আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের দেশে ও উপমহাদেশে রাসূল (সা:) এর তথাকথিত ভালোবাসা ও সম্মানের নামে তাঁর জন্মদিন পালন, জন্মদিনের নামে মিলাদ ও মিস্টির ছড়াছড়ি এবং ১২ রবিউল আউয়াল যে সঠিক জন্মদিন নয় এর প্রমান সরূপ কোরআন ও হাদিসের আলোকে একটি পর্যালোচনা উপস্থাপন করা, ইং শা আল্লাহ।
রাসূল (সা:) এর জন্মদিন সম্পর্কে অনেক বিতর্ক থাকা সত্যেও ১২ রবিউল আউয়াল দিনটি আমাদের দেশ সহ এ উপমহাদেশে বেশ প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। যদিও তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে ১০-১২ টি মত ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে খুঁজে পাওয়া যায়৷ তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে রাসূল (সা:) এর জন্মদিন নয়, ব্যপারে বেশ জোরালো যুক্তি ও দলিল রয়েছে।
আফসোস, যে সকল মানুষেরা এই প্রচলন শুরু করেছিল তারা সত্যিই কি রাসূলের সম্মান ও ভালোবাসার দাবি রাখে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মূলত রাসূল (সা:) এর জন্মদিন উৎযাপন প্রচলনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, এর উৎপত্তি যারা ঘটিয়ে ছিল তারা ছিল শিয়া জাতি একাংশ অংশ বিশেষ। যদি ইতিহাস খোঁজা হয় তাহলে এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকবে না।
একঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের তারিখ ও মাস নির্দিষ্ট করা নিয়ে কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট কোনো বানী উল্লেখ হয়নি। তাই সিরাত প্রণেতা ও ঐতিহাসিকগণ এ নিয়ে মতানৈক্য করেছেন। এ মতানৈক্যের যৌক্তিক কারণও রয়েছে। যেহেতু কারো জানা ছিল না যে, এ নবজাতক শিশু ভবিষ্যতে বড় কিছু হতে পারে? অন্য নবজাতকের জন্ম কে যেভাবে নেয়া হত, তাঁর জন্মকেও ঠিক তাই সেভাবে নেয়া হয়েছে। এ জন্য রাসূল (সা:) এর জন্মদিন নির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত কেউ করেননি।
দুইঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম সম্পর্কিত যে তথ্যগুলোর ব্যাপারে সকলে একমত সেটা হচ্ছে- জন্মের সাল ও দিন (বার)।
জন্মের সাল: তাঁর জন্মের বছর ছিল “আমুল ফিল” তথা হস্তি বাহিনীর বছর।
ইমাম ইবনুল কাইয়ূম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার অভ্যন্তরে হস্তি বাহিনীর বছর জন্ম গ্রহণ করেন।”
ইবনে ইসহাক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তার জন্ম ছিল হস্তি বাহিনীর বছর। অধিকাংশ আলেমের নিকট এ অভিমতটি প্রসিদ্ধ।
ইমাম বুখারির উস্তাদ ইবরাহিম ইবনে মুনযির বলেছেন, এ ব্যাপারে কোন আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি।
জন্মদিন: তিনি সোমবারে জন্ম গ্রহণ করেন, সোমবারে নবুওয়ত পান এবং সোমবারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবু কাতাদা আনসারি (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত-
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবারেরোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এ দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে অথবা এ দিনে আমার উপর (অহি) নাযিল হয়েছে।” [সহিহ মুসলিম (১১৬২)]
তিনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের ব্যাপারে মতবিরোধ হচ্ছে মাস ও তারিখ নিয়ে। এ বিষয়ে আমরা আলেমদের একাধিক অভিমত জানতে পারি । যেমন-
১. কেউ কেউ বলেছেন: রাসূল (সা:) এর জন্মদিন ২ রা রবিউল আউয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন। ইবনে কাছির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন-
“কেউ কেউ বলেছেন ২ রা রবিউল আউয়াল। ইবনে আব্দুল বারর “ইস্তেআব” গ্রন্থে এ অভিমত উল্লেখ করেন এবংওয়াকেদি এ বর্ণনাটি আবু মাশার নাজিহ ইবনে আব্দুর রহমান আল-মাদানি থেকেও উদ্ধৃত করেন”।[আস-সিরাতুন নববি]
আরও পড়ুনঃ ইসলামে আয় ও ব্যয় এর নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানুন
২. কেউ কেউ বলেন: রাসূল (সা:) এর জন্মদিন ৮ ই রবিউল আউয়াল।
ইবনে কাছির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “কেউ বলেছেন: ৮ ই রবিউল আউয়াল। হুমাইদি এ বর্ণনাটি ইবনে হাজম থেকে বর্ণনা করেন। আর মালেক, উকাইল ও ইউনুস ইবনে ইয়াযিদ প্রমুখ এটি বর্ণনা করেন জুহরি থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে জুবাইর ইবনে মুতয়িম থেকে। ইবনে আব্দুল বারর বলেন, ঐতিহাসিকরা এ মতটিকেসঠিক বলেছেন।”
হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারজেমি এ তারিখের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। হাফেজ আবুল খেতাব ইবনে দিহইয়াহ ‘আত-তানবির ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাজির’ গ্রন্থে এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন”।[আস-সিরাতুন নববিয়াহ(১/১৯৯)]
৩. কেউ কেউ বলেছেন: রাসূল (সা:) এর জন্মদিন ১০ রবিউল আউয়াল।
