মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে প্রথম ইংরেজরা ভারতে আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ব্যবসা করার অনুমতি পায় ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্ত সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ব্রিটিশরা প্রথমবারের মত মুঘল সাম্রাজ্যকে দূর্বল ভেবে চট্টগ্রাম এবং মাদ্রাজ দখলের চেষ্টা করে। কিন্ত সম্রাটের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। আওরঙ্গজেব পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের আমলে ব্রিটিশরা ভারতে উপনিবেশ বিস্তারের সুযোগ পায়।
১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য বিস্তারের সুচনা করে। এই সময় ব্রিটিশদের এই সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহীশুর সালতানাত। পিতা হায়দার আলি এবং পুত্র টিপু সুলতান প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করে।
১৭৯৯ সালে টিপু সুলতানের শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্য পূর্ণতা পায়। কিন্ত এই সুদীর্ঘ সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অনেক বিদ্রোহ হয়েছিল। বাংলায় ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া ও তিতুমীরের বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সীমান্ত প্রদেশে ওয়াহাবীদের বিদ্রোহ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
অবশেষে ১৮৫৭ সালে গোটা ভারত ফেটে পড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত অসন্তষ্ট সিপাহীদের দ্বারা শুরু হলেও এই মহাবিদ্রোহ সারা ভারতে ছড়িয়ে যায় এবং এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠী যোগ দেয়।
প্রত্যক্ষভাবে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন। এই রাইফেলে গরু এবং শুকরের চর্বি মেশানো ছিল। এর ফলে হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের সিপাহীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্ত , এই বিদ্রোহের পেছনে আরো বহুবিধ কারণ ছিল।
প্রথমত, ব্রিটিশরা স্পষ্টভাবে ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করেছিল। ১৮৫৭ সালের পূর্বে একে একে বাংলার নবাব, রোহিলাখন্ডের নবাব এবং মহীশুরের সুলতান পরাজিত হয়ে রাজ্য হারান। এরপর তারা পাঞ্জাব, সিন্ধু, অযোধ্যা, মারাঠা সাম্রাজ্যে নিজেদের দখলদারিত্ব কায়েম করে।
গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী ১৮৪৮ সালে স্বত্তবিলোপ নীতি চালু করেন। এই আইনে ভারতীয় রাজাদের দত্তকপুত্র গ্রহণের অধিকার ব্রিটিশ কোম্পানী অস্বীকার করে। এই আইন প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, তাঞ্জোরের মত রাজ্যগুলো দখল করেন।
এমনকি, মারাঠা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দত্তক পুত্র নানাসাহেবের উত্তারাধিকার অস্বীকার করা হয়। এরপর দুঃসাহসী হয়ে কোম্পানী এমন কি মুঘল বাদশাহ ২য় বাহাদুর শাহের পরে দিল্লীর দরবার বিলুপ্ত হবে এমন ঘোষনা দেয়ারও পাঁয়তারা করতে থাকে। কোম্পানীর সিপাহীরা বেশিরভাগই ছিল দেশীয় রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। তারা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে যে কোম্পানীর শাসনে ভারতের কোন রাজ্যই নিরাপদ নয়।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটিশরা ভারতকে এক দরিদ্রতম উপনিবেশে পরিণত করে। এই ঘটনাকে ঐতিহাসিকরা “পলাশীর লুন্ঠন” বলে অভিহিত করেছেন কারণ এর সুত্রপাত হয় পলাশীর যুদ্ধের পরপরই। পলাশীর যুদ্ধের পর গভর্নর ক্লাইভ এবং অনান্য ব্রিটিশ কর্মচারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্রিটেনে পাচার করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অধিকৃত অঞ্চলে ব্রিটিশরা একচেটিয়া ব্যবসা কায়েম করে। এর ফলে এক সময়ের সমৃদ্ধ ভারত ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ অধিকারের পূর্বে মহীশুর সালতানাতের মোট জাতীয় আয় ইংল্যান্ডের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্ত, ব্রিটিশ অধিকারে মহীশুরের সমৃদ্ধ অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশদের তৈরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ভারতীয় কৃষকদের নিঃস্ব করে।
কোম্পানীতে কর্মরত সিপাহীরা অনেকেই ছিল এসব কৃষক পরিবারের সন্তান। ব্রিটিশের অত্যাচারের কারণে বাংলা এবং ভারতের অনান্য প্রদেশের কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে হাজার হাজআর লোক বেকার হয়ে যায়। এছাড়াও, গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলে চালু করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির ওপর চাষীদের মালিকানা অস্বীকার করা হয়। এর ফলে ব্রিটিশের পদলেহী জমিদার শ্রেনী ভারতবর্ষের আপামর জনতাকে ইচ্ছেমত শোষণ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
