এরিয়া-৫১, কল্পনা করুন আমাদের গ্রহের এমন একটি স্থান যেখানে ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা হয়! এলিয়েনদের স্পেসশীপ, তাদের টেকনোলজি সম্পর্কে বিস্তর অনুসন্ধান হয়। তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও বৈঠক হয়। এমন একটি স্থানের কথা চিন্তা করুন যেখানে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, সভ্যতাকে হাতের মুঠোয় নিয়া নেওয়ার মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিভিন্ন গ্যাজেট, টাইম ট্রাবেল ও টেলিপোর্টেশনের মতো ইত্যাদি অবিশ্বাস্য সব বিষয় নিয়ে নির্ঘুম এক্সপেরিমেন্ট হয়।
এবার আপনার কল্পনার ক্যানভাসের সেই স্থানটিকে বাস্তবে রূপ দিন। আপনার মনের প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তুলা সে জায়গাটি পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়া একটি জায়গার সাথেই মিলবে যেটাকে নিয়ে আজ এত কথা। পৃথিবীর বুকে মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত সর্বোচ্চ গোপনীয় এ স্থান সম্পর্কে জানতে কৌতূহলী সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের ধূর্ত সব গুপ্তচরেরা দশকের পর দশক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আদৌ কি পৃথিবীতে এমন কোন স্থান আছে যেটা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনী ঘেরা? রহস্যময় অদ্ভুত কল্পকাহিনী চাদরের আবৃত এমন কোন জায়গা আছে কী এই গ্রহে?আপতত দৃষ্টিতে সেই অপার্থিব জায়গাটি হচ্ছে এক ও একমাত্র উদ্ভট স্থান এরিয়া-৫১ (Area-51)।
যুগ যুগ ধরেই মার্কিন বিমান বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এরিয়া-৫১ এক রহস্যময় স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বছরের পর বছর এই জায়গাটিকে ঘিরে নানান অদ্ভুত কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে, হচ্ছে। অদ্ভুত গা ছমছমে কন্সপাইরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের এক অবিসংবাদিত উৎস হয়ে আছে এই এরিয়া-৫১।
যাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায় উত্থাপিত হাজারো রহস্যঘেরা প্রশ্ন, যার হয়তো উত্তর জনসাধারণের কারো জানা নেই। সবচেয়ে বড় অমিমাংসিত যে ‘কন্সপাইরেসি থিওরি’টা আলোচিত হয় এই স্থানকে নিয়ে,তা হচ্ছে এলিয়েন সম্পর্কিত। কত শত ডকুমেন্টস, বই রচিত হয়েছে। টেলিভিশন শো আয়োজন, এমনকি হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ইভেন্টের কথায় ধরুন না, কি হয়নি এরিয়া-৫১ নিয়ে।
একটু নড়েচড়ে বসুন। ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুপ্ত ও কুখ্যাত সামরিক ঘাটি এরিয়া-৫১ সম্পর্কে জানতে। আজ জানবো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় এ জায়গাটির আদ্যোপান্ত এবং উদ্ঘাটন করবো রহস্য মিশ্রিত সকল প্রশ্নের।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে যাওয়ার কথা এরিয়া-৫১ আসলে কী? এরিয়া-৫১ মার্কিন বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত অত্যন্ত গোপনীয় ও নিরাপত্তা বেষ্টিত সামরিক ঘাটি। যার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের অঙ্গরাজ্য নেভাডায়।
নেভাডার দক্ষিনাঞ্চলের অনুর্বর মরুভূমির মধ্যে লবনাক্ত-সমতল গ্রুম হ্রদের (Groom Lake) ঠিক পাশে অবস্থিত। এটি মূলত নেভাডা পরমানু পরিক্ষা ক্ষেত্রের(Nevada Nuclear Test Site) অন্তর্ভুক্ত, যদিও বা নেভাডা নিউক্লিয়ার টেস্ট সাইট পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বিভাগ দ্বারা। কিন্তু এরিয়া-৫১ (Area-51) পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিভাগ তথা বিমান বাহিনী দ্বারা।
