বাহাদুর শাহ পার্ক, এই নাম আমরা সবাই মোটামুটি শুনেছি। ঢাকা নিবাসী অনেকে হয়তো এখানে বেড়াতেও গিয়েছেন বহুবার। কিন্তু আন্টাঘর ময়দানের নাম বললে এখন অনেকেই চিন্তায় পড়ে যাবেন যে এটি আসলে কোন জেলায় অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে, বাহাদুর শাহ পার্কেরই প্রাচীন নাম আন্টাঘর ময়দান। এই নামবদল একদিনেই হয়ে যায় নি, রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। চলুন আজ দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটির ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে এই স্থান ঠিক এখনকার মতো ছিল না। আঠারো শতকের শেষের দিকে এই জায়গা ইংরেজরা কিনে নেয়। এই ময়দান সংলগ্ন এলাকায় ছিল আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব। এই বিলিয়ার্ড খেলার বলকে সাধারনভাবে তারা আন্টা বলতো। সেই থেকে এই ক্লাব ঘরের নাম হয়ে যায় আন্টাঘর আর এর সাথে যে ময়দান ছিল সেটিই আন্টাঘরের ময়দান বলে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু এই পরিচি্তি খুব বেশিদিন টেকে না।
১৮৫৭ সালে সংগঠিত সিপাহী বিদ্রোহে এই ময়দান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংরেজদের দ্বারা আন্দোলন প্রতিহত হয়ে যাওয়ার পর কিছু বিপ্লবী আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন আর অনেকে ধরা পড়ে যান।
বন্দী বিপ্লবী সিপাহীদের ইংরেজদের এক প্রহসনমূলক বিচারের ফলে ফাঁসির রায় হয়। তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় তৎকালীন এই আন্টাঘর ময়দানে। শুধু তাই নয়, ইংরেজরা নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য ও মানুষের মাঝে ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সেই মৃতদের মধ্যে এগারো জনের দেহ বহুদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখে দেয় এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। সে সময় এই ঘটনা নিয়ে চারিদিকে ভীতির সঞ্চার হয়। দিনের বেলাতেও এদিকে কেউ আসার সাহস পেতো না। সেসময়কার নানা রকম ভূতুড়ে গল্প স্থানীয় মানুষের মুখে আজও শোনা যায়।
এরপর রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহন করেন। সেই উপলক্ষে ১৮৫৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এই ময়দানে একটি ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। তখন থেকে এই পার্কের নামকরণ করা হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।
এর প্রায় একশো বছর পর ১৯৫৭ সালে এই ময়দানেই সিপাহী বিদ্রোহের শতবর্ষ পালন করা হয়। বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
সেই সাথে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নামানুসারে এই ময়দানের নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’। সিপাহী বিদ্রোহ মূলত সংগঠিত হয়েছিল মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ক্ষমতায় আনার উদ্দেশ্যে। তাই তখন এই না্মে ময়দানের নামকরণ হয়।
প্রায় উনিশ শতকের প্রথম দিকে ময়দানের এই জায়গা্টা ইংরেজরা কিনে নিয়েছিল। এরপর তারা এটিকে লোহার প্রাচীর দিয়ে ঘিরে চারদিকে চারটি দর্শনীয় কামান বসিয়ে দেয়। বিলিয়ার্ড ক্লাবটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ। তারা ব্যক্তিগতভাবে ময়দানের অনেক উন্নয়ন সাধন করেন।
পার্কটি ছিল মূলত একটি গোলাকার ময়দান। এর মাঝখানে রয়েছে একটি পানির ফোয়ারা। এই স্থান ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ই মূলত বেশি পরিচিতি লাভ করে। এই বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা তাদের সেনাদের স্মরণে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও তৈরি করেছিল।
এ পার্কের উন্নয়নে নওয়াব আব্দুল গণির যথেষ্ট অবদান ছিল। ঢাকাবাসীর আশা ছিল তাঁর নাতি খাজা হাফিজুল্লাহই পরবর্তিতে ঢাকার নবাব হবেন। তাই তাকে তার পরিবার, সর্বোপরি পুরো ঢাকাবাসীই যথেষ্ট সমীহ করতেন। কিন্তু হাফিজুল্লাহের অকাল মৃত্যুতে তাঁর পরিবার যথেষ্ট ভেঙে পড়ে। এই মৃত্যু পুরো ঢাকাবাসীর জন্যই ছিল যথেষ্ট শোকের।
১৮৮৪ সালে নওয়াব আব্দুল গণির ইংরেজ বন্ধুরা তাঁর নাতির স্মৃতি রক্ষার্থে চাদা তুলে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। কলকাতা থেকে আনা মসৃ্ন গ্রানাইট পাথরে তৈরি এই স্মৃতি স্তম্ভটিই খাজা হাফিজুল্লাহ ওবেলিস্ক হিসেবে এখনো শোভা পাচ্ছে।
ময়দানের উত্তরদিকে অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো একটি চারকোণা কাঠামো যার উপরে রয়েছে একটি গম্বুজ। অপর পাশে রয়েছে একটি স্মারক স্তম্ভ, যা ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী হিসেবে রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহণের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাহাদুর শাহ পার্ক বর্তমানে পুরান ঢাকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে অবস্থিত। এটি ঢাকার সদরঘাট এলাকায় ঢুকেই লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত। এই ময়দানটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে সাতটি রাস্তার সমাহার।
চারপাশে রয়েছে স্কুল, কলেজ, সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সেন্ট থমাস চার্চ ও ঢাকায় প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি ট্যাংক। এছাড়া এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে ঢাকার জজকোর্ট। আরো অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে অবস্থান করছে কালের সাক্ষী এই বাহাদুর শাহ পার্ক বা আন্টাঘর ময়দান।
ব্যস্ত রাজধানীর মাঝে একটুখানি সবুজের সমারোহ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই বাহাদুর শাহ পার্ক। বর্তমান যুগের মানুষের কাছে যেন ইতিহাসে একটি খোলা দরজা এই ময়দান। ব্যস্ত শহরে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে আশেপাশের অনেকেই নিয়মিত আসেন এই স্থানে।
অনেকে আবার সকাল বেলা হাঁটতে বের হন এখানে। তাই নিয়মিত এই পার্কের যত্ন নেওয়া দরকার। বহিরাগতদের দ্বারা যেন এই স্থানের কোনো ক্ষতি না হয় বা কোনো ঐতিহাসিক বস্তুর যেন সম্মানহানী না হয়, তা নজরদারীতে রাখা প্রয়োজন। কারণ বর্তমা্নের এই বাহাদুর শাহ পার্ক বাংলার সংগ্রামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
মন্তব্য লিখুন