ডায়েরি হচ্ছে ব্যক্তিগত দিনলিপি সংরক্ষণের এক বহুল প্রচলিত মাধ্যম। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রায় সকল মানুষই ডায়েরি লিখে থাকেন৷ নিত্যদিনের অতি সহজ সরল বর্ণনাই থাকে ডায়েরির পাতা জুড়ে। কিন্তু অনেক সময় আজকের অতি স্বাভাবিক ঘটনাই হয়ে যায় ভবিষ্যতের ইতিহাস৷
আজকের গুরুত্বহীন কোনো ঘটনাই অনেক সময় হয়ে ওঠে ইতিহাসের দলিল। যদিও ডায়েরি একান্ত ব্যক্তিগত দিনলিপির প্রকাশ মাত্র, কিন্তু কারো কারো ব্যক্তিগত ডায়েরিই কালের সাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেয় অতীতের; সময়কে খুঁড়ে অতীতের চাক্ষুস বক্তা হয়ে আমাদের শোনায় ইতিহাসের গল্প। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন, যারা ইতিহাসে আলোচিত হয়ে আছেন তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরির সুবাদেই৷ আজকে আমরা জানবো ইতিহাস হয়ে ওঠা আলোচিত সেসব ডায়েরির কথা।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আধুনিক যুগে বসে কিভাবে আমরা জানি প্রাচীন সময়ের নিখাদ বর্ণনা? ইতিহাস কিন্তু কখনোই ইতিহাস হিসেবে লেখা হয় না সেই সময়ে। একজন সাধারণ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরির সূত্র ধরেই প্রাচীন ইংল্যান্ডের এমন সব ইতিহাস আমরা জেনেছি, যেসবের এমন বিষদ বর্ণনা আর কোথাও ছিলো না।
১৬৩৩ সালে ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া পেপিস, সেই সময়ের ইংল্যান্ডের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তাঁর মতনই সাক্ষী সেসময়ের সবাই। কিন্তু আমাদের হাত পর্যন্ত যে দলিল এসেছে তা পেপিসের ডায়েরি।
স্যামুয়েল পেপিস ছিলেন একজন ব্রিটিশ নৌ-কর্মকর্তা। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হন এবং হয়েছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য। শখের বসেই তিনি ডায়েরি লিখতেন।
কোনো বিশেষ যুদ্ধ কিংবা মহামারীকে উপলক্ষ করে লিখতেন না। তিনি তাঁর নিত্যদিনের ঘটনা নিয়েই অনেক বছর ধরে ডায়েরি লিখেছেন। কিন্তু সেসময়ের মধ্যেই এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার চাক্ষুস সাক্ষী স্যামুয়েল পেপিসের এই ব্যক্তিগত ডায়েরি। তিনি নিশ্চই কখনো ভাবেন নাই একসময় সারা বিশ্বকে আলোড়িত করে তুলবে তাঁর এই লেখা।
প্লেগ মহামারী নিয়ে আমরা সবাই জানি। প্লেগ হচ্ছে রোগদের মধ্যে ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া একটি। পেপিসের ডায়েরিতে উঠে এসেছে সেই সময়ের গ্রেট প্লেগের কথা, ডাচ যুদ্ধ এবং গ্রেট ফায়ার অব লন্ডনের কথা। এই ডায়েরির আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে সেই আমলের ভয়াবহ সব শাস্তির কথা।
আমরাতো জানি, আধুনিক সভ্য ইংল্যান্ডেই দণ্ডপ্রাপ্তদের জন্য ছিলো বর্বর সব সাঁজার ব্যবস্থা। পেপিস নিজেই এর একজন চাক্ষুস সাক্ষী। একবার প্রায় ১২ থেকে ১৪ হাজার দর্শকের সামনে একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির শাস্তি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। নির্দয় অত্যাচারে ওই আসামির মৃত্যু নিশ্চিত হলে পেপিস আর সহ্য করতে না পেরে বাসায় চলে আসেন। মৃত্যুর এই নির্মমতা দেখে তিনি সেদিন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ডায়েরিতে সেকথাই লিখেছেন তিনি।
১৬৬০ সালের অক্টোবরে মেজর জেনারেল হ্যারিসন্সের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো। হ্যারিসন্সকে জনসম্মুখে চার টুকরা করে কেটে ফেলা হয়। তার মাথা ও হৃৎপিণ্ড সবার সামনে তুলে ধরাও হয়। নির্মম এই বিচারকার্য দেখে অনেকেই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলো।