এরিয়া-৫১ এর নামকরণটাও এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। তবে নির্ভরযোগ্য যে কারণটা জানা যায় তা হলো। নেভাডা টেস্ট সাইট, পরমাণু শক্তি কমিশন দ্বারা অনেকগুলো চিহ্নিত খন্ডে বিভক্ত। যেমনঃ এরিয়া-১, এরিয়া-২….. এভাবে। এরিয়া-৫১ নেভাডা টেস্ট সাইটের এরিয়া-১৫ ঠিক পাশেই অবস্থান করে। কিন্তু সিআইএ (Central Intelligence Agency) কর্তৃক বলা হয়ে থাকে এরিয়া-৫১ এর সঠিক নাম হুমেই বিমানবন্দর(Homey Airport) এবং গ্রুম হ্রদ(Groom Lake)। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ঘাটি এরিয়া-৫১ কে ড্রিমল্যান্ড(Dreamland) ও প্যারাডাইস র্যাঞ্চ(Paradise Ranch) নামেও সম্মোধন করা হয়েছে।
এরিয়া-৫১, নেভাডা টেস্ট সাইট রুট নেটওয়ার্কের সাথে কানেক্টেড। নেভাডার সর্ব দক্ষিণের লস এঞ্জেলস থেকে ইউএস রুট’৯৫ (U.S Route 95) ১০৫ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে চলে গিয়ে সেখানে মার্কারি হাইওয়ের সাথে মিলিত হয়। যেটি আবার সোজা উত্তরে ৮কি.মি পর মার্কারি নামক গ্রাম অতিক্রম করে গ্রুমলেক রোডে এসে শেষ হয়। গ্রুমলেক রোড পরবর্তীতে হুমেই এয়ারপোর্ট তথা এরিয়া-৫১ এসে পৌঁছায়। সবশেষে গ্রুমলেক রোড এরিয়া-৫১ মাড়িয়ে জাম্বলেড পর্বতমালা(Jumbled Hill) বুক চিরে টিকাবু উপত্যকা(Tikaboo Valley) হয়ে রাচেল(Rachel) শহরের দক্ষিণে ‘এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়াল হাইওয়ের’ সাথে একত্রিত হয়।
১৯৬০ এর দশকের কথা লকহিড কোম্পানির এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেলি জনসন (Kelly Johnson) বলেন,
“আমরা এর উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা বুঝে নিলাম এটাই সেই উপযুক্ত জায়গা যেটা আমরা খুজছিলাম। এটা ছিল শুষ্ক লবণাক্ত সমতল হ্রদের ঠিক পাশে। এটা ছিল অন্য আরেকটা এডওয়ার্ড বিমান ঘাটি। তাই আমরা তার উপরে ক্রমাগত ঘুরতে লাগলাম এবং অবতরণ করলাম। তারপর এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চড়ে বেড়ালাম। এটা ছিল একদম যথাযথ প্রাকৃতিক ল্যান্ডিং ফিল্ড বা অবতরণ ক্ষেত্র যা এতটাই মসৃণ ছিল যে, যেন একটি বিশাল বড় বিলিয়ার্ড টেবিল (একধরনের খেলার মসৃণ সমতল টেবিল)। ”
ইউ-২ (U-2) গুপ্তচর বিমানের ডিজাইনার ও ইঞ্জিনিয়ার কেলি জনসনসহ একটা টিমকে ‘ইউ-২ স্পাই প্লেন’ এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গোপনীয় একটি জায়গা খোঁজার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা গ্রুম হ্রদের পাশের ঐ জায়গাটা খুঁজে পান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীর কথা, তখনকার সোভিয়েত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক যুদ্ধ না থাকলে ও দু’দেশের মধ্যকার কুটনৈতিক মতবিরোধ চলতেই থাকলো। তখন দু-দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যু যেমন প্রযুক্তি, অর্থনীতি, বিশ্ব কুটনীতি নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর দিয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিমান উড্ডয়ন পরিচালনা করতো।তবে বিমানগুলো তখন নিচু দিয়ে আকাশে উড়তো,যার ফলে সোভিয়েত বাহিনীর সেগুলো ভূপাতিত করার একটা জোর সম্ভাবনা ও আশংকা ছিল। যার ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত উচু দিয়ে উড়ে এমন প্লেন তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। সাল ১৯৫৪ নবেম্বর মাস। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডিওয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার একটি গোপন প্রজেক্টের অনুমোদন করেন।
