মানুষ সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা প্রতি নিয়ত নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। মানব ভ্রুন দেখতে কিরকম? কিভাবে ক্ষুদ্র ভ্রুন থেকে সৃষ্টি হয় বিশাল দেহ? পবিত্র কোরআনে ভ্রুন সম্পর্কিত তথ্য কতটা বিজ্ঞান সম্মত ? আজ আমরা বিজ্ঞান ও কোরআনের আলোকে মানব ভ্রুন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব “ইনশাআল্লাহ” । চলুন তবে শুরু করা যাক-
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
পবিত্র কোরআনে মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার স্তর সম্পর্কে সুস্পষ্ট একাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেনঃ “আর আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ থেকে। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে একটি নতুনরুপে দাড় করিয়েছি।” সুতরাং, নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা কতই না কল্যাণময়। (সূরা আল-মুমিনুন:১২-১৪)
আরবিতে “আলাকা” শব্দের ৩টি অর্থ রয়েছে। যথাঃ
১. জোক
২. সংযুক্ত জিনিস
৩. রক্তপিণ্ড
চিত্র-১
যদি আমরা জোককে গর্ভস্থ সন্তানের সাথে মেলাতে যাই তাহলে, আমরা দু’টির মধ্যে সাদৃশ্যতা দেখতে পাই। জোক যেমন অন্যের রক্ত খায় তেমনি উক্ত মানব ভ্রুন তার মায়ের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। চিত্র-১ এ লক্ষ করুন তাহলেই বুঝতে পারবেন।
চিত্র-২
আলাকা শব্দের অর্থের আলােকে আমরা যদি তাকে ‘সংযুক্ত জিনিস’ অর্থে নিই তাহলে দেখতে পাই যে, গর্ভস্থ মানব ভ্রুন মায়ের গর্ভের সাথে লেপ্টে আছে (চিত্র -২)। অর্থাৎ মায়ের গর্ভের সাথে ভ্রুন সংযুক্ত থাকে।
চিত্র-৩
আমরা ‘আলাকা’ শব্দের অর্থ যদি ‘রক্তপিণ্ড’ গ্রহন করি তবে দেখতে পাব যে, তার বাহ্যিক অবস্থা ও তার সংরক্ষিত আবরণ রক্তপিণ্ডের মতােই দেখায় (চিত্র- ৩)। অর্থাৎ ভ্রুন অবস্থায় এখানে প্রচুর পরিমাণ রক্ত বর্তমান থাকে। এতদসত্বেও ২১ দিন পর্যন্ত এ রক্ত সঞ্চালিত হয় না। সুতরাং বলা যায় যে, মানব ভ্রুন এর অবস্থা রক্তপিণ্ডের মতােই।
চিত্রে জোক ও মানব ভ্রুকে একই রকম দেখা যাচ্ছে। এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে উক্ত স্ক্রনটি মায়ের গর্ভের সাথে লেপ্টে রয়েছে। এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে চিহ্নিত স্ক্রনটি মাতৃগর্ভে লেপ্টে আছে। এর বয়স মাত্র ১৫ দিন এবং এর আয়তন ০.৬ মি.মি.
এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে মানব ভ্রুন ও তার আবরণে প্রচুর রক্ত থাকার কারণে রক্ত পিণ্ডের মতােই দেখাচ্ছে। উক্ত ‘আলাকা’ শব্দের তিনটি অর্থের সাথেই মানব ভ্রুনের বিভিন্ন স্তরের গুণাবলী হুবহু মিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।
কুরআন মাজীদের আয়াতে উল্লিখিত মানব ভ্রুনের ২য় স্তর হলাে (মুদগাহ) অর্থাৎ হলাে চর্বিত দ্রব্য। যদি কেউ ১ টুকরা চুইংগাম নিয়ে দাঁতে চর্বন করার পর তাকে স্ক্রনের সাথে তুলনা করতে যায় তাহলে দেখতে পাবে যে, দাঁতে চর্বন করার পর উক্ত দ্রব্য যেমন দেখায় সেটার সাথে ভ্রুনের হুবহু মিল রয়েছে৷ চিত্র- ৪ এ লক্ষ করুন।
চিত্র-৪
আজ বিজ্ঞানীরা মাইক্রোস্কোপসহ অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে এগুলাে আবিস্কার করেছে। যা পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার প্রায় দেড় হাজার বছর পর। তাহলে একটু চিন্তা করুন প্রিয় পাঠকগণ, এত কিছু জানা মুহাম্মদ সাঃ এর জন্য কেমন করে সম্ভব ঐ সময়ে যখন এ সবের কিছুই আবিস্কৃত হয় নি!!!
