প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে পাড়ি জমায় জীবীকার তাগিদে। এই সকল মানুষদেরকে আমার বলি প্রবাসী। প্রবাসে বাংলাদেশিদের অনেক সাফল্যের গল্প মাঝেমধ্যেই শিরোনাম হয়। সে খোঁজ হয়তো আমরা সবাই রাখিনা। তবে আজ এক অন্য রকম সাফল্যের কথা জানাবো। কোরিয়ান সিনেমার নায়ক হয়ে অনন্য সাফল্যের নজির স্থাপন করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার অভিবাসী শ্রমিক “মাহবুব আলম পল্লব”। এখন সেখানে মাহবুব লি নামে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মাহবুব আলম পল্লব।
বাংলাদেশ কিংবা কোরিয়ায় মাহবুব আলম পল্লব এখন কিছুটা পরিচিত মুখ হলেও শুরুর গল্পটা এমন ছিল না। মায়ের চিকিৎসার টাকার রোজগার করার আশায় ১৯৯৯ সালে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া যান মাহবুব। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর।
দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পোশাক কারখানায় অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ভেবে ছিলেন হয়তো বা ভাগ্যের চাকা ঘুরবে এবার কিন্তু তা হয়নি। স্বীকার হন বিভিন্ন বৈষম্যের, এমন বৈষম্যের স্বীকার সব দেশেই হতে হয় প্রবাসীদের।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রতিবাদ করতেই হয়। প্রথম দিকে প্রবাসীদের প্রতি বৈষম্যের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ জানায় মাহবুব আলম পল্লব সহ আরো অনেক প্রবাসী। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার মিডিয়াগুলো প্রবাসীদের তেমন কোনো সুযোগ দিচ্ছিল না।
২০০৪ সালে থেকে মাহবুব আলম পল্লব প্রবাসীদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে থাকে কোনো কোনোটিতে নিজেই অভিনয় করেন। এটা এক ধরনের ব্ল্যাক কমেডি। ডকুমেন্টারি তৈরি এবং তা প্রচারের জন্য অনেক সিনেমা পরিচালকের সাথে তার পরিচয় হয়। সেই সূত্রেই পরবর্তীতে অভিনয়ের সুযোগ পায় মাহবুব আলম পল্লব। “দ্য রোড অব দ্য রিভেঞ্জ” নামের শর্ট ফিল্মে প্রথম অভিনয় করেন তিনি।
এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে মাহবুব বলেন,
“অভিবাসী কর্মী হিসেবে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হতে হয় আমাদের।এ কারণে নিজে অভিবাসী হয়েও অন্যদের নিয়ে কাজ করা শুরু করি। একটা সময় বুঝতে পারি, নিজেদের জন্য গণমাধ্যম তৈরি করা দরকার। সেজন্য তৈরি করতে থাকি ডকুমেন্টারি। অভিনয় বা চলচ্চিত্র নিয়ে একেবারেই অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। পরিকল্পনা ছিল ২-৩ বছর সেখানে থাকবো। তারপর দেশে আসবো। তবে সেটা হয়নি। ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে যাই চলচ্চিত্রে।”
ডকুমেন্টারি তৈরি করতে গিয়ে অনেক পরিচালকের সঙ্গে সিনেমা তৈরির কাজেও সাহায্য করেছেন তিনি। প্রবাসী শ্রমিক থেকে নায়ক হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
“এ ছবির পরিচালক আমাকে চিনতেন। এখানে আমার দায়িত্ব ছিল স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করা ও একজন হ্যান্ডসাম বাঙালি নায়ক খুঁজে বের করা যে কোরিয়ান ভাষা জানে,এবং ভিসার সমস্যাও নাই। খুঁজতে গিয়ে দেখি, মনের মতো কাউকেই পাচ্ছি না। কিন্তু পরিচালক যে বিষয়গুলো চান, তার সবই আমার মধ্যে আছে।তাই নির্মাতাকে গিয়ে বললাম, আমি অভিনয় করলে কেমন হয়? তিনি বললেন, মাহবুব তুমি হ্যান্ডসাম, ভাষাও জানো, ভিসারও সমস্যা নাই। কিন্তু তোমাকে ওজন কমাতে হবে। এভাবেই অভিনয় করা শুরু।”
২০০৯ সালে মুক্তি পায় মাহবুব আলম পল্লব অভিনীত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হোয়ার ইজ রনি…’। একই বছরে আসে ‘বান্ধবী’, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। “বান্ধবী” সিনেমাটি দেখতে গিয়ে আপনারা সবাই অবশ্যই চমকে যাবেন। কারণ ‘বান্ধবী’ সিনেমাটি শুরু হয় বাংলা ভাষায় কথপোকথন দিয়ে।
এখন পর্যন্ত ১৫টির মতো কোরিয়ান নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছেন মাহবুব আলম পল্লব। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে—‘মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, ‘হোয়ার ইজ রনি’, ‘পেইনড’, ‘ইউ আর মাই ভাম্পায়ার’, ‘পারফেক্ট প্রপোজাল’, ‘আসুরা: সিটি অব ম্যাডনেস’ ও ‘লাভ ইন কোরিয়া’।
কোরিয়ান সিনেমায় অভিনয়ের শুরুটাও ছিলো ভিষণ ভয়াবহ মাহবুব আলম পল্লব এর জন্য। নায়ক হিসেবে কোনো কালো চামড়ার বাংলাদেশিকে মেনে নিতে চায়নি অনেকই। মাহবুব আলম জানান যে, শুরুর দিকে অনেকে হুমকি দিয়েছে। সিনেমায় অভিনয় থেকে সরে যেতে বলেছে। এমনকি অনেকে ফোন করে হত্যার হুমকি ও দিয়েছে। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি নিজের মত করে অভিনয় চালিয়ে গেছি। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পুরস্কার নামে খ্যাত সেজং কালচারাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন মাহবুব।
বর্তমানে মাহবুব আলম পল্লব কোরিয়ান চলচ্চিত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন। এছাড়াও কাজ করছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিবেশনায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়ার পরিচালকও তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে পড়াশোনা করেছেন মাহবুব আলম পল্লব। ১৯৯৯ সালে কোরিয়া যাবার কিছু মাস পরেই তার মা মারা যায়। মাহবুব আলমেরা দুই বোন ও নয় ভাই। তার বাবা এখনো বেঁচে আছেন এবং সবাই বাংলাদেশেই থাকে। কোরিয়ান মেয়ে লি মিয়ংকে ভালোবেসে বিয়ে করেন মাহবুব আলম পল্লব। কোরিয়ায় সবাই তাকে মাহবুব লি নামেই চেনে। মাঝে মাঝেই তিনি ও তার স্ত্রী বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন।
মাহবুব আলম পল্লব জানান যে কোরিয়ান সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেলেও বাংলাদেশি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ এখনো পাইনি। তবে কিছু বাংলাদেশি পরিচালকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, হয়তো শীঘ্রই বাংলাদেশের কোনো সিনেমায়ও কাজ করার সুযোগ পাবো। মাহবুব আলম তার অভিনয়ের মাধ্যমে কোরিয়ায়, বাংলাদেশের সুনাম আরো বৃদ্ধি করুক এই কামনাই আমরা করি। অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা রইলো মাহবুব আলম পল্লব ওরফে মাহবুব লির জন্য।
মন্তব্য লিখুন