হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে প্রানের চেয়ে বেশি ভলোবাসা ইমানি দাবি৷ কিন্তু এই ভালোবাসার দোহাই দিয়ে রাসূল (সা.) এর নামে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া কখনোই সঠিক কাজ হতে পারে না৷ বরং তা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কিছু লোক মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল না, এ মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন এবং সমাজে তা প্রচার করে বেড়ায়।
তাই এ বিষয়টি নিয়ে পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে আমরা একটু পর্যালোচনা করতে চাই। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল না, সমাজে প্রচলিত এই কথা কতটুকু শুদ্ধ তাও পর্যালোচনা করে দেখতে চাই। চলুন তবে আর কথা না বাড়িয়ে মূল পর্যালোচনায় যাওয়া যাক।
রাসূল (সা.) এর জীবনে সবচেয়ে বড় মুজেজা হলো মহা পবিত্র আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন। আর পবিত্র কুরআন মাজীদের জীবন্ত ব্যাখ্যা হল রাসূল (সা.) নিজেই। তবে আমরা কুরআনের এরকম একটি আয়াত ও সহিহ হাদিসের কথা জানি না, যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন তাঁর ছায়া ছিল না। বরং এ প্রসঙ্গে কিছু জাল হাদিস লক্ষ্য করা যায়। যার উপর ভিক্তি করেই এই মিথ্যা এবং অসত্য তথ্য আমরা শুনতে পাচ্ছি ।
এরকম একটি জাল হাদিস যাকওয়ান থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-
“সূর্য ও চাঁদের আলোতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ছায়া দেখা যেতো না।” (আল খাসায়েলুল কুবরা)
উক্ত এই বর্ণনাটি বানোয়াট, জাল বা ভিত্তিহীন। কেননা এই বর্ননার সূত্রে আব্দুর রহমান বিন কাইস যাফরানী নামে যে ব্যক্তি রয়েছে, তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের কঠোর মন্তব্য রয়েছে। বিজ্ঞ রিজাল শাস্ত্রবিদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী (রহ.) সহ অনেক মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যুক বলেছেন। আবু আলী সালেহ ইবনে মুহাম্মাদ (রহ.) তাকে হাদীস জাল বর্ননাকারী বলেছেন।
এছাড়াও তার সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী প্রমুখ প্রখ্যাত ইমামদের কঠোর উক্তি রয়েছে।(তারীখে বাগদাদ, তাহযীবুত তাহযীব)
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও মুজাতাহিদ শাইখ সালিহ আল উসাইমীন (রহ.) বলেছেন-
“রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কোনো ছায়া ছিল না বলে যে সব কথা বলা হয়, তার সবই মিথ্যা এবং বানোয়াট।” (আল কাউলুল মুফীদ)
এখন একটি কথা চিন্তা করুন, মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল না এটি অতি আশ্চর্যজনক একটি বিষয় নয় কি!! তাই এ সম্পর্কে অনেক সহিহ হাদিস থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্তু সত্য বলতে এমন একটিও সহিহ হাদিস নেই। বরং তাঁর ছায়া ছিল এ মর্মে একাধিক সহিহ হাদিস বর্নিত হয়েছে।
উম্মুল মুমিনীন মা আয়েশা (রা.) বর্ননা করেছেন-
“একদা আল্লাহর রাসূল (সা.) এক সফরে ছিলেন। সাথে ছিলেন সাফিয়্যাহ ও যায়নব (রা.)। সাফিয়্যাহ নিজের উট হারিয়ে ফেলেন। যায়নব (রা.) এর কাছে ছিল অতিরিক্ত উট। তাই নবী (সা.) যায়নবকে বলেন, সাফিয়্যার উট নিখোঁজ হয়ে গেছে। যদি তুমি তাকে তোমার একটি উট দিয়ে সাহায্য করতে তো ভাল হত।
উত্তরে যয়নব বলেন, হুঁ আমি ঐ ইহুদির মেয়েকে উট দেব? (অর্থাৎ তিনি দিতে অস্বীকার করেন এবং সাফিয়্যাহকে ইহুদির সন্তান বলে কটূক্তি করেন। কেননা তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদী ছিলেন) এ কটূক্তির কারণে রাসূল (সা.) যায়নবের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেন। যিলহজ্জ এবং মুহাররম দুই কিংবা তিন মাস ধরে তার সাথে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকেন।
যায়নব (রা.) বলেন, আমি নিরাশ হয়ে পড়ি। এমনকি শয়নের খাটও সরিয়ে নেই। এমনি এক সময় দিনের শেষার্ধে নিজেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ছায়ার মধ্যে পাই। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন।”(মুসনাদে আহমদ)
মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল এ মর্মে উক্ত একই হাদিসের অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়-
“তখন এমনকি যায়নব (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আগমন থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন। রবিউল আওয়ালে রাসূল (সা.) তার নিকট যান। ঘরে প্রবেশের প্রাক্কালে যায়নব (রা.) তাঁর ছায়া দেখতে পান এবং বলেন, এতো কোন পুরুষ মানুষের ছায়া বলে মনে হয়। তিনি তো আমার কাছে আসেন না। তাহলে এ ব্যক্তি কে? ইত্যবসরে রাসূল (সা.) প্রবেশ করেন। (মুসনাদে আহমাদ)
মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল এ মর্মে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন-
“কোনো এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নামায পড়াচ্ছিলেন। তিনি সহসা সামনের দিকে হাত বাড়ান, এরপর তা আবার পেছনের দিকে টেনে নেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এ নামাযে আপনাকে এমন কাজ করতে দেখেছি যা ইতিপূর্ব কখনো করেন নি। তিনি ইরশাদ করেন- হ্যাঁ। আমার কাছে জান্নাত উপস্থিত করা হয়েছিল।
তাতে বিশাল বৃক্ষরাজি দেখতে পেলাম যেগুলোর ছড়া ঝুঁকানো ছিল। তা থেকে কিছু নিতে চাইলে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হল আপনি পেছনে সরে দাঁড়ান। আমি সরে দাঁড়ালাম। তারপর আমার নিকট জাহান্নাম উপস্থিত করা হল, যার আলোতে আমি আমার এবং তোমাদের ছায়া পর্যন্ত দেখেছি। (মুসতাদরিকে হাকেম, সহীহ ইবনে খুজাইমাহ)
হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলতে পারি- যখন জাহান্নামের প্রতিচ্ছবি পেশ করা হয়েছিল তখন তো রাসূল (সা.) এর সামনে জাহান্নামের আগুনের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই তখন রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের ছায়া পেছন দিকেই সরে গিয়েছিল। আর একজন রাসূল হিসেবে তাঁর সাথে এমন অলৌকিকে বিষয় ঘটবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এখন একটি প্রশ্ন সবার মাঝে জেগে ওঠা স্বাভাবিক, তা হল রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযরত অবস্থায় কিভাবে সম্মুখ থেকে পেছনে ছায়া দেখেতে পেয়েছিলন?
এরূপ প্রশ্নের উত্তর খুবই স্পষ্টত, কেননা রাসূল (সা.) কে নামাযরত অবস্থায় সম্মুখ থেকে পেছনে দেখার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছিল। ইহা ছিল তাঁর অন্যতম একটি মুজিযা। এর পক্ষে সুস্পষ্ট দলিলও রয়েছে। যেমন-
এখন এই বিষয়টি নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকার প্রশ্নই আসে না। মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল এ প্রসঙ্গে আমরা একাধিক সহিহ হাদিস দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাঁর ছায়া ছিল না, এ প্রসঙ্গে যতগুলো হাদিস এসেছে তা সবই হাদিসের মানদণ্ডে বানোয়াট বা জাল হাদিস হিসেবে প্রমানিত হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হওয়া সত্যেয় তিনি ছিলেন একজন আমাদের মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাঁর ঘাম হতো, ছায়াও ছিল। তবে রাসূল (সা.) ছিলেন মহামানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।
আমাদের সাথে তাঁর পার্থক্য হলো আমরা সাধারণ মানুষ আর তিনি নবী ও রাসূল। অর্থাৎ তাঁর কাছে আল্লাহর বানী নাজিল হয় কিন্তু আমাদের কাছে হয় না।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবুদ একজন। আর যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে।“(সূরা কাহাফ: ১১০)
সুতরাং এটি দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে মুহাম্মদ (সা.) এর ছায়া ছিল। কেননা তিনি ছিলেন একজন মানুষ। আর প্রত্যেক মানুষেরই ছায়া থাকে এবং এ মর্মে স্পষ্ট সহিহ হাদিস রয়েছে। তাই তাঁর ছায়া ছিল না এ মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের পরিপন্থী কাজ। আমাদের সকল কে এই মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে, অন্যকেও সতর্ক করতে হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দ্বীনের সহিহ বুঝ দান করুক, আমিন৷
মন্তব্য লিখুন