পেপিসের বর্ণনা থেকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এই বর্বরতা জেনেছে পুরো পৃথিবী। যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধের ঘটনা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্তু পেপিসের ডায়েরি আমাদের সাক্ষ্য দিচ্ছে যে প্রাচীন ইংল্যান্ডে অনেক বছর ধরে এই পদ্ধতিতেই মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো অনেল আসামিকে। স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরিতে রয়েছে এমন দণ্ডের বর্ণনাও।
সময়কাল ১৬৪৯।
একবার পেপিস ব্রিটিশ শাসকদের প্রধান হোয়াইট হলের কিং হেডিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন পেপিস দেখেন, আসামিকে পেরেক দিয়ে হাত-পা কাঠের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে এক সময় সেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
‘আমরা যদি বেঁচে থাকতাম, আমার সহকর্মীদের কঠোরতা, ধৈর্য ও সাহস সম্পর্কে বলার জন্য আমার একটি গল্প ছিলো, যা প্রত্যেক ইংরেজের হৃদয়কে উত্তেজিত করবে। এই নোট আমাদের মৃতদেহগুলোর গল্প অবশ্যই বলবে…।’
উদ্ধার হওয়া একটি ডায়েরিতে এমনই লিখে রেখেছিলেন মৃত্যুর আট মাস পরে সনাক্ত হওয়া স্কট।
১৯১০ সালের ২৯ নভেম্বর, নিউজিল্যান্ডের ডানেডিন বন্দর।
এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে ক্যাপ্টেন স্কটের জাহাজ। উদ্দেশ্য দক্ষিণ মেরু জয় করা। সেসময় পর্যন্ত দক্ষিণ মেরু চিনলেও কোনো মানুষ সেখানে পা রাখেনি।
অভিযানের তৃতীয় দিনেই প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের তীব্রতায় জাহাজের একপাশে প্রথমে ফাঁটল দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রসদ এবং সঙ্গে থাকা দুটি ঘোড়া মারা যায়৷ একসময় ঝড় থামলো। চলতে চলতে তারা দেখেন মেরু অঞ্চলের পাখি অ্যালবেট্রাস। এই পাখি তাদের জানিয়ে দেয়, মেরুর খুব নিকটে এসে গেছে তারা।
এরপর শুরু হলো দুর্গম জয়ের অভিযান। এই অভিযানে স্কটের নেতৃত্বে আরো ছিলেন ডাক্তার উইলসন, বাওয়ারস এবং ওটস। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৯১২ সালের ১৮ জানুয়ারি স্কট এবং তাঁর দল গিয়ে পৌছায় দক্ষিণ মেরুতে। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে এতো দূরে এসে তারা দক্ষিণ মেরুকে জয় করলেও সেই আনন্দে উদবেলিত হতে পারেন না। কারণ তারা পৌঁছার মাত্র এক মাস ছয় দিন আগেই নরওয়ের নাবিক আমানসেন দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন। চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েন তাঁরা এবং দেশে ফেরার পথ ধরেন।
ফিরতি পথে আবহাওয়া ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। দেখা দেয় খাদ্যাভাবও। ওটস অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর দলের জন্য বোঝা হতে চাইলেন না৷ তাছাড়া জীবনের স্বপ্নকে ছুয়ে দেখেও হতে পারেনি প্রথমদের একজন। ইচ্ছা করেই তিনি নিখোঁজ হলেন। একধরনের স্বেচ্ছামৃত্যুকেই বেছে নিলেন এই অভিযাত্রীক। উইলসন, বাওয়ারস এবং স্কট তাবু টানলেন। উদ্দেশ্য ছিলো কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আবার রওনা দেবেন। কিন্তু সেখানেই বরফের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় এই দুঃসাহসিক তিন অভিযাত্রীর। স্কট মারা গিয়েছিলেন সবার শেষে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তার অভিযানের সব কাহিনী লিখে রেখে গেছেন। স্কটের লেখা ডায়েরি, আমানসেনের চিঠি এবং তাদের মৃতদেহসহ সবকিছু তাদের মৃত্যুর আট মাস পর সেই তাঁবু থেকে উদ্ধার করা হয়।
