ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প পড়েছেন নিশ্চয়ই। না পড়লেও বাড়ির বড়দের কাছে তো নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। মনে আছে সেই রাজপুত্রের কথা, যে রাজকন্যা কে ডাইনী বুড়ীর হাত থেকে বাঁচাতে সোনার আপেল আনার জন্য পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সাত সাগর আর তের নদী পাড়ি দিত। সোনার আপেল! সে না হয় বুঝলাম সোনার তৈরি আপেল। হয়তো কল্পনায় মেনেও নিলাম যে সোনার আপেল হলেও হতে পারে।
কিন্তু যদি বলি একটা সোনার শহর কল্পনা করতে! কি মাথায় আসবে? আপনার মাথায় কি এসেছে জানি না তবে অনেকের মাথায় “এল ডোরাডো” এর নাম চলে আসবে। কারণ সোনার শহরের আলোচনা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনায় মোড়া! এল ডোরাডোর” ছবি।
সোনার তৈরি এই শহরকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কল্পনার জাল বিস্তার করেছে। অনেকে ছুটে গিয়েছে এই সোনার শহর “এল ডোরাডো” এর খোঁজে। কিন্তু কি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো? এর অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? নাকি সোনার শহর শুধুই মানুষের কল্পনা? এ নিয়ে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। চলুন তাহলে জেনে নিই এই সোনার শহর “এল ডোরাডো” সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।
আনুমানিক ৮০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন পুথি বা নথিতে এল ডোরাডোর উল্লেখ পাওয়া গেছে কিন্তু ষোড়শ শতক থেকে এর উল্লেখ ও এর খোঁজ বিস্তর পরিধিতে শুরু হয়। ধারণা করা হয় জুয়ান মারটিনেজ (স্প্যানিশ অভিযাত্রি) প্রথম এই সোনার শহর এল ডোরাডোর কথা জানান।
১৫৩১ খ্রীস্টাব্দে মারা যাবার পূর্বে তিনি বলেন যে দক্ষিণ আমেরিকার গভীর জঙ্গলে রয়েছে এক অদ্ভুত শহর এবং সেখানে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ধনসম্পদ। তিনি আরও বলেন যে, সে শহরে এত সম্পদ আছে যে তারা পুরো শহরটিকে সোনায় মুড়িয়ে রেখেছে। যা এত দিন পর্যন্ত সবার চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। সেই থেকে শুরু হয় এই শহরের খোঁজ। অনেক অভিযাত্রী দল এই শহরের খোঁজে যাত্রা করেছে কিন্তু তারা সবাই বিফল হয়েছে।
১৫৩০ খৃষ্টাব্দে অভিযাত্রী কুয়েসাদা দক্ষিণ আমেরিকার ঘন জঙ্গলে ঘেরা গুয়াটাভিটা হ্রদের পানি সেচে অনেক পরিমান সোনার টুকরো এবং অলংকার পেয়েছিলেন। তাই থেকে ধারণা করা হয়, সোনার শহর এল ডোরাডো হয়তো আশেপাশেই আছে।
এরপর ১৫৪১ সালে অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দেওরেয়ানা আর গনসারো পিসারো সোনার শহরের খোঁজ চালান কিন্তু ব্যর্থ হন
১৭৯৯-১৮০৪ সালে আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট লাতিন সোনার শহরের খোঁজে এক লম্বা অভিযান চালান আমেরিকায়। কিন্তু এমন কোনো শহরের খোঁজ মেলেনি।
তখন তারা এই সোনার শহর বা এল ডোরাডোর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এরপর ধীরে ধীরে সোনার শহর এল ডোরাডোর কথা ভুলে যেতে থাকেন সবাই।এখন এই এল ডোরাডো শুধুই হারিয়ে যাওয়া কল্পনার শহর। পরবর্তী সময়ে এই কল্পনার শহর এল ডোরাডো নিয়ে অনেক সিনেমা ও গল্প কাহিনী নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের লেখা শঙ্কু কাহিনীতে ও এই এল ডোরাডোর উল্লেখ আছে।
এবার তাহলে আসুন সোনার শহর “এল ডোরাডো” এর আসল গল্প বলি, “এল ডোরাডো” হলো স্প্যানিশ ভাষার একটি শব্দ যার মানে ‘যেটি সোনা’। শব্দটি এসেছে “এল অমব্রে দোরাদো” (El Hombre Dorado) বা ‘সোনার মানুষ’ থেকে।
বহু যুগ আগের কথা আমেরিকার মানচিত্রের অনেক স্থান তখনও আবিষ্কার হয়নি।তখনকার দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় মুইসকা নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠী বাস করতো। মুইসকা আদিবাসী সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছিলো।
তাদের ঐতিহ্য অনুসারে যখন নতুন রাজা (তাদের ভাষায় জিপা) নির্বাচন করা হয় তখন ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে তার সমস্ত শরীরে সোনার গুড়ো লাগিয়ে পালকিতে চড়িয়ে ‘গুয়াটাভিটা’ হ্রদে নিয়ে যাওয়া হতো পবিত্র স্নানের জন্য। এই রাজাদের বলা হতো এল ডোরাডো বা সোনার মানুষ। সেখানে গিয়ে নতুন রাজা এবং তার সভাসদ গন ভেলায় চড়ে হ্রদের মাঝখানে যেত।
মাঝ হ্রদে ডুব দিয়ে রাজা পবিত্র হতো, সেইসাথে সভাসদ গন অনেক সোনা এবং সোনার অলংকার সেই হ্রদে বিসর্জন দিত তাদের দেবতার খুশির জন্য। পরে লোকমুখে পরিবর্তিত হতে হতে সোনার মানুষ হয়ে গেল সোনার শহর এল ডোরাডো। এবং শুরু হলো এক বিরতিহীন অভিযান এই এল ডোরাডোর খোঁজে। অভিযাত্রী কুয়েসাদা হয়তো গুয়াটাভিটা হ্রদে, মুইসকা আদিবাসীদের দেবতার জন্য উৎসর্গ করা সোনার অলংকারই খুঁজে পেয়েছিলেন। সবাই আসলে সোনার লোভে সোনার শহর এল ডোরাডোর খোঁজ করছিল কিন্তু খুঁজে পায়নি। খুঁজে পাবে কি করে এল ডোরাডো তো সোনার শহর নয় আসলে সোনার মানুষ।
ছবিঃ সংগৃহীত।
তথ্যসূত্রঃ রোয়ারমিডিয়া এবং ইতিবৃত্ত।
মন্তব্য লিখুন