চার্লি চ্যাপলিন হলিউডের একজন বিখ্যাত হাস্যরসাত্মক অভিনেতা। নিজের কষ্ট লুকিয়ে গোঁটা বিশ্বকে হাসিয়েছেন – চার্লি চ্যাপলিন। দারুন সব হাস্যরসাত্মক অভিনয় আর কৌতুক দিয়ে তিনি সারা পৃথিবীর মানুষের মন জয় করেছেন। নিজের হাজার কষ্ট চেপে রেখেও সকলকে হাসানোর উদ্দেশ্যে কাজ করে গেছেন চার্লি চ্যাপলিন ।
চাপা কোট, ঢিলেঢালা প্যান্ট, মাথায় ডার্বি হ্যাট, বড় জুতা, আর হাতে ছড়ি নিয়ে যে ব্যাক্তিটি গোটা পৃথিবীকে বিনোদনের স্বাদ দিয়ে গেছেন । কে না চেনে এই নির্বাক অভিনেতা, চার্লি চ্যাপলিনকে? আজও আমাদের হাসির খোরাক হিসেবে থেকে গেছে চার্লি চ্যাপলিনের কাজগুলো ।
চলচ্চিত্রের জগতে চ্যাপলিনের সৃষ্টিগুলো অনবদ্য এ কথা অনস্বীকার্য । পৃথিবীর শ্রেষ্ট কৌতুকাভিনেতা ও মূখাভিনেতাদের মধ্যে চার্লি চ্যাপলিন একজন ।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
চার্লি চ্যাপলিনের জন্মসূত্রে প্রদত্ত নাম ‘চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন’ । তিনি ১৮৮৯ সালের ১৬ই এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালওর্থের ইস্ট স্ট্রিটে জন্মগ্রহন করেন । যদিও তার জন্ম সময় নিয়ে অনেক ধোয়াশা রয়েছে । চার্লি চ্যাপলিনের বাবা ’চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র’ এবং মা ছিলেন ‘হান্নাহ চ্যাপলিন’ ।
চার্লি চ্যাপলিনের মা বাবা উভয়েই মঞ্চে অভিনয় করতেন । যখন তার বয়স মাত্র দুই তখন তার বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে ।এরপরে তিনি তার মায়ের সাথেই থাকতেন এবং সাথে থাকত তার সৎ ভাই সিডনি । এরপর শুরু হয় নিষ্ঠুর দারিদ্রতার সাথে তার এক ছাদের তলায় বাস ।
মায়ের অসুস্থতার কারনে অনাথ আশ্রমেও দিন কাটাতে হয়েছে তাকে । অর্থাভাবে মাত্র নয় বছর বয়সেই তাকে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল ।
যখন তার বয়স মাত্র পাঁচ তখন তার মা হান্নাহ একবার মঞ্চে অভিনয় করতে যান তাকে সাথে নিয়ে । অভিনয়ের মাঝপথে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন হান্নাহ , তখন দর্শকদের শান্ত করতে মঞ্চে উঠিয়ে দেয়া হয় সেই ছোট চার্লিকে ।
যদিও প্রথমবার অপ্রস্তুত অবস্থায় মঞ্চে উঠে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি তবুও সেদিন তার উদ্ভট কার্যকলাপ আর সাজসজ্জা দেখে হেসে গড়িয়ে যাচ্ছলেন দর্শকরা । সেই থেকেই তার অভিনয় জগতে প্রবেশ ।
এই শিশু অভিনেতা দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে , কাজ শুরু করে বিভিন্ন নামী থিয়েটারে। তার বয়স যখন ১১ কিংবা ১২ তখন থেকেই সে নির্বাক কৌতুকে অভিনয় করেন এবং সারা ইংল্যান্ডে তার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পরে ।
এর পরেই তিনি তার বাবা মা কে হারিয়েছেন । মাত্র ১৮ বছর বয়সে চার্লি চ্যাপলিন সাইন করেন ‘দ্য কার্নো’ নামের এক মুভি কোম্পানির সাথে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে রওনা হন ।
এখান থেকেই মূলত চ্যাপলিন নিজেকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সুযোগ পান এবং সে সুযোগকে কাজেও লাগান । এর কিছু বছর পরেই যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এবং একাধিক চলচ্চিত্র নির্মান কোম্পানি ‘কিস্টোন স্টুডিও’ থেকে ডাক পান চার্লি চ্যাপলিন ।
১৫০ ডলার সাপ্তাহিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেখানে যোগদান করেন । ১৯১৪ সালে তার ‘মেকিং এ লিভিং’ নামে প্রথম চলচ্চিত্রটি প্রকাশ পায় । চার্লি চ্যাপলিন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন ‘দ্য কিড (১৯২১)’ সিনেমার ‘দ্য লিটল ট্রাম্প’ চরিত্রের মাধ্যমে ।
এই চরিত্রটির হাসিতামাশা, ভাড়ামো, না পাওয়ার হতাশা সব মিলিয়ে তিনি নিজেকে সবার সামনে কৌতুকপুর্ন এক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
আসলে তিনি মানুষ হাসানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা সাথে নিয়েই জন্মেছিলেন হয়ত । এরপর থেকেই তার জনপ্রিয়তা হয় গগনচুম্বি।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তিনি প্রায় ৮০ টির বেশি চিত্রনাট্য নির্মান করেন যার মূল চরিত্রে অভনিয় করেছেন তিনি নিজেই । এরপরে অবশ্য সিনেমা পরিচালনাও করেছেন । মার্লন ব্রান্ডো আর সোফিয়া লরেন অভিনিত তার চলচ্চিত্রটি হলো ‘একাউন্টেন ফ্রম হংকং’।
আরও পড়ুনঃ জোকার -“ দ্যা ক্লাউন প্রিন্স অফ ক্রাইম” কমিক জগতের জনপ্রিয় ভিলেন