প্রজেক্ট একুয়াটোন (Project Aquatone) নামে পরিচিত প্রজেক্টটির মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল হাই-অ্যালটিটিউড (High-Altitude) স্পাই প্লেন বানানো। যেটা আকাশের অনেক উচ্চতায় উড়ে নজরদারি করতে পারে।এভাবেই ডেভেলপ করা হয় লকহিড ইউ-২ গুপ্তচর বিমান। পরবর্তীতে যদিও কোল্ড ওয়ার তথা স্নায়ু যুদ্ধের অংশ হিসেবে ১৯৬০ সালের পহেলা মে সোভিয়েত রাশিয়ার উপর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ইউ-২ স্পাই প্লেন রাশিয়া তাদের মিসাইলের মাধ্যমে ভূপাতিত করে। এটাই প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে তখনকার স্নায়ুযুদ্ধ কতটা প্রখর ছিল।
সিআইএ (CIA-Central Intellgence Agency) কর্তৃক পরিচালিত প্রজেক্ট একুয়াটুন সফল করার জন্য তথা ইউ-২ গুপ্তচর প্লেন তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি গোপনীয় স্থানের প্রয়োজন ছিল। এর অন্বেষণে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেলি জনসন সহ একটি গ্রুপকে। পরবর্তীতে তারাই আবিষ্কার করেন এরিয়া-৫১। সেখান থেকেই এর যাত্রা শুরু।
তখন থেকেই নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও উচ্চতর নিরাপত্তায় মুড়িয়ে রাখা হয়েছে এ স্হানটিকে। সেই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে একবিংশ শতাব্দীর দুদশক চলে যাচ্ছে কিন্তু এরিয়া-৫১ নিয়ে কল্পনা জল্পনা যেন থামছেই না। কেনই বা এই স্থানটি নিয়ে এত রহস্য? চলুন উত্তর টা জেনে নি!
মানলাম এরিয়া-৫১ একটি মার্কিন বিমানঘাটি। এও মানলাম এখানে বিভিন্ন এয়ারক্রাফটের পরীক্ষা নিরীক্ষা সংঘটিত হয়। কিন্তু যখন দেখা যায় ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জায়গাটি অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় রাখা হয় তখন রহস্য জমাট বাঁধাবেই। এরিয়া-৫১ এর উপর দিয়ে কোন বিমান যাওয়ার অনুমতি নেই। সম্পূর্ণ জায়গাটি ধাতব বেড়া বা প্রাচীরে ঘেরা না থাকলেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘেরা। পুরো স্থানটি জুড়ে রয়েছে অসংখ্য সিকিউরিটি ডিভাইস। মোবাইল সিসি ক্যামেরা, মোশন ডিটেক্টর,লেজার ডিটেক্টর, সাউন্ড ডিটেক্টর এবং সর্বাধুনিক স্মেল ডিটেক্টর ড্রোন সহ কত ইলেকট্রনিক ডিভাইস যারা প্রত্যেকটি এঙ্গেলে এরিয়া-৫১ এর চারদিকে একনজরে তাকিয়ে আছে।
স্থানীয়দের মতে এই ঘাটিটা নেভাডা মরুভূমির সকল কচ্ছপ ও খরগোশকে চিনে, তাদের লাফানো পর্যন্ত ট্রেকিং করে। এরিয়া-৫১ এর পুরো এলাকা জুড়ে সাদা পিকআপ ট্রাকে সদা সতর্ক অবস্থায় পাহারা দিচ্ছে উচ্চ সুসজ্জিত অস্ত্রশস্ত্র সহিত হাজার হাজার ছদ্মবেশি সৈন্য। যাদেরকে পথচারীরা ক্যামমো ডুডস (Cammo Dudes) নামে অভিহিত করেন।
আর এ স্থানের আশেপাশে অসংখ্য সতর্ক সাইন লাগানো আছে অনুপ্রবেশকারীদের উদ্দেশ্যে। অতি উৎসাহীদের সাবধান করতে লাগানো আছে শত শত নোটিশ। সেখানে লিখা, “Deadly force is authorized against trespasser”. যার মানে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। বারণ সত্ত্বেও কেউ অনুপ্রবেশ করলে সরাসরি তাকে মেরে ফেলার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যামমো ডুডসদের।
এছাড়াও আকাশ পথে সিকিউরিটি বাড়ানোর জন্য এরিয়া-৫১ ঘাটির উত্তর পুর্ব দিকে ১৫৫ মাইল দুরে ৯৪০০ ফুট উঁচু বল্ড পাহাড়ের ( Bald Mountain) চুড়ায় লাগানো আছে অনেক বড় একটি ARSR-4 (Air Route Surveillance Radar) রাডার। এত এত নিরাপত্তা ও সর্বক্ষণিক নজরদারি, তাছাড়া অসংখ্য ক্যামমো ডুডদের পাহারাদারির মধ্যে থাকলে যে কেউরই সন্দেহ উদ্গম হতে পারে, আসলে ভেতরে চলছেটা কী?