এ চিত্রটি ২৮ দিন বয়সের (মুদগাহ স্তরের) । উক্ত চিত্রটি দাত দ্বারা চর্বিত চুইংগামের মতােই দেখাচ্ছে। চিত্রে চুইংগাম ও ভ্রুনের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। আমরা উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে পাই। চিত্রটিতে আমরা মানব ভ্রুনের গায়ে দাঁতের মত চিহ্ন এবং চিত্রে চর্বিত চুইংগাম দেখতে পাচ্ছি।
হাম ও লিউয়েনহােক নামক দুই বিজ্ঞানী ১৬৭৭ সালে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে মানুষের বীর্যের মধ্যে জীবনের অস্তিত্ব (Spermatozoma) খুজে পান। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগের প্রায় এক সহস্রাধিক বছর পর। অথচ এই দুইজন বিজ্ঞানীই আগে ভুলক্রমে বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের বীর্যের মধ্যে উক্ত কোষের রয়েছে অতি সামান্য কিছু প্রক্রিয়া। নারীর ডিম্বানুতে আসার পর তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তবে প্রফেসর কেইথ এল, মুর বিশ্বের একজন সেরা প্রসিদ্ধ ভ্রুন বিজ্ঞানী এবং তিনি “মানবদেহের প্রবৃদ্ধি” গ্রন্থের লেখক; যা বিশ্বের আটটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এই বইটি বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স বই। বইটি আমেরিকার বিশিষ্ট একটি গবেষণা বাের্ড কর্তৃক কোনাে একক লেখকের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
একঃ কানাডার টরােন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরবিদ্যা ও কোষ বিভাগের একজন বিশিষ্ট প্রফেসর হচ্ছেন কেইথ এল, মুর । তিনি ওখানে মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অধীনে মৌলিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী ডীন হিসেবে এবং আট বছর শরীরবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৮৪ সালে তিনি কানাডায় মানব শরীরবিদ্যা বিভাগেরওপর কৃতিত্বপূর্ণ স্বাক্ষর রাখার জন্য কানাডার শীর্ষ শরীরবিদ্যা বাের্ডের পক্ষ থেকে J.C.B পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাছাড়াও তিনি “কানাডিয়ান এন্ড এমেরিকান এসােসিয়শন এবং দি কাউন্সিল অফ দি ইউনিয়ন অফ বাইয়ােলজিকাল সাইন্স”সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থায় গরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
দুইঃ ১৯৮১ সালে সউদীর দাম্মামে একটি মেডিক্যাল সেমিনারের আয়োজন করা হয়৷ উক্ত সেমিনারে কেইথ এল, মুরকে আমন্ত্রণ করা হয়৷ তিনি সেখানে বলেন, আমার জন্য এটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল যে, “আমি মানব শরীরের প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে ভালােভাবে জানতে কুরআন মাজীদের সহায়তা নিতাম। আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, এ বিষয়গুলাে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সাঃ এর ওপর নাজিল হয়েছে। কেননা, এ সকল বিষয়ের প্রায় সব কিছুই তাঁর মৃত্যুর কয়েকশত বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ব্যাপারটি প্রমাণ করে যে, মুহাম্মদ সাঃ আল্লাহর সত্য নবী।”
তিনঃ এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হল, তাহলে কি এর অর্থ দাঁড়ায় -কুরআন আল্লাহ তা’আলার বাণী? তিনি জবাব দিলেন, “আমি এ কথা মেনে নিতে কুণ্ঠাবােধ করি না।”
প্রফেসর মুর অন্য একটি কনফারেন্সে বলেছিলেন,
“কুরআন ও হাদীসে মানবের বৃদ্ধি প্রক্রিয়া সময় সম্পর্কে বিভিন্ন স্তরকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিভিন্ন নামে ভাগ করেছে। এর পদ্ধতিগুলাে অত্যন্ত চমৎকার ও বিস্তৃত অর্থ নির্দেশ করে থাকে। যা আধুনিক শরীর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের সাথে সংগতিপূর্ণ। বিগত চার বছরে সপ্তম শতাব্দীতে নাযিলকৃত কুরআন ও হাদীসের আলােকে মানব ভ্রুন নিয়ে গবেষণা করে বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া গেছে।”
এরিস্টটল ভ্রুন বিদ্যার জনক হওয়া সত্বেও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মুরগীর ডিমের ওপর তিনি গবেষণা চালিয়ে দেখেন যে, মুরগীর বাচ্চার সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় কয়েকটি স্তরে। তবে তিনি স্তরগুলাে সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছুই জানাতে সক্ষম হননি। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, কুরআন নাযিলের সময় মানুষের খুব কমই জানা ছিল ভ্রুনের স্তরগুলাে সম্বন্ধে। যা সপ্তম শতাব্দীতে বিজ্ঞানের কোনাে কিছুর ওপর নির্ভর করে জানার সুযােগ ছিল না।
অবশেষে আমরা মাত্র একটি চুড়ান্ত নির্ভরযােগ্য ফলাফলে আসতে পারি যে , এ সমস্ত জ্ঞান রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসেছে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে। কারণ আমরা জানি মোহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন উম্মি বা নিরক্ষর। মহান আল্লাহ তাকে অক্ষর জ্ঞান দান করেননি এজন্য যে, মানুষ যেন বলতে না পাড়ে, যে কোরআন মোহাম্মদ (সাঃ) লিখেছেন। এছাড়া অন্য কোথাও থেকে তাঁকে মানব ভ্রুন সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়াও ছিল অসম্ভব।
সুতরাং মহান আল্লাহর বানী সত্য এবং প্রমানিত। এ বিষয়ে সন্দেহের হাত যারাই বাড়িয়েছে। পবিত্র কোরআন নিয়ে গবেষণা করে তারাই বিস্মিত হয়েছেন। শুধু মানব ভ্রুন বা মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়, পবিত্র কোরআনে বিজ্ঞান সম্পর্কে সহস্রাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে। এখন শুধু আবিষ্কারের অপেক্ষা। একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ islamhouse.com
মন্তব্য লিখুন