চার্লি চ্যাপলিন রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন কিছুটা। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কথার সম্মুখীন হতে হয় তাকে । সে সময়ের বেশ কিছু নামী অভিনেতা , পরিচালকের সাথে চার্লি চ্যাপলিনকেও হাজিরা দেয়ার জন্য বলা হয় কংগ্রেসনাল কমিটির সামনে ।
কিন্তু ১৯৫০ সালের দিকে এই নিয়ে বিভিন্ন গুজব , অপপ্রচার শুরু হয় । এরপরে তিনি স্বস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন । যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার পথে তিনি টেলিগ্রাম পান – ‘পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হলে তাকে একটি নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির সামনে হাজিরা দিতে হবে ।”
কিন্তু এ সিদ্ধান্তে রাজি ছিলেন না চ্যাপলিন । তাই এর পরবর্তী ২০ বছর তিনি সুইজারল্যান্ডের একটি বাড়িতে কাটিয়ে দেন । সেখানেও চার্লি চ্যাপলিনের সাথে দেখা করতে অনেক নামী দামী শিল্পি ,অভিনেতারা আসতেন । এরপরে বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি ।
এরপরে তিনি বাড়িতে বসেই আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন সাথে সাথে পুরানো কাজগুলো আবার নতুন আঙ্গিকে শুরু করেন । সত্তরের দশকে আবার যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখার আমন্ত্রন পান চার্লি চ্যাপলিন।
কিন্তু বিগত দিনের কথা মনে করে কিছুটা সংকোচ হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং মার্কিন চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য অস্কার লাভ করেন । হাজার হাজার অতিথি সেদিন দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সাধুবাদ ও সম্মান জানান চার্লি চ্যাপলিনের প্রতি ।
কিন্তু তখন বছর পার হয়েছে অনেকগুলো, প্রায় ৮৩ । বয়সের ছাপ এসে পড়েছে ততদিনে চার্লি চ্যাপলিনের উপর , শরীর অনেকটাই ভেঙে গিয়েছিল । নানা রকম অসুখ বিসুখ পেয়ে বসেছিল তাকে । সারা বিশ্বকে হাসিয়ে রাখা মানুষটির দিন শেষ হয়ে এসেছিল এতদিনে ।
অতঃপর ১৯৭৭ সালে মাত্র ৮৮ বছর বয়সে বড়দিনের দিন অর্থাৎ ২৫ শে ডিসেম্বর সুইজারল্যাণ্ডের বাড়িতে চার্লি চ্যাপলিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । এই বাড়িটি এখন একটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত আছে ।
১। “ আয়না হচ্ছে আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু কারন যখন আমি কাঁদি তখন সে হাসে না ” ।
২। “ হাসি হলো একপ্রকার ওষুধ যা দুঃখ থেকে মুক্তি দেয়” ।
৩। “ কাছ থেকে দেখলে জীবন হচ্ছে ট্রাজেডি কিন্তু দূর থেকে দেখলেই কমেডি” ।
৪। “ ভালবাসা দাও , ভালবাসা ছড়াও” ।
৫। “ যেদিন আমি ভাল কোন কাজ করি সেদিনই আমার সবচেয়ে সুখের দিন” ।
৬। “ সব সত্যের মধ্যেই মিথ্যার একটা বীজ রয়েছে ”।
৭। “ জ্ঞানী বা বোকা , আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের সাথে লড়াই করতে হয়”।
৮। “ বাস্তবতা নিয়ে চলচ্চিত্র হয় না , চলচ্চিত্র তৈরি হয় কল্পনা দিয়ে”
৯। “ মন খুলে হাসতে চাইলে নিজের দুঃখ যন্ত্রনাগুলো নিয়ে খেলতে শেখো”।
১০। “ দিনশেষে সবকিছুই ঠাট্টা” ।
১১। “ আমি বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে কেউ আমার অশ্রু দেখতে না পারে”।
১২। “ এ বিশ্বে স্থায়ী কিছুই নেই , এমনকি আমাদের সমস্যাগুলোও নয়”।
১৩। “ সরলতা অর্জন করা কঠিন ব্যাপার”।
১৪। “ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলে কখনও রংধনু খুঁজে পাবেনা।”
১৫। “ আমার দুঃখ কষ্ট গুলো কারো কারো হাসির কারন হয়ে থাকতে পারে কিন্তু আমার হাসিগুলো যেন কখনোও কারো দুঃখের কারন না হয়ে দাড়ায় ”
১৬। “ শিল্প হচ্ছে পৃথিবীর কাছে লেখা একটি প্রেমপত্র ”
১৭। “ এমনকি একটি জেলিফিশের কাছেও জীবন অনেক সুন্দর ও দারুন একটা জিনিস ”।
চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক অভিনয়ের প্রেমে পড়েননি এমন লোক খুব কমই আছেন । এছাড়াও তার উদ্ভট সব পোশাক , আচরন, অভিনয় এসবে তার ভক্ত হয়েছেন পুরো পৃথিবীবাসী , তার বিভিন্ন চরিত্রের একাধিক কার্যকলাপ সারা বিশ্বকে হাসিয়েছে , আনন্দ দিয়েছে ।
নিজের ভিতরে কষ্ট চেপে রেখেও অপরের স্বার্থে মুখে হাসি অটুট রেখেছেন চার্লি চ্যাপলিন এবং সেই হাসি ছড়িয়ে দিয়েছেন গোটা পৃথিবীতে । চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র হিসেবে সবসময় বেঁচে থাকবেন তিনি মানুষের অন্তরে ।
ছবিঃ Google and Wikimedia Commons
মন্তব্য লিখুন