আমেরিকার অত্যন্ত সুরক্ষিত কিছু স্থান যেমন, হোয়াইট হাউস,পেন্টাগন,নাসা সদর দপ্তর ইত্যাদি তে সাধারণ মানুষের প্রবেশ থাকলেও এরিয়া-৫১এর ত্রিসীমানায় সংবাদকর্মী ও জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। সম্ভবত এসব কারণেই শত শত প্রশ্ন তাক করে এরিয়া-৫১এর দিকে, রহস্যের বরফ জমে বারংবার। হচ্ছেটা কী এর ভেতরে?
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন ইউ-২ গুপ্তচর বিমান তৈরি করা হয় এবং এরিয়া-৫১ এলাকায় পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন পরিচালনা করা হয়। এরিয়া-৫১ নিয়ে রহস্যের জাল তখন থেকে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ইউ-২ গুপ্তচর বিমানটি ৬০,০০০ ফুট থেকে ৭০,০০০ ফুট উপর দিয়ে চলাচল করতো। তখনকার সময়ে অন্যান্য বিমান ১০,০০০ ফুট থেকে ২০,০০০ ফুট উপর দিয়ে উড়তো। ঠিক তখনই রহস্যের দানা বাঁধতে লাগলো, তখনই অসংখ্য ইউএফও (UFO- Unidentified Flying Object) সাইটিং এর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো।
যদিও সত্যিকার অর্থে তখনকার বিমানচালকরা জানতোই না এত উঁচু দিয়ে কোন বিমান উড়তে পারে। তাই তারা ইউ-২ বিমান উড্ডয়নকে ইউএফও সাইটিং হিসেবে ধরে নিয়েছিল। এ ব্যাপারটি যদিও তখন মার্কিন বিমান বাহিনীর অফিশিয়ালরা জানতো, কিন্তু এ বিষয়ে তারা কখনো খোলাশাভাবে মুখ খুলেনি। কেননা তারা এটাই চাইছিল যে এর ভেতরে সত্যিকার অর্থে কি চলছে সেটা কেউ যেন না জানে।
ইউএফও সাইটিং সহ নানা ঘটনা লোকমুখের আড়াল থেকে এর ভেতর চলমান কর্মকাণ্ডকে ঢেকে রাখবে এটাই এরিয়া-৫১ কর্তৃপক্ষের চাওয়া। তখন থেকে ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত জায়গাটি অস্তিত্ব সম্পর্কে আমেরিকান সরকার কোন বিবৃতিমূলক স্বীকার করেনি। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম বারাক ওবামা সরকার সিআইএ কর্তৃক অত্যন্ত গোপনীয় এই স্থানের অস্তিত্ব নিয়ে স্বীকৃতি দেন। সিআইএ কর্তৃক প্রকাশিত ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস (Declassified Documents) দ্বারা স্বীকার করে নেন উচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত এ মার্কিন বিমান বাহিনীর ঘাটি এরিয়া-৫১ রয়েছে।
এরিয়া-৫১ নিয়ে মানুষের আগ্রহের প্রমাণ বোধহয় একেই বলে। গতবছরের ঠিক এসময়ের কথা নির্দিষ্ট করে বললে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর মাসের লাস্টের দিকে, অনলাইনে “Storm Area 51” নামে একটি ফেসবুক ইভেন্ট খোলা হয়। ম্যাটি রবার্টস নামে একজন ২০ বছরের মার্কিন তরুণ এই ইভেন্ট ক্রিয়েট করেন এবং প্রস্তাব করেন, “We can run faster than their bullets. Let’s see them aliens.” ইভেন্টির লক্ষ্য ছিল এরিয়া-৫১ কে জনসাধারণের কাছে উন্মোচিত করা। এই ইভেন্টে ২ মিলিয়ন মানুষ “Going” বাটনে রেসপন্স করেছিল এবং ১.৫ মিলিয়ন মানুষ ‘Interested’ অপশনে ক্লিক করে আগ্রহ দেখিয়েছিল। এবং ইভেন্টকে কেন্দ্র করে মিউজিক ফেস্টিভ্যালের ও আয়োজন করা হয়েছিল।
