মহান আল্লাহ্ তায়া’লা রাব্বুল আ’লামীন এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। অসীম বিস্তৃত এই মহাজগতের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির বসবাস উপযোগী। আর এই মানবজাতিকে দিয়েছেন সময় নামক এক বিশেষ নিয়ামত অর্থাৎ পৃথিবীতে সময়ের হিসেব রাখার জন্য দিয়েছেন রাত,দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ ও শতাব্দী। যদিও মহান আল্লাহ্ তায়া’লার দেওয়া প্রতিটা দিন ও রাত কিন্বা সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এই সময়, দিন, রাত ও মাসের মধ্যে কিছু সময়, দিন বা রাত অথবা মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে অনেক বেশি। ঠিক তেমনি একটি মাস হচ্ছে যিলহজ্জ মাস। এই যিলহজ্জ মাসের ফজিলত, আমল ও মর্যাদা বান্দার জন্য মহান আল্লাহর দেওয়া অমূল্য নিয়ামত, সৌভাগ্যময় এবং ইবাদতের জন্য এক মহান মৌসুম।
মূলত যিলহজ্জ মাস হচ্ছে হজ্জ পালন করার প্রধানতম মাস। তাই একদিকে যেমন রয়েছে এ মাসে হজ্জের মতো বিশাল ফজিলত। তেমনি রয়েছে বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল, নফল রোজা এবং বান্দার গুনাহ মাফের বিশাল এক সুবর্ণ সুযোগ। সুতরাং এ মাস সম্পর্কে আমাদের একটি পরিস্কার বিশুদ্ধ জ্ঞান বা ধারণা থাকাও অত্যন্ত জরুরী। তাই আজ আমরা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে তেমনি একটি বিশুদ্ধ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই প্রবন্ধে। চলুন তবে এ মাসের এমন কিছু আমল, ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে জেনে আসা যাক, ইংশাআল্লাহ্।
(১) “আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা।” [সুরা হজ্জ , ২৮]
(২) “অধিক হারে নেক আমল করা।” [বুখারী-মুসলিম]
(৩) “পাপের পথ না মাড়ানাে।” [বুখারী-মুসলিম]
(8) “সামর্থ্যবান হলে হজ্জ করা।” [বুখারী-মুসলিম]
(৫) “সামর্থ্যবান হলে কুরবানী করা।” [সুরা কাউসার ৩-তিরমিযী]
(৬) “কুরবানিচ্ছুক ব্যক্তি এই দশদিন নখ, চুল ইত্যাদি না কাটা।”[মুসলিম]
(৭) “বেশি বেশি তাকবীর তাহমীদ ও তাহলীল বলা।যথা- আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” [বুখারী]
(৮) “আরাফার দিন ফজর থেকে ঈদের চতুর্থ দিন অর্থাৎ ১৩ যিলহজ্জ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর নারী-পুরুষ সকলে কমপক্ষে ১বার করে উক্ত তাকবীর পাঠ করা।” [বায়হাকী, হাকেম]
(৯) “আরাফার দিনে রােযা রাখা।” [মুসলিম]
(১০)”ঈদের সালাত আদায় ও ঈদের সুন্নাহসমূহ পালন করা।”
{তথ্য সংগ্রহঃ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন}
প্রথমেই বলেছি এ মাসটি মূলত পবিত্র হজ্জ পালনের অন্যতম প্রধান মাস। আর এ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে অর্থাৎ এই ছয় দিনে হজ্জের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। আবার এ মাসের মর্যাদা ও ফজিলত অন্য সকল মাসগুলোর থেকেও অনেক বেশি।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে নাজিল হয়েছে-
আল্লাহ্ তায়া’লা বলেন-“শপথ ভোরবেলার! শপথ ১০ রাতের!” [সূরা ফজর : ১-২]
এখানে শপথের দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে দশরাত্রি। ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত কাতাদা ও মুজাহিদ প্রমুখ তাফসীরবিদদের মতে, এতে যিলহজ্জের প্রথম দশদিন বোঝানো হয়েছে। [ইবনে কাসীর]
আর এ ১০দিন সর্বোত্তম দিন বলে বিভিন্ন হাদীসে স্বীকৃত, এমনকি এ মাস জিহাদ করার চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ।
যেমনটি হাদীস শরীফে এসেছে-
“এদিনগুলোতে নেক আমল করার চেয়ে অন্য কোন দিন নেক আমল করা আল্লাহর নিকট এত উত্তম নয় অর্থাৎ যিলহজ্জর দশদিন। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়! তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মাল নিয়ে জিহাদে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি।”
[দেখুনঃ বুখারী- ৯৬৯, আবু দাউদ- ২৩৪৮, তিরমিয়ী- ৭৫৭, ইবনে মাজহ- ১৭২৭, মুসনাদে আহমাদ- ১/২২৪]