ব্রিটিশ বাহীনিতে কর্মরত বেশিরভাগ সিপাহীই ছিল গ্রামীন কৃষক পরিবারের সন্তান। তাই এই অবস্থায় তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ জেগে ওঠে।
তৃতীয়ত, ব্রিটিশরা ক্ষমতা সুসংহত করার সাথে সাথেই খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার বাড়ে। ব্রিটিশরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। এর ফলে ভারতীয়দের মাঝে গভীর উদ্বেগ তৈরী হয়। এর মাঝেই যখন এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার করার জন্য চাপ দেয়া শুরু হয় , সিপাহীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
চতুর্থত, ব্রিটিশ সেনাবাহীনির বিশাল অংশ ছিল ভারতীয়। কিন্ত সকল যোগ্যতা থাকার পরেও ভারতীয়রা কমিশন্ড অফিসার হতে পারত না। এমনকি, একই পদে কর্মরত ব্রিটিশ সৈনিকেরা ভারতীয়দের চেয়ে বেশি আর্থিক এবং অনান্য সুযোগসুবিধা পেত।
১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ বাংলার ব্যারাকপুরে সিপাহী মঙ্গল পান্ডে এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। মঙ্গল পান্ডে পরে ফাঁসি দেয়া হলেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে যায়। এপ্রিলে মীরাটের সিপাহীরা বিদ্রোহ করে ইংরেজ অফিসারদের হত্যা করে এবং দিল্লীতে গিয়ে বাদশাহ ২য় বাহাদুর শাহকে সর্বাধিনায়ক করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিলুপ্তি ঘোষণা করে।
কানপুরের নানাসাহেব,ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই, অযোধ্যার বেগম হজরত মহল,বিহারের কুমার সিংহ, পাঞ্জাবের রাও আহমেদ খান খারাল বিদ্রোহে যোগদান করেন । বাংলায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর প্রভৃতি জেলায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। রোহিলাখন্ডেও বিদ্রোহ দেখা দেয় খান বাহাদুর খানের নেতৃত্বে।রাজস্থানে আজমীর এবং কোটায় জনগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে।
বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।
প্রথমদিকে দিল্লী, বিহার, লখনৌ, পাঞ্জাব ইত্যাদি স্থানে ব্রিটিশরা পরাজিত হয়।এমনকি হায়দ্রাবাদ রাজ্যে, যেখানে ব্রিটিশের অনুগত নিজাম রাজবংশের শাসন চলছিল, তুররেবাজ খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। কিন্ত ব্রিটিশদের সেনাশক্তি ছিল প্রচন্ড। তাছাড়া, বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। বিদ্রোহীদের মধ্যে বেশ কিছু নেতা শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন। যেমন, রানী লক্ষীবাই,তাতিয়া টোপী, মওলানা আহমদউল্লাহ, দিল্লীর শাহজাদা ফিরোজ শাহ,দিল্লীর সেনাপতি বখত খান প্রমুখ। কিন্ত সাধারণভাবে সুপ্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনাদের সামনে বিদ্রোহীরা অসহায় ছিল।
তাছাড়া, হায়দ্রাবাদের নিজাম,গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, মধ্য ও উত্তর ভারতের বহু ক্ষুদ্র রাজা, বাংলায় কোলকাতার বাবু সমাজ ব্রিটিশদের সহযোগিতা করে। ব্রিটিশ জেনারেল হাডসন এবং নিকলসন বর্বরতম নৃশংসতার মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করে। দিল্লীর বহু শাহজাদাকে গুলি করে বাহাদুর শাহর চোখের সামনে হত্যা করা হয়। ঝাঁসির রানী, মাওলানা আহমদউল্লাহ, কুমার সিংহ,বাংলার রংপুরের নবাব ওয়ালীদাদ খান যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। নানাসাহেব, বেগম হজরত মহল নেপালে নির্বাসিত হন। শাহজাদা ফিরোজ শাহ ভগ্ন হৃদয়ে আফগানিস্তান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে স্বাধীন ভারতের সংগ্রামের জন্য সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ১৮৭৭ সালে মক্কায় ইন্তেকাল করেন।
চিত্রঃ দিল্লীতে ব্রিটিশ সেনাবাহীনির হাতে শাহাদাতবরণকারী মুঘল রাজপুত্ররা
ব্রিটিশের পদলেহী ঐতিহাসিকেরা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ -কে জাতীয় সংগ্রাম বলে স্বীকার করতে চান না। তাঁদের মতে, সেই সময় ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। কিন্ত স্বাধীন ভারত ও বাংলাদেশের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এই মতামতের সাথে একমত না। পৃথিবীর সব দেশই বহু ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনা অর্জন করে। ১৮৫৭ ছিল এমনই এক অধ্যায়। সর্বোপরি, হিন্দুমুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হিসেবেও এই বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে মহাবিদ্রোহের দেড়শত বছর পূর্তিতে ভারত সরকার জাতীয়ভাবে এই সংগ্রামকে স্মরণ করে।
তথ্যসুত্রঃ
১। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, আহমদ ছফা
২। আঠারোশ সাতান্নের বিদ্রোহ, শ্রী অশোক মেটা
৩। ভারত ইতিহাস পরিক্রমা, ড. প্রভাতাংশু মাইতি
মন্তব্য লিখুন