আমাদের উপমহাদেশে শবে বরাতের রাতটি আমরা সাধারণ মুসলিমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত হিসেবে পালন করে থাকি। এ রাতকে সামনে রেখে সাধারণ মুসলিমরা নফল ইবাদত বন্দেগি, দুয়া-মুনাজাত ও রোজা রেখে থাকেন৷ শুধু সাধারণ মুসলিমরা নয় বরং কিছু আলেমরাও এ দিনটিকে পালন করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ রাতকে কেন গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদতের রাত হিসেবে গন্য করা হয়? এ রাতে ইবাদতের জন্য মসজিদে কেন নামাজের আয়োজন করা হয়? ইসলামী শরিয়তে প্রচলিত এ শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি কী?
যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রচলিত শবে বরাত নামক একটি রাতকে নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিদ্যমান বিতর্কের যেন শেষ নেই৷ একদল বলেন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের রাত, আর বিজ্ঞ স্কলাগণ বলেন এ রাতকে উদ্দেশ্য করে অতিরিক্ত ইবাদত করা, মসজিদে জমায়েত হয়ে নফল নামাজ পড়া বিদআত। যাই হোক আমরা সে সকল বিতর্কে না গিয়ে পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি কি? এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আপনাদের বিশুদ্ধ দলিল ভিক্তিক একটি স্পষ্ট ধারনা দেওয়া চেষ্টা করবো, ইং শা আল্লাহ্।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
‘শবে বরাত’ একটি পরিভাষা, ফারসিতে ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত। আর ‘বারায়াত বা বরাত’ শব্দের ফারসি অর্থ সৌভাগ্য বা ভাগ্য। অর্থাৎ ফারসিতে শবে বরাত অর্থ সৌভাগ্য বা ভাগ্য রজনী।
আবার ‘বারায়াত’ কে যদি আরবী শব্দ হিসেবে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরােক্ষ অর্থে মুক্তি।
যেমন কুরআন মাজীদে ‘সূরা বারায়াত’ রয়েছে যা ‘সূরা তাওবা’ নামেও পরিচিত। যেমন মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ঘােষণা।”[সূরা তাওবা-০১]
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। তবে ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে। এ প্রসংঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“তােমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তােমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে?”(সূরা কামার-৩৪)
এখন আমরা শবে বরাত শব্দটাকে যদি সরাসরি আরবীতে তর্জমা করতে চাই, তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। তবে আমাদের একটি কথা জেনে নেওয়া উচিত, এরকম অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন।
যেমন ‘গােলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা এবং উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল ‘কিশাের‘ আর ফারসীতে এর অর্থ হল ‘দাস’। মূল কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য বা ভাগ্য।
ইসলামি শরিয়তে একটি বিষয়ের শর’ঈ ভিক্তি নিয়ে আলোচনা করতে হলে, প্রথমেই আমাদের খুঁজে দেখতে হবে পবিত্র কুরআনে কারিমে এ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে!