স্কটের আলোচিত ডায়েরি সেসময়ের অজেয় অ্যান্টার্কটিকায় দুর্গম জয়ের প্রত্যয়ে বলিষ্ঠ, লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে প্রাণান্ত চেষ্টা করা কয়েকজন স্বপ্নবাজের ব্যক্তিগত বিবরণ। কঠোর পরিস্থিতিতে দৃঢ় মনোবল ধরে রাখার এক বাস্তব অভিজ্ঞতার সাক্ষী এটা। শেষদিকে যখন গ্রেট আইস ব্যারিয়ারের প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে দলটি তাঁবুতে আটকা পড়ে, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি বসে, সঙ্গীদের মৃতদেহ পাশে নিয়ে স্কট যা লিখেছেন তা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের এক অনুপম উদাহরণ।
নেলা লাস্ট ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্লস ম্যাজ এবং নৃবিজ্ঞানী টম হ্যারিসনের গড়ে তোলা গণপর্যবেক্ষণ আর্কাইভের অংশ হিসেবে দৈনন্দিন জীবনে বেসামরিক জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা এবং সমসাময়িক ঘটনা সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। বিচক্ষণ এই নারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। তিনি তার সেসব কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৩৭ সালে ডায়েরি লেখা শুরু করেন এবং এটি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে লেখা ডায়েরিগুলোর একটি।
নেলা লাস্টের আলোচিত ডায়েরি -তে বিশদ দৈর্ঘের তিনটি ভলিউমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া কাহিনীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা রয়েছে। এই ঘটবাগুলোতে ব্রিটেনে যুদ্ধাপরাধের দৈনন্দিন বিচার এবং ভয়াবহতা নিয়ে ১৯৪০-৫০ এর দশকে সাধারণ মানুষের যে দৈনন্দিনতা ছিলো, সেসবের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল উপস্থাপন করেছেন তিনি।
যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি জার্মানির হল্যান্ড আক্রমণের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ২০ লাখ শব্দে বর্ণনা লিখেছেন। এছাড়াও একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশের বর্ণনায় প্রতিদিন কী রান্না করতেন, ঠিক কীভাবে তিনি তার হাউসকিপিং ভাতা ব্যয় করেছেন এবং যুদ্ধের প্রচেষ্টার জন্য কম্বল সরবরাহ ও সেলাইয়ের নারী স্বেচ্ছাসেবী সার্ভিস সেন্টারে তার কাজ কেমন ছিলো ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয়ও ডায়েরি আকারে লিখেছিলেন নেলা।
সেসময়ে নারীদের স্বাধীনতা এখনের মতো ছিলো না৷ সেই সময়ের একজন নারী কিভাবে চিন্তা করতেন তারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নেলা লাস্টের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে। তাঁর ডায়েরিগুলোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকের একটি হলো তাঁর বিয়েতে অসন্তুষ্টি এবং তারপর ধীরে ধীরে ক্ষমতায়ন ও যুদ্ধের অস্পষ্ট প্রকাশ। তিনি খুব হতাশা নিয়ে লিখেছেন, তাঁর যদি লিঙ্গ বেঁছে নেবার ক্ষমতা থাকতো তবে তিনি একজন পুরুষ হয়ে আবার পৃথিবীতে আসতেন। কারণ, পুরুষদের জীবনই সমস্ত দায়িত্ব এবং প্রচেষ্টার সব রং, রোমান্স এবং জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে পায়।
এই আলোচিত ডায়েরি -তে ইতিহাসের সাথে সাথে ফুটে উঠেছে লেখিকার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বও। ১৯৬৮ সালে তিনি মারা যান এবং ১৯৮১ সালে তার যুদ্ধকালে ডায়েরিগুলো প্রকাশিত হয়।