ইবনে কাছির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ- “কেউ বলেন: ১০ রবিউল আউয়াল। এ মতটি ইবনে দিহইয়াহ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে আসাকের এ মতটি আবু জাফর আল-বাকের থেকে এবং মুজালিদ নামক রাবী শা‘বি থেকে বর্ণনা করেন”।[আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)]
৪. কেউ কেউ বলেছেন: রাসূল (সা:) এর জন্মদিন ১২ রবিউল আউয়াল। ইবনে ইসহাক (রহ) তাঁর লেখা সীরাত গ্রন্থে ( সিরাতে ইবনে ইসহাক) এ মতটি উল্লেখ করেন । ইসলামের প্রথম বিশুদ্ধ সীরাত বলে এই সীরাত গ্রন্ধ বেশি প্রসিদ্ধ ৷
কিন্তু সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ইবনে ইসহাক (রহ.) তার সিরাত গ্রন্থে সব কিছুর যথাযথ রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ১২ রবিউল আউয়াল রাসূল (সা:) এর জন্মদিন এর কোনো রেফারেন্স দিতে পারেননি। এটা নিতান্তই তার নিজস্ব গবেষণা বলে জানা যায়। অনেকে বলেছেন, তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন রমযান মাসে, কারো কারো মতে, সফর মাসে; ইত্যাদি আরও অভিমতরয়েছে।
আমাদের নিকট যে মতটি অগ্রগণ্য মনে হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট বা বারো তারিখের কোন একদিন জন্ম গ্রহণ করেন। কিছু কিছু মুসলিম গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ গবেষণা করে বের করেছেন যে, রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ সোমবার ছিল! তাহলে এটা আরেকটি মত হল। এ মতটিও শক্তিশালী, এ তারিখটি ৫৭১ খৃষ্টাব্দের নিসান (এপ্রিল) মাসের বিশ তারিখ পড়ে। সমকালীন সিরাত প্রণেতাদের কেউ কেউ এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যেউস্তাদ মুহাম্মদ আল-খুদারি ও শফিউর রহমান মোবারকপুরি অন্যতম।[ইসলামিক কিউএ]
উস্তাদ মুহাম্মদ আল-খুদারী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “মিসরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মরহুম মাহমুদ পাশা (মৃত্যু : ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)-যিনি একাধারে জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, গণিতবিদ্যা, বই লেখা ও গবেষণায় পারদর্শী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ছিল সোমবার সকাল বেলা, রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ মোতাবেক এপ্রিল/নিসান-এর ২০ তারিখ, ৫৭১ বা ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ। এ বছরটি হস্তি বাহিনীর ঘটনার প্রথম বছর। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন বনু হাশেম পল্লীতে আবু তালেবের ঘরে”। [নূরুল ইয়াকিন ফি সিরাতে সাইয়্যেদিল মুরসালিন, পৃষ্ঠা-৯; আর-রাহিকুল মাখতুম (পৃষ্ঠা নং: ৪১)]
সুতরাং এই উমরাহর সর্বশেষ চুড়ান্ত গবেষণায় এটা স্পষ্ট যে রাসূল (সা) এর জন্মদিন সমসম্ভাব্য তারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল। কারন এ দিনটিই সহিহ মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী সোমবার বেশি প্রমানিত হয়।
মৃত্যুদিন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, তিনি সোমবার দিন মারা গেছেন।
মৃত্যু সালের ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, তিনি ১১ হিজরিতে, রবিউল আউয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করেন।
১. অধিকাংশ আলেম বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ।
২. খাওয়ারেযমি বলেছেন, রবিউল আউয়ালের প্রথম তারিখ।
৩. ইবনু কালবি ও আবু মিখনাফ বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখ। সুহাইলি ও হাফেজ ইবনে হাজার এ মতের দিকেই ঝুঁকেছেন।
তবে অধিকাংশ আলেমের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগারো হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন। সুহাইলিপ্রণীত “আর-রওদুল উন্ফ (৪/৪৩৯-৪৪০), ইবনে কাছিরের “আস-সিরাহ আন-নববিয়াহ” (৪/৫০৯), ইবনে হাজারের “ফাতহুল বারি” (৮/১৩০)।
বিভিন্ন তথ্য ও ঐতিহাসিকদের মন্তব্য আমরা দেখলাম। সর্বশেষ চুড়ান্ত গবেষণার ফলাফল অনুসারে এটা স্পষ্ট যে রাসূল (সা:) সোম বার দিন জন্মগ্রহণ করেন, অধুনিক মিশরীয় গবেষণায় পাওয়া যায় দিনটি ছিল ৯ রবিউল আউয়াল। আর রাসূল (সা:) সোমবার মৃত্যু বরন করেন এবং দিনটি ১২ রবিউল আউয়াল। মহান “আল্লাহ” -ই সবচেয়ে ভালো জানেন।
ইতিহাস ও গবেষণার খাতিরে আমাদের জানা প্রয়োজন হতে পারে রাসূল (সা:) এর জন্মদিন ও মৃত্যু দিন সম্পর্কে। কিন্তু এই দিনটি উৎযাপন করা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতে স্পষ্ট বিদআত। যেহেতু রাসূল (সা), সাহাবারা (রা.), তাবেঈন, তাবে তাবেঈন কেউ এই দিন উৎযাপন করেননি। তাই আমরাও করতে পারি না। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের দ্বীনের সহিহ বুঝ দান করুক, আমরা তাঁর ক্ষমা ও হেদায়েত প্রার্থনাকারী।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন