষ্য করলে এবং ভালভাবে চিন্তা ও গবেষণা করলে তা সুস্পষ্ট হয় । মহান আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকেই তাঁর সহনশীলতা ও মার্জনা দিয়ে ধন্য করুন । আশা করা যায় যে, আমরা এখানে যে আলোচনা করলাম তা পাঠ করার পর তাঁর কাছে সত্য সুস্পষ্ট হবে এবং তিনি সত্যের দিকে ফিরে আসবেন ।
সত্য তো মুমিনেরহারানো সম্পদ, যখনই তিনি তা পান তা গ্রহণ করেন । মহান আল্লাহর প্রশংসায় তিনি (শাইখ আলবানী) সত্য অনুসন্ধানী এবং সত্যের পথের অবিচল পথিক । তিনি সত্যকে প্রকাশ করতে ও সত্যের পথে আহ্বান করতে তাঁর বহুমুখি শ্রম ব্যয় করে চলেছেন ।”
[তথ্যসুত্রঃ সালাতের মধ্যে হাত বাঁধার বিধান; অধ্যায় ২.৩.১১ (রুকুর পরে হাত বাঁধা) পৃষ্ঠা ৮২ ] ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.)
মন্তব্যঃ
স্যারের বই থেকে জানতে পারি অনেক হানাফি স্কলারদের মতেও সালাতে রুকুর পরে হাত বাঁধা সুন্নত। তাই এটি আমল করা যেতে পারে। আর যুক্তির দিক দিয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। আল্লাহ ভালো জানেন।
তবে যেহেতু বিষয়টি মুস্তাহাব আমলের অন্তর্ভুক্ত। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ওয়ায়েল ইবন হুজর এবং সাহল ইবন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার বর্ণিত হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইমামদের দৃষ্টিতে এর পক্ষে বিপক্ষে উভয় মত রয়েছে। তাই আমরা বলব যিনি ছেড়ে দেন তিনিও সুন্নাহ সম্মত আমল করছেন। আবার যিনি রুকু থেকে উঠে হাত আবার হাত বাধছেন তিনিও সুন্নাহ সম্মত আমল করছেন। এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি বা বিতর্ক করা মোটেও সুন্নাহ সম্মত নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা গুনাহের দিকে নিয়ে যায়।
সালাতে রুকুর পরে হাত বাঁধা নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন “সালাতের মধ্যে হাত বাঁধার বিধান” ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.) এর বইটি।
মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞানী, সবকিছু তিনিই ভালো জানেন।
জাযাকাল্লাহ খাইরান।