ভাবা যায় এরিয়া-৫১ নিয়ে ছোট্ট একটি অনলাইন ইভেন্টেও ঝড় বয়ে যাবে। রীতি মত মার্কিন সরকারকে এর প্রতিবাদে বিবৃতি দিতে হয়। এবং FBI ঐ তরুণ ম্যাটি রবার্টসকে আটক করে, জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং গুরুতর ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেয়। দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এ বক্তব্যে মার্কিন বিমান বাহিনীর স্পোকসওম্যান লউরা ম্যাকঅ্যান্ড্রিউ বলেন, সকল কর্মকর্তারা এসব অনলাইন ইভেন্ট সম্পর্কে যথা সজাগ আছেন। এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা জানিয়ে তিনি বলেন, “এরিয়া-৫১ মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি মুক্ত ট্রেনিং রেইঞ্জ এবং আমরা এই স্থানের আশেপাশে কাউকে আসার চেষ্টা করাকে অনুৎসাহিত করি। যেখানে আমরা আমেরিকার আর্মড ফোর্সকে প্রশিক্ষণ দিই। এবং মার্কিন বিমান বাহিনী আমেরিকা ও তার সম্পত্তি সংরক্ষণের সবসময়ই চেষ্টা করে।”
এরিয়া-৫১ এর ভেতরে সত্যিই কি হচ্ছে, কোন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে সেটা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন সরকার তথা এরিয়া-৫১ কর্তৃপক্ষ কখনোই মুখ খুলেনি।হুম এটা সত্য যে তারা শুধুমাত্র এর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। এর ভেতরের কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে সেটা যুগের পর যুগ প্রাচীন জল্পনা হয়ে আছে। এর ভেতরের কাহিনির জমাট বাঁধা বরফ আজো গলেনি, অনাগত দিনে গলবে কিনা ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্নটা তোলা থাক!
রহস্যময়ী কল্প-কাহীনির বরফ জমাট বাঁধারই কথা, এতটা সুরক্ষিত ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় আবৃত ঘাটির অভ্যন্তরে কি চলছে সেটা সকল শ্রেনির মানুষের মনো জগতে চিন্তা,আগ্রহ ও জানার চাপ বাড়াবে বৈকি।তবে এরোস্পেস হিস্টোরিয়ান এবং Images of Aviation ‘Area 51’ বইয়ের লেখক পিটার ডব্লিউ. মার্লিনের মতে, যিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে এরিয়া-৫১ নিয়ে গবেষণা করছেন,তিনি বলেন, “And there sure is still a lot going on there” (অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে এরিয়া-৫১ এ বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড এখনো চলমান রয়েছে)।”
তাহলে এটা তো নিশ্চিত কিছু না কিছু এরিয়া-৫১ এর অভ্যন্তরে সদা ঘটমান হচ্ছে। নিয়মিত সেখানে বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধান চলমান আছে। তাহলে সেখানে কোন কোন বিষয়ের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ করা বড় কঠিন। কারণ শুরুতেই বলেছিলাম এরিয়া-৫১ নিয়ে বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরি তথা জল্পনা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে।যেগুলোর কোন উত্তর আজো কেউ দিতে পারেনি।রহস্য ঘনীভূত এত বেশি পরিমাণে হয়েছে যে এ স্থানকে নিয়ে তাই এসব কন্সপিরেসি থিওরির জন্ম।
এমনি কতক কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে যুক্তি, তথ্য ও প্রমাণ হাজির করে আগুনে অক্সিজেন জুগিয়েছেন কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা। অসংখ্য কল্পনায় রচিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রসার ও প্রচার লাভ করেছে এই জায়গাটি নিয়ে। এ স্থানটিকে নিয়ে আলোচিত সমালোচিত কন্সপিরেসি থিওরি গুলো নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে ডিটেইলসে পড়ুন এখানে।
