মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ আমাদের সকলেরই কম বেশি রয়েছে। কিন্তু এই বিশাল মহাবিশ্বের কতটুকুই বা আমরা জানি? শুধু আমরাই নই, বাঘাবাঘা বিজ্ঞানীরাও এক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন। ঠিক এরকমই এক অজানা, অদৃশ্য এবং অদ্ভুতুড়ে পদার্থ হলো ডার্ক ম্যাটার। তবে যতোই অদৃশ্য হোক, বিজ্ঞানীরা একে খোঁজার সম্ভাব্য রাস্তা ঠিকই বের করে ফেলেছেন। আর সেই সম্ভাব্য রাস্তাই হলো মহাকর্ষীয় লেন্সিং। তাই আজকেরে আলোচনা এই মহাকর্ষীয় লেন্সিং কি ও এ থেকে ডার্ক ম্যাটার সন্ধানের রহস্য নিয়ে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
মহাকর্ষীয় লেন্সিং বা গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বলতে মহাকাশে কোনো বিশাল স্বচ্ছ কাঁচের লেন্স আছে তা কিন্তু বোঝায় না। বরং এটি স্থান-কালের চাদরে আলোর নিজস্ব ধর্মের কারনে গঠিত একটি বিশেষ অবস্থা। এটি সহজে বোঝার জন্য আলোর কিছু মৌলিক ধর্ম এবং স্থান-কাল চাদর সম্পর্কে সাধারন কিছু ধারণা থাকলেই যথেষ্ট।
আমরা জানি, বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত আলো সর্বদা সোজা পথে চলে এবং আমাদের চোখও সেটাই দেখে অভ্যস্ত। এদিকে অধিক ভরযুক্ত বস্তু স্থান-কালের চাদরে একটা ঢাল বা বক্রতার সৃষ্টি করে। এই বক্রতার কারনে এর আশেপাশে দিয়ে যাওয়া যেকোনো বস্তুর গতিপথের পরিবর্তন হয়।
আলোও এই পথে যাবার সময় সোজা পথে যায় না। স্থান কালের বক্রতাকে অনুসরণ করে আলোও এখানে কিছুটা বাঁকা পথে চলে। আর তখনই লেন্সের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুর এক বা কিছু ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়।
ধরা যাক, কোনো লক্ষ্যবস্তু ও এর পর্যবেক্ষকের সংযোজক সরলরেখা বরাবর কোন অতি উচ্চ ভরযুক্ত গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল বা আরো অন্য কিছু রয়েছে।
সেক্ষেত্রে এই অতি উচ্চ ভরের কারনে স্থান-কালের চাদরে যে বক্রতার সৃষ্টি হবে তা অনুসরণ করে যাবার সময় আলোর গতিপথও কিছুটা বেঁকে গিয়ে পর্যবেক্ষকের কাছে পৌঁছোবে।
ফলে পর্যবেক্ষক উক্ত আলোক উৎসের একটি প্রতিবম্ব দেখতে পাবে। মাঝের ভারী মহাজাগতিক বস্তুটি এখানে স্থান-কালকে বাঁকিয়ে লেন্সের মতো কাজ করে। আর এই ঘটনাই হলো মহাকর্ষীয় লেন্সিং।
মহাকর্ষীয় লেন্সিং যেমন স্থান-কালের উপস্থিতি প্রমান করে তেমনি আলোর গতিপথ সম্পর্কিতও অনেক ধারণা দেয়। এছাড়াও লেন্সিংএর ধরণ বা প্রতিবিম্বের বিবর্ধন দেখে মধ্যবর্তীবস্তুর ভর বা ধরণ সম্পর্কিত ধারণা লাভ করা যায়।
১৯৭৯সালে টুইন কোয়াসার আবিষ্কৃত হয়। এটা মূলত টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা এক জোড়া কোয়াসার যারা দেখতে প্রায় হুবহু একই রকম এবং খুব কাছাকাছি অবস্থান করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মহাকর্ষীয় লেন্সের ধারনায় এই ভুল ভাঙ্গে। মূলত এখানে একটিই কোয়াসার ছিল, কিন্তু আলোর গতিপথ বেঁকে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা আমাদের কোয়াসারটির দুইটি প্রতিবিম্ব দেখায়। এই ঘটনাটিকেই এ তত্ত্বের প্রথম শক্ত প্রমান ধরা হয়।
উপরন্তু এই মহাজাগতিক লেন্স কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের অধরা বস্তু ডার্ক ম্যাটারের খোঁজও দেয়। আর ডার্ক ম্যাটারের মতো রহস্যময় বস্তুর খোঁজ দিতে পারে যে, সে তো বিজ্ঞান মহলে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে তা বলাই বাহুল্য।