শাব্দিক অর্থে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত যাই বলা হোক না কেন, এ আকৃতিতে শব্দটি পবিত্র কুরআন মাজীদে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। আরও সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাত বলতে কোন শব্দের আলােচনা নেই। সরাসরি তাে দূরের কথা আকার ইংগিতেও উল্লেখ নেই।
যারা প্রচলিত শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি প্রমাণ করতে চায় তারা পবিত্র কুরআন থেকে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করে থাকেন। যেখানে বলা হয়েছে-
“হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতাে এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।”[সূরা দুখান: ১-৪]
তারা এখানে ‘বরকতময় রাত’ বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের এই ভ্রান্ত তাফসির, তাদের স্পষ্ট অজ্ঞতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। মূলত তারা একটি শব্দ প্রমাণ করতে গিয়ে আল্লাহর কালামের বিকৃত করার মত অপরাধ করেছেন।
কেননা লক্ষ্য করুন, পবিত্র কুরআনে বরকতময় রাত বলতে বলতে স্পষ্ট ভাবেই কদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সকল মুফাস্সিরগণ সূরা দূখানের বরকতময় রাতের তাফসির বা ব্যাখ্যা সূরা কদর দ্বারা করে থাকেন৷ যেমন-
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“নিশ্চয়ই আমি এটি (আল-কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল, এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশতাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।”[সূরা কাদর, ১-৫]
অতএব, বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদরের রাত। লাইলাতুল বারায়াত নয়। একথায় সূরা দুখানের প্রথম চার আয়াতের তাফসির হল সূরা আল-কদর। আর পবিত্র কুরআনে কারীমের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা-ই হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
একটি স্পষ্ট প্রমাণ লক্ষ্য করুন, যদি সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয়, তাহলে এ আয়াতের তাফসির দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের ১৫ তারিখ নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি, পবিত্র কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বলেন-
“রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে।”[সূরা বাকারার-১৮৫]
সূতরাং পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট আয়াত এবং অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল, উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানাে হয়েছে।
একঃ শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি যারা সূরা দুখানের প্রথম চার আয়াত দ্বারা প্রমান করতে চান। তাদের দলিল হল শুধু মাত্র একজন তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রহ.)-এর একটি মত।
হযরত ইকরামা (রহ.) বলেন-
“বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনেরো তারিখের রাতকেও বুঝানাে যেতে পারে।“
এখন আমাদের মন্তব্য হচ্ছে, তিনি যদি এটা বলেও থাকেন, তাহলে এটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। যা সরাসরি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিরােধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য হতে বাধ্য।
অর্থাৎ এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত করা হয়, তাহলে শবে কদরের ব্যাখ্যা কি হবে? অগ্রহণযোগ্য হয়ে পরে কিনা? অথচ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিস দ্বারা তা স্পষ্ট উল্লেখিত।
দুইঃ সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানাে হয়েছে। যেমন-
সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকার অর্থ শবে বরাত’ নেওয়া কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। [তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন]
তিনঃ এটা স্পষ্টত যে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর, মধ্য শাবান মাসের পনেরো তারিখের রজনী নয়।
এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেছেন-
“কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”[তাফসীরে কুরতুবী]
সুতরাং তাবেয়ী ইকরামা (রহ.) সূরা দূখানের বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা স্পষ্ট ভুল। তাই ভুল প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও তা প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী।
তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা শবে বরাতের শর’ঈ ভিক্তি প্রমাণের চেষ্টা করেণ, তারাও ভুল বর্ণনা করেছেন। আবার এমনও হতে পারে তাবেয়ী থেকে তারা কেউ ভুল শুনে থাকতে পারেন, অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তার নামে বানােয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।
ইসালামি শরিয়তে কোনো একটি বিষয়ের শর’ঈ ভিক্তি প্রামাণ দ্বিতীয় দলিল পেশ করা হবে সহিহ হাদিসের অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর বানী বা মৌন সম্মতির।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, হাদিসে লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত রয়েছে কিনা? বিশ্বাস করুন সত্যিই হাদিসের কোথাও আপনি ‘শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত’ নামের কোন রাতের নাম খুজে পাবেন না। যে সকল হাদিসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে, তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থ মধ্য শাবানের রাত্রি।
অর্থাৎ আমাদের সমাজে আমরা যে শবে বরাতের শর’ঈ ভিক্তি প্রমাণ করতে চাই, আরবিতে সেটিকে বলা হয় ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান‘। আর মধ্য শাবানের রাত্রি বলতে শাবান মাসের ১৫ তারিখের দিবাগত রাতে বুঝানো হয়।
শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দটি আল-কুরআনে নেই, হাদিসের কোথাও নেই। বরং এটা মানুষের বানানাে একটি শব্দ। কি আশ্চর্যের বিষয়, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে, অথচ এর কথা আল-কুরআনে ও সহীহ হাদিসের কোথাও নেই। এ ব্যাপারটি অবাক হওয়ার মত।
পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসের একমাত্র বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা সালফে-সালেহীন থেকে গ্রহন করাই হলো আহলে সুন্নাত ও জমাতের আকিদা।
আপনারা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন সাহাবা, তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ী বা চার প্রসিদ্ধ ইমাম কারো কাছ থেকেই শবে বরাত বলতে কোন শব্দ প্রমানিত নয়।
বরং সহিহ হাদিস অনুযায়ী তাদের ভাষায়ও শব্দটি ছিল ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান‘। আর এই রাতকে সামনে রেখে তারা কেউ কোন স্পেশাল নফল নামায বা রোজা রেখেছেন এমন একটিও সহিহ বর্ণনা খুজে পাওয়া যায় না৷
এমনকি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের নির্ভরযোগ্য ফিকহের কিতাবে কোথাও শবে বরাত নামের কোন শব্দ পাবেন না। অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলাে আলােচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি।
তাঁরা প্রামনিত ছোট-বড় সকল নফল নামায ও রোজার কথা আলোচনা করেছেন। তাই শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন।
সুতরাং এ রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানাে একটি বিদ’আত, যা পবিত্র কুরআন বা হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয় ।
ইসলামে শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি কতটুকু তা হয়তো এখন অনেকটাই পরিস্কার। তবে শত শত বছর ধরে প্রচলিত এই ধারা সাধারণ মানুষের মনে খুব ভলো ভাবেই এটে গেছে। তাই বিশ্বাস ও আমলে শবে বরাত এখন রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
যারা এ রাতটি পালন করে, তারা বিশ্বাস করেন শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা’আলা সকল মানুষের ও প্রানীর ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন৷ সকলের আগামী এক বছরের রিজিক বরাদ্দ, এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরী করা হয়।
পাশাপাশি এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয়, ইবাদত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয়। এ রাতে নাকি পবিত্র কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে। শবে বরাতের রাতে গােসল করে নামায পড়াও সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। এই শবে বরাতের রাতে মৃত ব্যক্তিদের রূহ দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে।
আবার এ রজনী পালনের জন্য হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয়। ভালো মন্দ খাবার এ রাতে খেতে হয়, তাহলে আগামী এক বছর ভালো রিজিক হবে। এমনকি বাড়ীতে বাড়ীতে মিলাদও পড়া হয়।
সরকারি ছুটি পালিত হয়। কোথাও আবার কবরস্থান গুলাে পর্যন্ত আগরবাতি ও মােমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়। লােকজন দলে দলে কবরস্থানে যায়, কবর যিয়ারত করার জন্য৷ পরের দিন সিয়াম (রােযা) পালন করা হয়।
যারা শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি রয়েছে বিশ্বাস করেন, তারা এ দিন মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলিতে যাওয়া শুরু করেন। এমনকি যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও জুমু’আয় মাসজিদে আসে না, তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে।
মাসজিদ গুলিতে মাইক চালু করে ওয়াজ নসীহত করা হয়। শেষ রাতে সমবেত হয়ে সম্মিলিত দুআ-মুনাজাত করা হয়। বহু লােক এ রাতে ঘুমানােকে অন্যায় পর্যন্ত মনে করে থাকে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একশত রাকাত বা শত রাকাত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয়।
সাধারণ লােকজন ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে হুজুর! শবে বরাতের সালাতের নিয়ম ও নিয়্যতটা একটু বলে দিন। ইমাম সাহেব আরবী ও বাংলায় নিয়্যাত বলে দেন। কিভাবে সালাত আদায় করবে, কোন রাকা’আতে কোন সূরা তিলাওয়াত করবে তাও বলে দিতে কৃপণতা করেন না।
আবার শবে বরাত রাতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাত তাই যদি এ রাতে ইমাম সাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব মাসজিদে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে কোথাও আবার তাদের চাকুরি যাওয়ার উপক্রম পর্যন্ত হয়ে যায়। এর অনেক প্রমাণ খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
ইসলামে প্রচলিত শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয়। তবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী শাবান মাসের মধ্য রজনী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। কেননা এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেন। এটা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত।
যেমন হাদিস শরীফে বলা হয়েছে-
‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’ [ইবনে মাজাহ, তাবারানি]
এই অর্থের হাদিস কাছাকাছি শব্দে প্রায় ৮ জন সাহাবী থেকে বর্নিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রা.) সহ বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু সনদ রয়েছে দুর্বল এবং কিছু সনদ ‘হাসান’ রয়েছে পর্যায়ের। তবে সামগ্রিক বিচারে হাদিসটি সহীহ বলে বিবেচিত হয়েছে।
শাইখ আলবানী (রহ.) বলেছেন-
‘‘হাদীসটি সহীহ। কেননা তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।“[সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ]
তাই এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাবান মাসের মধ্য রাতটি হলো একটি বরকতময় রাত। আর রাতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সকল বান্দাদের কে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এই ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্বা অন্য কোন আমলের প্রয়োজন আছে কি না তাও উক্ত হাদিসে করা হয়নি।
যদি ইসলামে প্রচলিত শবে বরাতের শর’ঈ ভিক্তি থাকে তবে অবশ্যই শাবান মাসের এ রাত্রিতে সবার ভাগ্য অনুলিপির হাদিসও থাকবে। কেননা সহিহ হাদিস ব্যতিত এর কোন ভিক্তি হতে পারে না!