এরিয়া-৫১ এর ভিতরে সত্যিকার অর্থে কি চলমান সেটা আমেরিকার বিভিন্ন অত্যাধুনিক বিমান তৈরি বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করলে আমরা বুঝতে পারি। ১৯৫০ এর দশকে রাশিয়ার উপর আকাশ হতে নজরদারির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র Lockheed U-2 স্পাইপ্লেন তৈরি করে।যেটি কিনা ৭০,০০০ ফুট উপর দিয়ে চলাচল করতে পারতো, যা তখনকার সময়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড়া কোন বিমান ছিল।প্রজেক্ট একুয়াটোন মূলত ইউ-২ গুপ্তচর বিমান তৈরি,উড্ডয়ন, সর্বোপরি এর পরীক্ষণকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়।তখনকার সময়ে এই প্রজেক্টির বাজেট ছিল ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে ২০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
এর পরবর্তীতে প্রজেক্ট অক্সকার্ট পরিচালিত হয় এবং ১৯৫৯ সালে আসে নতুন আরও একটি গুপ্তচর বিমান Lockheed A-12।১৯৬৩ সালের দিকে এটি প্রথম উড্ডয়ন শুরু করে এবং ১৯৬৮ সালের জুনে এটি তার সর্বশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে।
লকহিড এ-১২ প্লেনটিকে পাইলট বিহীন ড্রোন হিসেবে উড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।পরিকল্পনাটি বিরুদ্ধে ভেটো দেন লকহিড ইঞ্জিনিয়ার কেলি জনসন তিনি জানান এটি অত্যন্তভারী এয়ারক্রাফট, এটাকে ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করা অসম্ভব। ফলস্বরূপ তারা নতুন একটি ড্রোন প্লেন নিয়ে আসেন ১৯৬২ এর দিকে, যার নাম Lockheed D-21।
১৯৬০ সালের পহেলা মে, তখনকার সোভিয়েত রাশিয়ার উপর দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার সময়, ইউ-২ স্পাইপ্লেনটিকে ভূপতিত করা হয় এবং পাইলট গ্যারি পাউয়ার জীবিত উদ্ধার করে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার পরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডিওয়াইট ডি. আইজেন আওয়ার ইউ-২ স্পাইপ্লেন তৈরির কর্ণধার লকহিড মার্টিনকে চাপ দিতে থাকেন, যেন ২০ মাসের মধ্যে ইউ-২ থেকে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন স্পাইপ্লেন বানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয় SR-71 Blackbird। যেটির ১৯৬৪ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রথম উড্ডয়ন পরীক্ষা করা হয়। ইউ-২ স্পাইপ্লেনের ডিজাইনার কেলি জনসন বলেন, এটি ৮০,০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে ঘন্টায় ২১০০ মাইল বেগে উড়তে পারে। যা কিনা শত্রু পক্ষের জন্য অসম্ভব এই প্লেনটি ট্রেক করা।
এভাবেই মার্কিন বিমান বাহিনীর ঝুলিতে আসতে থাকে আরোও কিছু গুপ্তচর বিমান, যেমন ১৯৮১ সালের Lockheed F-117, ১৯৮২ তে আসে Tacit Blue ইত্যাদি অসাধারণ ক্ষমতাধর সব বিমান। সেই সময় থেকে এরিয়া-৫১ হয়ে উঠে পরীক্ষণীয় নানান অত্যাধুনিক গুপ্তচর বিমানের টেস্টিং সাইট। এখানে প্লেন ওয়ার্কশফ, ল্যাব ফ্যাসিলিটি,হাউসিং ইউনিট, রানওয়ে ইত্যাদি বিষয় ইনস্টলেশন করা হয়।যদিও মার্কিন সরকার এসব অত্যাধুনিক প্লেন গুলোর তৈরি পেছনে মূল কারণ সোভিয়েত রাশিয়াকে টক্কর দেওয়া, যেখানে কোল্ড ওয়ার তথা স্নায়ুযুদ্ধই বড় কথা যা আজ অবধি চলমান। তাই আমেরিকা এরিয়া-৫১ কে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রাখার জন্য পরিকল্পনা করেছিল, এবং এখন পর্যন্ত সেটাই তারা করে আসছে।
সুতারাং বুঝা যায় এরিয়া ৫১ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান সরকারের কাছে। এরিয়া ৫১ সম্পর্কীত অজানা আরো অনেক বিষয় নিয়ে ২য় পর্বে জানানো হবে। এরিয়া ৫১ নিয়ে আপনাদের মতামত জানাবেন কমেন্টে।
আরও পড়ুনঃ “এরিয়া-৫১” রহস্যে মুড়ানো দুর্বোধ্য ঘাটির আত্মকথন! (পর্ব-২)
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ
ভালো লিখছো Amjad Hosain .