একজন মানুষকে অদ্বিতীয়ভাবে শনাক্ত করার জন্য যতগুলো উপায় আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ ও ঝামেলাহীন উপায় হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন হয়।
ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধু মাত্র ঐ ব্যক্তিকে অদ্বিতীয়ভাবে শনাক্তই করা হয় না, ঐ ব্যক্তির জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস, কাজ, স্বাস্থ্যের প্রকৃতি এমনকি ঐ ব্যক্তি মাদক গ্রহণ করে কিনা সেই তথ্যও পাওয়া যায়।
সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের আঙ্গুলের প্রতি ভাঁজে রয়েছে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের হজারো তথ্য। তাই ফিঙ্গারপ্রিন্টকে দৈহিক তথ্য ব্যাংক ও বলা হয়ে থাকে। এজন্যই কোনো অপরাধস্থলে পৌঁছে পুলিশ বা গোয়েন্দারা শুরুতেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ খোঁজা শুরু করে।
অপরাধস্থল থেকে পাওয়া ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেলেই আসল অপরাধীকে ধরে ফেলা সহজ হয়ে যায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ যে শুধু মাত্র অপরাধী শনাক্তকরনে ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু নয়, নিরাপত্তা বা গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য ও ব্যবহার করা হয় থাকে এটি।
যেমন মনে করুন আপনি যদি আপনার ফোনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক ব্যবহার করেন তাহলে শুধু মাত্র আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই সেটি আনলক বা খোলা সম্ভব। অন্যকেউ সেটিকে আনলক করতে পারবে না। এতে করে আপনার ফোনের তথ্য নিরাপদ থাকবে একইসাথে আপনার তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকবে।
অনেক অফিস ও স্কুল কলেজে কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিষ্ট্রেশন ও ভিসার আবেদন এর কাজেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করা হয়। যারা সাক্ষর করতে পারে না তারাও তাদের সাক্ষর হিসেবে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে থাকেন।
প্রাচীন কাল থেকেই অজানা বিষয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। আঙ্গুলের ছাপের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য থাকায় এটি নিয়েও গবেষণা শুরু করেন অনেক বিজ্ঞানী। তবে সেসকল বিজ্ঞানী ও তদের কাজের বিষয়ে সম্পর্কে বলার আগে চলুন একটি অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে আসি।
বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীদের কাজের কথা উঠলেই কোরআনের কথা এমনিতেই চলে আসে। কারণ কোরআনে বিশ্বের সকল বিষয়ের জ্ঞান রয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পবিত্র কোরআনে বেশ কিছু জায়গায় সরাসরি না হলেও পরিস্কারভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ইঙ্গিত রয়েছে।
কাফেররা যখন কিয়ামতকে অস্বীকার করে, সুরা ইয়াসিনের ৭৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভুত কথা বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে, কে জীবিত করবে অস্থিসমূহকে যখন সেগুলো পচেঁ গলে যাবে?”
তার উত্তরে মহান আল্লাহ সুরা কিয়ামার ৩নং আয়াতে বলেছেন, “মানুষ কি মনে করে আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? বরং আমি তার আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম।” ১৪০০ বছর পূর্বে যখন বিজ্ঞানের উল্লেখ ছিলো না তখনই আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সকল জ্ঞান সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন।
এখন আবার ফিরে আসি বিজ্ঞানীদের কথায়, সর্বপ্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্টের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৪ সালে। ইংরেজ শারীরতত্ত্ববিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং অনুবিক্ষণ যন্ত্রবিদ নিহেমিয়া গ্রিউ একটি বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায় সর্বপ্রথম হাতের তালু ও আঙ্গুলের ছাপের কথা উল্লেখ করেন।
পরের বছর ডাচ শারীরতত্ত্ববিদ গোভার্ড বিড এবং ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মারসিলো বিডলো দেহতন্ত্র বিশ্লেষণের উপর একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তারা ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ননা করেন।
কিন্তু তারা তখন ও জানতেন না যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে কোনো মানুষকে অনন্যেভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। এরপর বহুবছর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে আর কোনো বর্ননা পাওয়া যায়নি।
১৮৫৯ সালে স্যার উইলিয়াম হারশেলস (তৎকালীন ভারতের আই. সি.এস) প্রথম আবিষ্কার করেন যে সময়ের সাথে সাথে মানুষের আঙ্গুলের ছাপের কোনো পরিবর্তন ঘটে না, বরং দীর্ঘদিন পরও সেটির অনন্য বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
১৮৭৭ সালে তিনি কোনো ব্যক্তির শনাক্তকরণের মাধ্যম হিসেবে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহারের বিষয়টিকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৯২ সালে স্যার ফ্রান্সিস গ্যাল্টন ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস’ নামের বহুল আলোচিত একটি বই প্রকাশ করেন।
এই বইয়ে তিনি আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে পরিচয় শনাক্তকরণের বিষয়ে আরো ব্যাপক আলোচনা করেন। বইটি পড়ে স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি (তৎকালীন বেঙ্গল পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল) অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
তারপর তিনি এই বিষয়ে অনেক গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৬ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সিস গ্যাল্টন এর গবেষণার তথ্য কাজে লাগিয়ে আঙ্গুলের ছাপের শ্রেণীবিন্যাস করণের কাজ চালিয়ে যান। তার এই শ্রেণীবিন্যাস অপরাধবিজ্ঞানে ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে পরিচিত। এই শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। অপরাধবিজ্ঞানে এই অভূতপূর্ব অবদানের যাবতীয় কৃতিত্ব এবং বহু সম্মাননা লাভ করেন তিনি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই শ্রেণীবিন্যাসকরণ আসলে তিনি নিজে করেননি। তিনি ছিলেন শুধু মাত্র একজন তত্ত্বাবধায়ক। তার তত্ত্বাবধায়নে কাজি আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু নামের দুই মেধাবী বাঙালি করেছিলেন এই শ্রেণীবিন্যাসকরণ। (তবে উল্লেখ্য যে এ কাজে হেমচন্দ্র বসুর তুলনায় কাজি আজিজুল হকের বেশি অবদান রয়েছে)। এক্ষেত্রে বলা যায় যে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মূল আবিষ্কারক কাজি আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু।
চিত্রঃ আজিজুল হক (বামে) এবং হেমচন্দ্র বসু (ডানে)
যেহেতু এই শ্রেণীবিন্যাসকরণে আজিজুল ও হেমচন্দ্র বেশি কাজ করেছেন, তাই এই সিস্টেমটির নামে তাদের নামও উপস্থিত থাকা উচিৎ। অন্যদিকে বিপক্ষের যুক্তি, যেহেতু মূল ধারণাটি স্যার হেনরিরই ছিল, তাই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের অধিকারী তিনিই।
তবে যাইহোক রিচার্ড হেনরি একেবারে অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তার সুপারিশে আজিজুল হক ও হেমচন্দ্রও বেশ কিছু সম্মাননা ও অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবং দীর্ঘদিন পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহারের পদ্ধতিটি আবিষ্কারের প্রধানতম কৃতিত্ব খান বাহাদুর কাজি আজিজুল হকের।
অপরাধ দমন ও অপরাধী শনাক্তকরনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতির অনেক বড় অবদান আছে। আর তাই এই পদ্ধতির আবিষ্কারক আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোস এর স্মরণে, বর্তমানে ব্রিটেনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিভাগে ‘হক অ্যান্ড বোস অ্যাওয়ার্ড‘ নামে বিশেষ একটি পুরস্কারও প্রচলিত রয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কাজ করে চলা উদ্ভাবনী ব্যক্তিদেরকে এই পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ রোয়ার মিডিয়া এবং চাঁদপুর টাইমস
মন্তব্য লিখুন