একজন ১৬ বছরের কিশোরী। এই বয়সের অন্য যেকোনো মেয়ের মতনই তার চিন্তা-ভাবনা সরল রেখায় চলবে। লেনা মুখিনাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর সেই ভয়ার্ত হাতে লেখা ডায়েরি ধরেই আমরা অনুভব করি ইতিহাসের এক অন্ধকার সময়কে। তাঁর এই ডায়েরিটিই হয়ে উঠেছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিভীষিকাময় যুগগুলোর একটির জীবন্ত বয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার সঙ্গে লঁড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষদের সরব ভাষা এই ডায়েরি।
১৯৪১ সালের মে মাস।
লেনিনগ্রাদে বসবাসকারী একজন অতি সাধারণ কিশোরী মেয়ে লেনা মুখিনা। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছিলো। কিন্তু ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার হঠাৎ স্ট্যালিনের সঙ্গে তার চুক্তি ভেঙে দেন। চুক্তি ভেঙেই তিনি শান্ত হন না। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নিমেষে লেনিনগ্রাদের সরল জনজীবন হয়ে ওঠে নরক যন্ত্রনার। এই সময়ের ঘটনা নিয়েই লেনার ডায়েরি যেখানে উঠে এসেছে যুদ্ধের স্বাভাবিক দিনের ঘটনা থেকে নৃশংস-ভয়ার্ত দিনের বর্ণনা।
লেনার আলোচিত ডায়েরি -তে উঠে এসেছে মানুষের ভয়ংকর রকমের খাদ্যের অভাবের বর্ণনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মানুষ সামান্য একবেলার খাদ্যের জন্য কী নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেন সেসব কথা। রাশিয়ার শীতের ভয়াবহতার কথা আমরা জানি। যুদ্ধের মধ্যেও শীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন লেনা। আর তার সাথে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা এবং তার জন্য সাধারণ মানুষের নির্মম পরিনতি৷ এযুদ্ধে লাখ লাখ সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক মারা যান।
লেলিনা তখন ছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সের একজন ফুলের মতো কিশোরী। কে জানতো যে, এই যুদ্ধের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে উঠবে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিটি! এই যুদ্ধের যে অবরোধ, তা ইতিহাসের এক আলোচিত বিষয়। লেনা লিখেছেন সেই অবরোধের সময় ঘটে যাওয়া কিছু গাঢ় স্মৃতি যা পরবর্তীকালে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। রাশিয়া কর্তৃক জার্মান অবরোধের আগে একজন কিশোরী তার জীবনে যেসব আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যেসব চরম বাস্তবতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছিলেন, সেসবের বর্ণনা যেকোনো মানুষকেই আতঙ্কিত করে তুলবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ, চারদিক থেকে জার্মান সেনাবাহিনীর ঘিরে ধরা এবং যা যা ঘটছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে এই ব্যক্তিগত ডায়েরিতে।
লেনার নিজের পরিবারই এই যুদ্ধে আক্রান্ত হয়। কিভাবে লেনার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছিলো তার সাক্ষীও লেনা মুখিয়ার এই ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক ডায়েরি।
হিটলারের কথা উঠলেই তার ইহুদি নিধনের পৈশাচিকতার কথা আলোচনায় আসে। আলোচনা হয় গ্যাস চেম্বার নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসিবাহিনীর যে ভয়াবহতার কথা আমরা জানি তাঁর লোমহর্ষক বর্ণনা বিশ্ব জেনেছে একজন কিশোরীর লেখা ডায়েরি থেকে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে যে কয়টি ডায়েরি পুরো পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেগুলোর মধ্যে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির নাম সবার আগে। কিশোরী বালিকা অ্যানা ফ্রাঙ্ক তাঁর ডায়েরি দ্বারা হয়ে উঠেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী। সে সময়ের ভয়াবহ দিনগুলো এই কিশোরীর কলমে চিত্রিত হয়েছে। এই আলোচিত ডায়েরি পড়ে কেঁদে উঠেছে বিশ্বের সকল সুবোধসম্পন্ন মানুষ।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। হিটলারের নাৎসিবাহিনী ইহুদি হননে মেতে উঠেছে। সেসময় অ্যানা ফ্রাঙ্কের পরিবার আমস্টারডামের একটি মৃত্যুকূপে ২৫ মাস ধরে লুকিয়ে ছিলেন। তবে এতেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। একদিন নাৎসিদের হাতে তারা ধরা পড়ে যান মৃত্যু হয় অ্যানারও। এই বন্দি জীবন নিয়েই আলোচিত এই ডায়েরি।
বের্গেন-বেলসেন বন্দিশিবিরের সবচেয়ে কমবয়সী বন্দি ছিলেন অ্যানা ফ্রাঙ্ক। এই শহরের অন্যান্য মেয়েদের মতো তাঁর জীবনেও প্রেম এসেছিলো। কিন্তু অ্যানার কিশোরী মন তা অস্বীকার করেছে। আলোচিত ডায়েরি -তে অ্যানা বলছেন-
‘তোমার মনে হবে আমি প্রেমে পড়েছি ।কিন্তু তা নয়’ অথবা ‘আমি ঠিক হিংসা করছি না, তবে ভেবে আনন্দ পাই।’
এমন সঙ্কা জড়ানো স্ববিরোধী বাক্য পড়ে পৃথিবীর সকল প্রেমময় ব্যক্তির মন অ্যানার জন্য কেঁদে উঠবে।
অ্যানার চোখের সামনেই ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হতো। বন্দি শিশুরাও রেহাই পেতো না এই নির্মম মৃত্যু থেকে। শিশুদেরকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় খুব কষ্ট পান তিনি। পাশবিক নির্যাতনের মধ্যেও বন্দিদের প্রত্যেককেই পাথর ভাঙা ও পরিবহনের মতো অত্যন্ত ক্লান্তিকর কাজ করতে হতো প্রতিদিন। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী সকল বন্দির মাথা কামানো থাকতো। উল্কির মাধ্যমে বন্দিদের নম্বর হাতের এক জায়গায় খোদাই করে দেওয়া হতো। অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিতে একজন চাক্ষুস সাক্ষীর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর হিটলারের সেসব অমানবিক নির্যাতনের কথা, যেসব শুনে এখনো আমরা ভয়ে শিউরে উঠি।
যুদ্ধের মাঝেই টাইফাস নামক এক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো। ১৯৪৫ সালের মার্চের দিকে এটা এই শিবিরেও ছড়িয়ে পড়ে মহামারি আকারে। শেষ পর্যন্ত এই রোগেই মাত্র পনেরো বছর বয়সী আনা মারা যান। থেমে যায় তার ডায়েরি লেখা। আনার বোন মার্গটও একই সময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। একমাত্র বেঁচে ফেরেন তাদের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। পরবর্তীতে তিনিই আমস্টারডামের সেই ভয়াল বন্দিশালা থেকে উদ্ধার করেন মেয়ের ডায়েরি ও অন্যান্য স্মৃতিবহুল জিনিসপত্র। মেয়ের ডায়েরিটি সারা পৃথিবীর কাছে উপস্থাপন করতে চান তিনি এবং তার প্রচেষ্টাতেই দিনলিপিটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটির মূল ভাষা ওলন্দাজ। পরে ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে এটা অনুবাদ হয়। এই ডায়েরিটির ইংরেজি অনুবাদের নাম দেওয়া হয় ‘দ্য ডায়েরি অব অ্যা ইয়ং গার্ল’। তবে আনা তার ডায়েরিটার নাম রেখেছিলেন, ‘দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স’। আনা বার বার বলে গেছেন- স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার রয়েছে পৃথিবীর সকল মানুষের। এবং তা আটকানোর অধিকার কারো নেই।
আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা হয়ে ওঠেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শান্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসা এই মহান নেতা তাঁর জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কারাবন্দি অবস্থাতে কাটিয়েছেন। কারাবন্দি একাকী এক বৈশ্বিক নেতার ডায়েরির নাম কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ।
আন্দোলন করার কারণে ৪৪ বছর বয়সে কারাবন্দি হয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা লোকচক্ষুর আঁড়ালে চলে যান। পরবর্তী প্রায় সিঁকি শতাব্দী ধরে জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি ছিলেন বিশ্বশান্তির এই সৈনিক। এতো বছর জেলে থাকলেও তাঁর দর্শন এবং সংগ্রামের কথা জেনে যায় পুরো পৃথিবী। এরপর ১৯৯০ সালে যখন তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরে আসেন, মানুষ তাঁর কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতে থাকেন।
‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেল্ফ’ মূলত ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবনের ছোট ছোট ঘটনার বর্ণনা, ডায়েরির পাতা, দিনপঞ্জি, চিঠি ইত্যাদি। বইটির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়ছে বছরের পর বছর ধরে ম্যান্ডেলার জেল জীবনের বিরস মুহূর্তগুলোর বর্ণনা। বইটিতে তার স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়, স্বপ্ন, রাজনৈতিক পদক্ষেপ সব একত্রে উঠে এসেছে।
ম্যান্ডেলা ছিলেন অত্যন্ত গোছানো মানুষ। তিনি প্রায় সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংরক্ষণ করে রাখতেন এবং প্রচুর নোট লিখতেন। এসব নোট এবং তাঁর পরিবার পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তার লেখা কিছু চিঠির সারসংক্ষেপও রয়েছে এই বইটিতে।
জেলে বসে ম্যান্ডেলার মনে হচ্ছিলো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। একজন বন্দি নেতার মৃত্যুচিন্তার মুহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে রয়ে গেছে তাঁর ডায়েরি লেখার কারণে।
ম্যান্ডেলাকে রুবেন দ্বীপে বন্দি হিসেবে রাখা হয়। ১৯৬৮ সালে, ম্যান্ডেলার ৭৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা তার গ্রাম ট্রানসকেই থেকে একাই রুবেন দ্বীপে জেলবন্দি ছেলেকে দেখতে আসেন। ম্যান্ডেলা লিখেছেন,
‘আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ হলে, আমি তাকে ধীরে ধীরে নৌকার দিকে হেঁটে যেতে দেখি, যে নৌকাটি তাকে আবার মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তখনই আমার মনের মাঝে একটি চিন্তাই বারবার দোলা দিচ্ছিলো যেনো, আমি শেষবারের মতো আমার মাকে দেখছি।’
পরবর্তীতে ম্যান্ডেলার কথাই ঠিক হয়েছিলো। কয়েক মাস পরই তার মা মারা যান। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাবার অনুমতি চেয়েও পাননি তিনি এমনকি নিরাপত্তারক্ষী দ্বারা বন্দি অবস্থায়ও নয়।
মানুষ, সৃষ্টির অন্যসকল প্রজাতি থেকে যে উন্নত এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের ভাষার আবিষ্কার। এই ভাষার কারণেই মানুষ অতীতকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে। পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতাকে সাথে নিয়ে সেখানের ভুলগুলো বাদ দিয়ে, ভালোকে গ্রহণ করতে পারে। ব্যক্তিগত ডায়েরিও কিভাবে এইসব অভিজ্ঞতার বক্তা এবং ইতিহাসের সংগ্রাহক হয়ে উঠেছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ উপরের এই আলোচিত ডায়েরি ক’টি। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, আজকের অতি সাধারণ ডায়েরিও হয়ে উঠতে পারে আগামি সময়ের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
মন্তব্য লিখুন