ডার্ক ম্যাটার, বা বাংলায় এটি তমোপদার্থ নামে পরিচিত। তবে এখনো এই পদার্থ আমাদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়, আর তা হবেই বা কি করে? বিজ্ঞানীরাই এখন পর্যন্ত এই পদার্থ সম্পর্কে বেশি তথ্য জানতে পারেন নি। আর তার অনেকগুলি কারনের মধ্যে সবথেকে বড় কারন হলো এটিকে মোটেই চোখে দেখা যায় না।
ডার্ক ম্যাটার কেন দেখা যায় না? এর উত্তর বোধ হয় খুব কঠিন নয়। আমরা কোনো কিছু তখনই দেখি যখন কোনো আলোক উৎস থেকে আলো অন্য কোনো বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। অথবা কোনো আলোক উৎস থেকে আলো সরাসরি আমাদের চোখে আসলেও আমরা তা দেখি।
এখন এই ডার্ক ম্যাটার নামক বস্তুটি আলোর সাথে কোনো ক্রিয়াতেই যায় না। অর্থাৎ ডার্ক ম্যাটার আলো্র সামান্য অংশও শোষন, বিকিরন কিংবা প্রতিফলন করে না। আর আলোর সাথে যেহেতু এটি কোনো ক্রিয়া প্রদর্শন করে না তাই এটি যতই বড় হোক বা ছোট হোক আমাদের পক্ষে তা দেখা সম্ভব হয় না।
অদেখা বস্তু ডার্ক ম্যটারের সত্যতা নিয়ে বহুকাল ধরেই বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। তবে মহাকর্ষীয় লেন্স আবিষ্কার হবার পর তমোপদার্থের অস্তিত্বের পক্ষে বিজ্ঞানীদের ধারণা আরো দৃঢ় হয়।
মনে করা যাক, কোনো মহাজাগতিক লেন্সিংএর ঘটনা পর্যবেক্ষন করা হল। তাহলে তার আলোর পথের বেঁকে যাওয়ার মান থেকে লেন্সের ভর বা মধ্যবর্তী মহাকর্ষীয় বস্তুর ভর নির্ণয় করা সম্ভব। বা মাঝে অবস্থিত গ্যালাক্সির যে ভর আলোর পথকেও সেই অনুযায়ীই বাঁকা উচিৎ।
কারন স্থান-কাল চাদর সেই অনুযায়ী বেঁকে যাবে, আর আলো এই বেঁকে যাওয়া পথকেই অনুসরন করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায়, যে পরিমান ভর আমরা পর্যবেক্ষন করি তার জন্য আলোক পথের যে পরিমান বেঁকে আসার কথা প্রকৃ্ত পক্ষে আলো তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেঁকে যায়।
আলোর এই অতিরিক্ত বাঁকনের কারন অবশ্যই স্থান-কালের অতিরিক্ত বিকৃ্তি। কিন্তু সেখানে যে ভর দৃশ্যমান তাতে এই বিকৃ্তি হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ সেখানে অবশ্যই এমন কোনো ভর রয়েছে যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আর হয়তো এই অদৃশ্য বস্তুটিই রহস্যময় তমোপদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার।
এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানমহলে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। এর ফলে অনেকেই যারা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না তারা এর উপস্থিতি মেনে নেন। এখন বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই তমো পদার্থের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। ধারনা করা হয় যে, বিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৭% ভাগ এই ডার্ক ম্যাটারেই নিহিত।
এই মহাবিশ্বের কতটুকু যে আমরা জানি সেটাই আসলে আমরা এখনো জানি না। এথেকেই আমাদের ক্ষুদ্রতা অনুমান করা যায়। সেই অজানার মধ্যে অন্যতম হলো ডার্ক ম্যাটার যার কিছুটা ধারনা মহাকর্ষীয় লেন্সিং থেকে পাওয়া যায়। গ্রাভিটেশনাল লেন্সের অনেক প্রকার ভেদ আছে, মহাকাশে এর আরো অনেক বাস্তব উদাহরণও আছে।
এখানে সবার জন্য খুবই সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। আরো বিস্তারিত জানতে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটগুলো অনুসরণ করতে পারেন। তাতে আপনিও হয়তো জানতে পারবেন আরো মজার নতুন কোনো তথ্য!
মন্তব্য লিখুন