তবে সামান্য কিছু হাদিস থেকে পাওয়া যায়, এ রাতে সাবার ভাগ্য অনুলিপিত করা হয়৷ অর্থাৎ পরবর্তী এক বছরের জন্য সবার হায়াত-মউত ও রিযক ইত্যাদির নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু হাদিসে থাকলেই প্রত্যেক হাদিস গ্রহন করা যাবে না, যদি হাদিসটি তার সনদ ও মতনের মানদন্ডে সহিহ প্রমানিত না হয়৷
এখন আমরা যদি এই সকল হাদিসগুলোর সনদের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদিসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। অর্থাৎ এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য একটি হাদিসও বর্ণিত হয় নি।
সহিহ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবানের ফযীলত বিষয়ে আরো কিছু হাদিস লক্ষ্য করা যায়৷ যে হাদীসগুলোতে এ রজনীতে সাধারণভাবে দোয়া- মোনাজাতের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
আমরা আরো দেখতে পাই, এসকল হাদিসে এ রাতে আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
প্রকৃত অর্থে শাবান মাসের মধ্য রাতে এসবে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য একটি হাদিসও নেই। এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদিসগুলো খুবই দুর্বল, বানোয়াট বা জাল হাদিস।
যদিও প্রচলিত শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি প্রমানের একটিও সহিহ হাদিস নেই, তবে মধ্য শাবানের রাত্রি নিয়ে বর্ণিত কিছু হাদিসে, এ রজনীতে সালাত আদায় ও দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে এ সকল হাদিসে সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাকআত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত কোন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়নি। শুধুমাত্র সাধারণভাবে এ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি কিছু হাদিসে এসেছে।
কিন্তু এ অর্থে যতগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা প্রায় সবই বানোয়াট। দু-একটি হাদীস দুর্বল হলেও বানোয়াট নয়। তাই সন্দেহ যুক্ত হাদিসে আমল করার যুক্তি কি?
যেখানে শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয়, সেখানে নির্ধারিত সালাতের কি প্রয়োজন!!
যদিও শাবান মাসের মধ্য রজনী বিষয়ক অন্য কিছু হাদিসে এ রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ সুরা পাঠের মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। আর এ সালাতের বিশেষ ফযীলতের কথাও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে প্রসিদ্ধ সকল মুহাদ্দিসগণ সর্বসম্মত মত হয়েছেন, এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদিস জাল বা বানোয়াট । হিজরী ৪র্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ (সা.)-এর নামে বানিয়ে এ হাদিসগুলো প্রচার করা হয়েছে।
এ জাতীয় কয়েকটি জাল ও বানোয়াট হাদিস উল্লেখ করছি। যেমন-
‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকআতে ৩০বার সুরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকআত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’
উক্ত হাদিসটি বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। [ইবনুল কাইয়িম, নাক্বদুল মানকুল]
১০০ রাক‘আত, প্রতি রাক‘আতে ১০ বার সুরা ইখলাস।
শবে বরাতের শর’ঈ ভিক্তি প্রমানে বা মধ্য শাবানের রজনীতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে দিকে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেন-
“মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এ রাত্রিতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।” [মিরক্বাতুল মাফাতীহ]
ঐ সময়ের মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়িয এ অর্থে কিছু হাদিস বানিয়ে প্রচার করেন। এ অর্থে ৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিওিহীন।
এ সম্পর্কে প্রথম হাদিসটি আলী (রা.)-এর সূত্রে রাসূল (সা.) এর নামে বলা হয়েছে-
“যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ও ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে, সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে, আল্লাহ তায়ালা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন।
লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরির্বতন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, যারা তার পাপরাশি মুছে দেবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে।
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লাখ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে…। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে মহান আল্লাহ তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।”
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল। এর বর্ণনাকারীগণের কেউ অজ্ঞাত পরিচয়ের এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত।[ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু‘আত, মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার মাসনু]
এ সম্পর্কে দ্বিতীয় জাল হাদীসটিতে জালিয়াতগণ ইবনু উমার (রা)-এর সূত্রে রাসূল (সা.)-এর নামে বলেছেন-
‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে এক শত রাকআত সালাতে এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তা‘য়ালা তার কাছে ১০০ জন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে জাহান্নমের আগুন থেকে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দেবে।’’
এ হাদীসটিও চরম বানোয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাত পরিচয়ের। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত। [ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত, ইবনু হাজার]
শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি ও আমলের প্রমাণ সরূপ এ বিষয়ক ৩য় জাল হাদীসটিতে মিথ্যাবাদীগণ বিশিষ্ট তাবিয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকির (রহ.) থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর কর্তৃক বর্ণনা করেছেন-
‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাতে ১০০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বেই মহান আল্লাহ তার কাছে ১০০ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। ৩০ জন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ৩০ জন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিবে, ৩০ জন তার ভুল সংশোধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।’’
“উক্ত এ হাদীসটিও বানোয়াট বা জাল। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাতপরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।”[ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ ‘আত]
আর এ বিষয়ে চতুর্থ হাদিসটিও অনুরূপ বানোয়াট বা ভিক্তিহীন।
প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা শবে বরাতের শারঈ ভিক্তি প্রমাণ সরূপ অনেক বই বাজারে পেয়ে যাবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তারা যদি শবে বরাতের রাত বলতে ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে এটা হবে তাদের চরম মূর্খতা প্রমাণ। কেননা ভাগ্য রজনী শবে কদরের রাত। তাই এ সকল বিদআতি বই থেকে আপনাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে৷
এখন আমরা শবে বরাতকে এ জন্য বিদআত বলছি, কেননা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমানিত যে, ভাগ্য রজনী বা সৌভাগ্যের রাত হলো লাইলাতুল কদরের রাত। যে মাসে পবিত্র কুরআন মাজীদ নাযিল করা হয়, তা হল রমজান মাসে। শাবান মাসের মধ্য রজনী নয় ৷ এটা পবিত্র কুরআন থেকে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি।
তবে আমরা এটাও বলছি না, যে শাবান মাসের মধ্য রজনী কোন গুরুত্বপূর্ণ রাত নয়৷ রবং হাদিস দ্বারা যতটুকু প্রমানিত আমরা তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস করি। আর পারিভাষিক শব্দে শবে বরাতের রাত বলতে যদি লাইলাতুল কদর কেও বুঝানো হতো, তাহলে তারও একটা ভিক্তি প্রমাণ করা যায়। কিন্তু আমরা তা কখনোই বুঝিয়ে থাকি না।
সুতরাং শাবান মাসের মধ্য রজনীকে ভাগ্য রজনী বলা, এ রাতে গোসল করা, নফল ইবাদতে রাত জাগরণ করা স্পষ্ট বিদআত। অর্থাৎ প্রচলিত শবে বরাতের শর’ঈ ভিক্তি পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা কখনোই প্রমানিত নয়।
মহান আল্লাহর তা’য়ালা আমাদের দ্বীন ইসলামের সহিহ বুঝ দান করুক, আমিন।
তথ্য সহায়তাঃ
ধন্যবাদ অনেক না জানা তথ্য জানতে পারলাম।
আলহামদুলিল্লাহ্। আপনাকেও ধন্যবাদ।