তাছাড়া এই দশদিনের তাফসীরে হযরত জাবের (রা.) বৰ্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-
“নিশ্চয় এ দশদিন হচ্ছে কোরবানীর মাসের দশদিন, বেজোড় হচ্ছে আরফার দিন, আর জোড় হচ্ছে কোরবানীর দিন।”
[দেখুনঃ মুসনাদে আহমাদ- ৩/৩২৭, মুস্তাদরাকে হাকিম- ৪/২২০, আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী- ৪০৮৬, ১১৬০৭, ১১৬০৮]
সুতরাং এখানে দশরাত্রি বলতে যিলহজ্জের দশদিন বোঝানো হয়েছে। কুরতুবী (রহ.) বলেন, “জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হাদীস থেকে জানা গেল যে, যিলহজ্জের দশদিন সর্বোত্তম দিন।”
এ সকল দলিল ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ করে যে, যিলহজ্জে দশটি দিন বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে উত্তম; এমনকি রমযানের শেষ দশদিবসের চেয়েও উত্তম। তবে, রমযানের শেষ দশরাত্রি যিলহজ্জের দশরাত্রির চেয়ে উত্তম; যেহেতু ঐ রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর আছে, যে রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম।”[দেখুন: তাফসীরে ইবনে কাছীর (৫/৪১২)]
যিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও অন্যতম প্রধান আমল হচ্ছে সামর্থ্য থাকলে হজ্জ পালন করা। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ্ তায়া’লা বলেন-
“হজ্জ সম্পাদন করো সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ্জ করা স্থির করে, তার জন্য হজ্জের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বৈধ নয়। তোমরা উত্তম কাজ যা কিছু করো, আল্লাহ্ তা জানেন এবং তোমরা তোমাদের সাথে পাথেয় নিয়ে নাও। বস্তুত পক্ষে উৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া বা আত্মসংযম। সুতরাং হে জ্ঞানবানগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো।”[সূরা বাকারা-১৯৭]
“যারা হজ্জ অথবা উমরা করার নিয়তে ইহরাম বাঁধে, তাদের উপর এর সকল অনুষ্ঠানক্রিয়াদি সম্পন্ন করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। এ দু’টির মধ্যে উমরার জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। বছরের যে কোন সময় তা আদায় করা যায়। কিন্তু হজ্জের মাস এবং এর অনুষ্ঠানাদি আদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কাজেই এ আয়াতের শুরুতেই বলে দেয়া হয়েছে যে, হজ্জের ব্যাপারটি উমরার মত নয়। এর জন্য কয়েকটি মাস রয়েছে, সেগুলো প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। আর তা হচ্ছে শাওয়াল, যিল্ক্বদ ও যিলহজ্জ। হজ্জের মাস শাওয়াল হতে আরম্ভ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর পূর্বে হজ্জের ইহরাম বাঁধা জায়েয নয়।”[তাফসীরে জাকারিয়া]
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
“যে কেউ এমনভাবে হজ্জ করবে যে, তাতে ‘রাফাস’, ‘ফুসূক’ ও ‘জিদাল’ তথা অশ্লীলতা, পাপ ও ঝগড়া ছিল না, সে তার হজ্জ থেকে সে দিনের ন্যায় ফিরে আসল, যে দিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিল।”[বুখারী: ১৫২১, মুসলিম: ১৩৫০]
যদি কারো কুরবানী করার মত সামর্থ্য থাকে তবে তাকে অবশ্যই কুরবানী করতে বলা হয়েছে। যিলহজ্জ মাসের ফজিলত সমূহের মধ্যে কুরবানী করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.)-এর কাছে সাহাবাগণ বললেন-
“হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! এ কুরবানী কী? উত্তরে তিনি বললেন- ‘তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ তাঁরা পুনরায় বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?’ উত্তরে তিনি (সা.) বললেন- ‘কুরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে।’ তাঁরা আবারো প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! ভেড়ার লোমের কী হুকুম?'(এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়) তিনি (সা.) বললেন- ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে।” [ইবনে মাজাহ-২২৬]
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন-
“যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।” [ইবনে মাজাহ-২২৬]
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন-
“আমাকে প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যা আল্লাহ্ উম্মতে মুহাম্মদির জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি বলুন, (যদি আমার কুরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে। যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। তা আল্লাহর নিকট তোমার কুরবানী।” [আবু দাউদ, নাসায়ি, ত্বহাবি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩০৫]
হাদীস শরীফে যিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও আমল বর্ণনায় রোজা রাখার কথা খুবই গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে। বিশেষ করে ৯ ই যিলহজ্জ (আরাফার দিনে) রোযা রাখার কথা জোর উৎসাহ দিয়ে বলা হয়েছে।আবার আমাদের নবী (সা.) এ দশদিনে নেক কাজ করার প্রতিও উদ্বুদ্ধ করেছেন। রোযা রাখা অনেক নেক কাজের বা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। রোযাকে আল্লাহ্ তায়া’লা নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন।
হাদিসে কুদসীতে এসেছে-
“বনী আদমের সকল আমল তার নিজের জন্য শুধু রোযা ছাড়া। রোযা আমারই জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দিব।”[সহিহ বুখারী-১৮০৫]
নবী, রাসূল (সা.) যিলহজ্জের ৯ তারিখে রোযা রাখতেন। হুনাইদা বিন খালিদ থেকে তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে নবী (সা.)-এর জনৈক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন-
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৯ই যিলহজ্জ, আশুরার দিন ও প্রতিমাসে তিনদিন রোযা রাখতেন। মাসের প্রথম সোমবার ও প্রথম দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।”
[দেখুনঃ সুনানে নাসাঈ (৪/২০৫) ও সুনানে আবু দাউদ, আলবানী রহ. সহীহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (২/৪৬২) হাদীসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]
যিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের প্রতিদিন রোযা রাখার কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কেউ চাইলে তা পালন করতে পারবেন। তবে বিশেষত ৯ যিলহজ্জ (আরাফার দিনে) নফল রোযা রাখা বেশি ফজিলতপূর্ণ একটি বিশেষ আমল। কিন্তু যারা হজ্জ করবে অর্থাৎ আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজী সাহেবদের জন্য এই রোযা প্রযোজ্য নয়।
হযরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন-
“আরাফার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তায়ালা তার (রোজাদারের) বিগত এক বছরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।” [তিরমিজি শরিফ-১৫৭]
যিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও আমলগুলোর মধ্যে এই মাসের প্রথম দশদিন বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা অর্থাৎ তাকবীর তাহমীদ পাঠ করতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসেবে দিয়েছেন, তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে পারে।”[সূরা হজ্জ, আয়াত: ২৮]
আল্লাহ্ তায়া’লা জন্য কুরবানী করার পর, সেই চতুষ্পদ জন্তুর গোশত আল্লাহ্ আমাদের জন্য হালাল করেছেন। এটা আমাদের জন্য বাড়তি আল্লাহর নিয়ামত সরূপ ।
আর এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলে সেই দিনগুলো বোঝানো হয়েছে, যেগুলোতে কুরবানী করা জায়েয, অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ। [ইবনে কাসীর] আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এখানে যিলহজ্জের দশদিন এবং আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোসহ মোট ১৩ দিনকে বোঝানো হয়েছে। [ইবনে কাসীর]
তাই এ মাসে বেশি বেশি আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। কেননা এ ১০দিনে তাকবীর দেয়া, আলহামদুলিল্লাহ পড়া, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ও সুবহানাল্লাহ পড়া সুন্নত। এমনকি মসজিদে ও বাড়ি-ঘরে ও সর্বস্থানে উচ্চস্বরে এই তাসবিহগুলো পড়া উচিত। কেননা এর মাধ্যমে প্রকাশ্যে মহান আল্লাহর ইবাদত পালন করা হয় এবং আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তবে এগুলো পুরুষেরা প্রকাশ্যে পড়বে; আর নারীরা গোপনে পাঠ করবে।
যিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমলের বর্ণনায়, হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করে বলেন-
“আল্লাহর কাছে এ দশদিনের চেয়ে অধিক মহান ও আমল করার জন্য অধিক প্রিয় আর কোন দিন নেই। সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পড়।”
[দেখুনঃ মুসনাদে আহমাদ (৭/২২৪), আহমাদ শাকের এ সনদটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
সহীহ হাদীসে তাকবীর বলার পদ্ধতি হচ্ছে-
“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।” তবে এ ছাড়াও সহীদে আরও কিছু পদ্ধতি বর্ণিত আছে।
এই মাসে হযরত ইবনে উমর (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে সাব্যস্ত আছে যে, যিলহজ্জের দশদিনে তাঁরা দুইজন বাজারে গিয়ে তাকবীর দিতেন এবং তাঁদের তাকবীর শুনে লোকেরাও তাকবীর দিত। অর্থাৎ লোকদের তাকবীরের কথা স্মরণ হত; তখন প্রত্যেকে নিজে নিজে তাকবীর দিত। তবে এর দ্বারা দলবদ্ধভাবে একই সুরে তাকবীর দেয়া উদ্দেশ্য নয়; কেননা সেটা শরিয়তসম্মত নয়।”[ইসলাম কিউএ]
একজন মুসলমানের প্রধান কর্তব্য হলঃ খাঁটি মনে তওবায়ে নাসূহার মাধ্যমে যিলহজ্জ মাসের দিনগুলো শুরু করা এবং মহান আল্লাহ্ তায়া’লার ইবাদতে বেশি মনোযোগ দেওয়া।
সালফে সালেহীনগণ যিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও মর্যাদার জন্য প্রথম ১০দিনের ইবাদতে তাঁরা একনিষ্ঠভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতেন। প্রিয় নবী, রাসূল (সা.) যিলহজ্জ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনায় এসেছে- “যখন যিলহজ্জ মাসের ১০ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার ওপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।”[দারেমি]
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, যিলহজ্জ মাসের ফজিলত এবং এ ১০ দিনের আমলগুলোতে স্পষ্টভাবে সালাত, রোজা, হজ্জ, যাকাত, সাদকা ও বেশি বেশি আল্লাহর তাকবীর, তাসবিহ্ বা যিকিক পাঠ করার মতো মূল ইবাদতগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। যা অন্যান্য মাসে বা সময়ে যথাযথভাবে একসাথে দেখা যায় না এবং আদায় করাও হয় না।
কিন্তু সবচেয়ে আফসোস এর বিষয়টি হলো, এ মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল আল্লাহ তায়া’লার বেশি বেশি প্রশংসা করা অর্থাৎ তাকবীর দেওয়ার মত সুন্নাতটি আজ সবচেয়ে কম পালন করতে দেখা যায় অর্থাৎ আমরা ভুলে যাই বা প্রায় ভুলে গেছি। তাই আসুন আমরা বেশি বেশি তাকবীর দেই, অন্যকে তাকবীর শুনিয়ে স্মরণ করিয়ে দেই। সুন্নাতটিকে আবার নিজেদের কন্ঠে জীবন ফিরিয়ে দেই৷
কোনো বিস্মৃত সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং এতে প্রভূত সওয়াব থাকার দলিল হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ (সা.) বাণী-
“যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর মৃতপ্রায় কোন সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করবে, সে ব্যক্তি ঐ সুন্নতটির উপর আমলকারীদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; কিন্তু, আমলকারীর সওয়াব থেকে কোন কিছু কমানো হবে না।”
[দেখুনঃ সুনানে তিরমিযি (৭/৪৪৩); অন্যান্য হাদিসের কারণে এটি ‘হাসান’ হাদিস]
মহান আল্লাহ্ তায়া’লা যেন আমাদের যিলহজ্জ মাসের ফজিলত সমূহ দান করেন। এ মাসের মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো যথাযথ ভাবে পালন করার তৌফিক দান করেন। আমরা সবাই যেন খাঁটি মনে তওবা করে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে পারি। মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার মত প্রতিযোগিতায় নিজেদেকে আত্মনিয়োগ করতে পারি। আমিন।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন