বেলশেষ হবার আগেই অপরাজিত অপু মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে গেল। গত ১৫ ই নভেম্বর ২০২০ লাখো দর্শক কে চোখের জলে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৬ বছর।
হঠাৎ করে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১ অক্টোবর চিকিৎসকের পরামর্শমতে করােনার নমুনা পরীক্ষা করান। ৫ অক্টোবর পরীক্ষা রিপাের্ট আসে। রিপাের্টে কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যায়। পরে তাকে বেলভিউ নার্সিং হােমে ভর্তি হন।
১৪ অক্টোবর আবার ও করােনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে নেগেটিভ রিপাের্ট আসে। কিছুটা সুস্থ ও হতে শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু তার শরীর হয়তে করোনা’র এই ধকল সহ্য করতে পারেনি। ২৪ অক্টোবর রাত থেকে তার কিডনি’র স্বাভাবিক কাজে সমস্যা হতে থাকে।
ডায়ালাইসিস করানো হয় প্লাজমা থেরাপি ও দেওয়া হয় কিন্তু তার অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ১৫ ই নভেম্বর ২০২০ ভারতীয় সময় ১২টা ১৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চলুন কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
১৯৩৫ সালের ১৯ শে জানুয়ারি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জন্ম গ্রহন করেন। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অভিনেতা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত হলেও তার পেশাজীবন খুবই বৈচিত্র্যময়।
কিংবদন্তি এই অভিনেতা খুব উচ্চমানের একজন আবৃত্তিকার ও ছিলেন। এছাড়া বেশকিছু নাটক ও কবিতা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, অনুবাদক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিলো।তিনি সিনেমা, টিভি ধারাবাহিক, মঞ্চ, যাত্রায় কাজ করেছেন।
তিনি তার অসম্ভব সুন্দর অভিনয় এর মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন কোটি দর্শকের হৃদয়। শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয় ভবিষ্যৎ আরো কয়েক প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন তিনি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আদি নিবাস বাংলাদেশের শিলাইদহের কয়া গ্রামে হলেও তার শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তার বাবা এখানে থাকতে শুরু করেছিলেন। সৌমিত্রের পিতা পেশায় ছিলেন একজন উকিল। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন।
বিভিন্ন সময়ে তার পিতার চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর শিক্ষা জীবনে বেশ বৈচিত্র্য আসে।পিতার চাকরির সাথে সাথে তার বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয় থেকে। উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশােনা শেষ করেন। হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। এরপর আইএসসি, এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করেন কলকাতার সিটি কলেজ থেকে। পরে দুবছর পােস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ পড়াশােনা করেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঘোষক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন।
খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি তার কণ্ঠস্বরের প্রশংসা পেতেন। এরপর কলেজ জীবন থেকেই মঞ্চাভিনয় শুরু করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, যা তাঁর বাচিক দক্ষতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অহীন্দ্র চৌধুরী কাছে তার অভিনেয়র হাতেখড়ি হয়।
শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক দেখে অভিনয়ের প্রতি গভীর প্রেম জন্মে তার। এরপরেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেবার।
১৯৫৬ সালে যখন অপরাজিত সিনেমার জন্য নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন সত্যজিৎ রায় তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়। কিন্তু তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নাকোচ করে দিয়েছিলেন তিনি কারণ অপরাজিত এ অপু চরিত্রের জন্য আরো কম বয়সী অভিনেতা প্রয়োজন ছিলো সত্যজিৎ রায়ের।কিন্তু তখনই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় -কে ভালো লেগে যায় সত্যজিৎ রায়ের।পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে ”অপুর সংসার” সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত ৩৪ টি চলচিত্রের ১৪ টি চলচ্চিত্রে প্রধান ভুমিকায় কাজ করেছেন।এছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সিনেমাতে তার অভিনীত চরিত্র গুলো দেখে মনে হবে যেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা মাতায় রেখেই গল্প গুলো লেখা।
অভিনীত সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র গুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হলো ফেলুদা। ফেলুদা সিরিজের প্রথম দুইটি কাহিনী নিয়ে সত্যজিৎ রায় নিজেই দুটি সিনেমা নির্মান করেছেন, “সোনার কেল্লা” ও “জয়বাবা ফেলুনাথ” আর এ দুটো সিনেমাতেই ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করার পরে, মৃণাল সেন, অজয় কর, তপন সিংহ সহ আরো অনেক বড় বড় পরিচালকের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৬১ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত তপন সিনহা পরিচালিত ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’মুক্তি পায়। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম খল চরিত্রে অভিনয় করেন।
যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সবাই অপু হিসেবে ভালোবেসেছে এবং ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ অথবা ‘সমাপ্তি’-তে যে সুদর্শন নায়ক ঝড় তুলেছেন মহিলা দর্শকের মনে, সেই অভিতাকে খল চরিত্রে মেনে নিতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল দর্শকদের।ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ময়ূরবাহনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ।
অপুর সংসার , ক্ষুদিত পাষাণ, দেবী, তিন কন্যা, ঝিন্দের বন্দী, অতল জলের আহ্বান, বেনারসী , অভিজান , সাত পাকে বাঁধা , চারুলতা, বাক্স বদল, কাপুরুষ , একই অঙ্গে এত রূপ, মণিহার, পরিণীতা, অপরিচিত, অরণ্যের দিনরাত্রি,
প্রথম কদম ফুল, মাল্যদান, স্ত্রী, বসন্ত বিলাপ , অশনি সংকেত , সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, দেবদাস , গণদেবতা , হীরক রাজার দেশে , কোণি , ঘরে বাইরে, গণশত্রু , শাখা প্রশাখা, পারমিতার একদিন, আবার অরণ্যে , চাঁদের বাড়ি , নোবেল চোর, মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর, অলীক সুখ, রূপকথা নয়, দূরবিন, বেলা শেষে সহ আরো অনেক ।
তাপসী , নামজীবন, রাজকুমার, ফেরা , নীলকণ্ঠ, ঘটক বিদায় , দর্পণে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর , টিকটিকি ইত্যা
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে জগতে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৯৮ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনবদ্য অভিনয় প্রতিভার জন্য ২০০৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ-এ সম্মানিত কর হয় এবং ২০০১ ও ২০০৮ সালে। দু’বার চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান, ২০১২ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুবার ফ্রান্সের দুটি সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হন।
১) ‘অর্ডার দি আর্ট এ দে লেটার’ যেটি শিল্পীদেরকে প্রদান করা ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন।
২) ‘লিজিয়ঁ অফ অনার’ হল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান, ভারতের ভারতরত্ন-র সমতুল্য। প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০১৮ সালে তাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন