এই বিশ্বজগতের যা কিছু দৃশ্য বা অদৃশ্যমান রয়েছে সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়া’লা। তাঁর সৃষ্টির বিশাল মহিমা দেখে আমরা আশ্চর্যান্বিত হই এবং তাঁর নিয়মাতের প্রশংসায় সিক্ত হই৷ তবে প্রত্যেকের একটি কমন প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক, যাঁর সৃষ্টি এতো সুন্দর সেই মহান অদ্বিতীয় স্রষ্টা আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? যদি এর উত্তর দেই, তবে এক কথায় উত্তর হবে তিনি তাঁর মত, অর্থাৎ যেমনটি আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় তিনি তেমন। সৃষ্টির কারো সাথে তাঁর তুলনা বা সাদৃশ্য করা ইমান বিধ্বংসী নাস্তিকতার ঝোঁক। বরং তিনি কারো সাদৃশ্য নন।
আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে মহান আল্লাহ তায়া’লার স্ব-সত্তার বেশ কিছু সিফাত সম্পর্কে জানতে পারি। তাই এসব বিষয়ে বিশুদ্ধ আকিদা জানা এবং পোষণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণও বটে। কেননা এসকল বিষয়ে সামান্য হোঁচট খেলেও ইমান ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ তাই এরকম কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সবচেয়ে বিশুদ্ধ আকিদা তুলে ধারার চেষ্টা করব, ইংশাআল্লাহ্।
(১) আল্লাহ তায়া’লার চেহারা রয়েছে!
মহান আল্লাহ তায়া’লার চেহারা রয়েছে, একথা পবিত্র কুরআনুল কারিমে তিনি আমাদের জানিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেছেন-
“ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র তোমার রবের চেহারা অবশিষ্ট থাকবে, যিনি মহিমাময় ও মহানুভব।” [সূরা আর-রহমান: ২৬-২৭]
অন্য সূরায় আল্লাহ আরও বলেছেন-
“তাঁর চেহারা ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংস হবে।” [সূরা কাসাস, আয়াত ৮৮]
আয়াতের ব্যাখ্যায় শাইখ সালিহ আল-ফাওযান (হাফি.) বলেনঃ
উপরোক্ত দুটি আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লার চেহারা থাকার কথা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো। আল্লাহর চেহারা আল্লাহর সত্তাগত সিফাত এবং প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে। যে রকম চেহারা আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়, তাঁর চেহারা ঠিক সে রকমই। অর্থাৎ তা কোন মাখলুকের চেহারার মত নয়।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তাঁর সদৃশ কোনো কিছু নেই।” [সূরা শুরা, আয়াত ১১]
আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? এ সম্পর্কিত উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় শাইখ আল-ফাওযান আরও বলেন-
“আমরা আল্লাহর সিফাতকে বাতিলকারী সম্প্রদায়ের লোকদের মত কথা বলি না। তারা বলে, আল্লাহর চেহারা দ্বারা আসল অর্থ উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সত্তা কিংবা সাওয়াব অথবা দিক অথবা অন্যান্য উদ্দেশ্য। আর এই ব্যাখ্যাগুলো একাধিক কারণে বাতিল।”
[বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন…]
(২) আল্লাহ তায়া’লার দুটি চোখ আছে!
মহান আল্লাহ তায়া’লার দুটি চোখ রয়েছে, তবে তা সৃষ্টিজীবের কারো সাদৃশ্য নয়। আল্লাহ তায়া’লা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেন-
“আর তোমার রবের সিদ্ধান্তের জন্য ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই তুমি আমার চোখের সামনেই রয়েছ। আর তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসা সহ তাসবীহ পাঠ করো।” [সূরা তুর, আয়াত ৪৮]
মহান আল্লাহ তায়া’লা আরও বলেন-
“আর আমি তাকে (নূহকে) কাষ্ঠফলক ও পেরেক সম্বলিত বাহনে আরোহন করিয়ে দিলাম, যা আমার চোখের সামনেই চলছিল৷ এ ছিল সেই ব্যক্তির জন্য প্রতিশোধ যাকে অস্বীকার করা হয়েছিল।” [সূরা কামার, আয়াত ১৩-১৪]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।” [সূরা ত্ব-হা, আয়াত ৩৯]
আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? এ সম্পর্কিত উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় শাইখ সালিহ আল-ফাওযান (হাফি.) বলেন-
“উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে জানা গেল যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লার মর্যাদা ও বড়ত্বের জন্য যেমন দুটি চোখ শোভনীয়, তাঁর জন্য ঠিক সেরকমই দুটি চোখ রয়েছে। কুরআনুল কারীমে العين (চোখ) শব্দটি আল্লাহর প্রতি একবচন ও বহুবচন এই উভয়ভাবেই مضاف (সম্বোধিত) হয়েছে। হাদিসেও এটিকে আল্লাহর প্রতি দ্বি-বচন হিসাবে সম্বোধিত হয়েছে।
যেমন দাজ্জালের এক হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
“সে সময় আল্লাহর পরিচয় তোমাদের নিকট অস্পষ্ট থাকবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কানা নন।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত তাওহীদ; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান]
এ কথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চোখের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এখানে সুস্পষ্ট যে, এই হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য এক চোখ সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। যার চোখ মাত্র একটি সে তো প্রকাশ্য কানা। আল্লাহ তায়া’লা এই দোষের অনেক উর্ধ্বে।
[বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন…]
(৩) আল্লাহ তায়া’লার পা রয়েছে!
মহান আল্লাহ তায়া’লার পা আছে, তবে তা কোন সৃষ্টিজীবের পায়ের মত নয়। পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেছেন-
“স্মরণ করুন, সে দিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত করা হবে,সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না।”[ সূরা ক্বলাম: ৬৮]
এ আয়াতের তাফসীরে সহীহ হাদিসে স্পষ্ট এসেছে যে, এখানে মহান আল্লাহর “পায়ের গোছা” বোঝানো হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন-
“আমাদের রব তাঁর পায়ের গোছা” অনাবৃত করবেন, ফলে প্রতিটি মুমিন নর ও নারী তাঁর জন্য সিজদাহ করবেন। পক্ষান্তরে যারা দুনিয়াতে প্রদর্শনেচ্ছা কিংবা শুনানোর উদ্দেশ্যে সিজদাহ করেছিল, তারা সিজদাহ করতে সক্ষম হবে না। তারা সিজদাহ করতে যাবে কিন্তু তাদের পিঠ বাঁকা হবে না।” [ সহিহ বুখারী: ৪৯১৯]
আরও পড়ুনঃ
মুমিনের অনুপম বৈশিষ্ট্য ইসলামের অমূল্য সম্পদ
মহান আল্লাহ কোথায় আছেন, আরশের উপর নাকি সর্বত্র বিরাজমান?
ইলুমিনাতি কী? ইলুমিনাতি সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি!
অন্য বর্ণনায় নবী কারীম (সা.) বলেন-
“জাহান্নামে অপরাধীদেরকে নিক্ষেপ করা হতেই থাকবে। জাহান্নাম বলবে, আরো আছে কি? তখন মহান রব্বুল আলামিন জাহান্নামে নিজের পা রাখবেন। (অন্য বর্ণনায় رجله এর স্থলে قدمه এসেছে) এতে জাহান্নাম সঙ্কুচিত হয়ে যাবে এবং বলবে, যথেষ্ট হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ আইমান ওয়ান নুযুর]
আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? এ সম্পর্কিত উক্ত হাদিসের মন্তব্যে শাইখ সালিহ আল ফাওযান (হাফি.) বলেন-
অত্র হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহর পা সাব্যস্ত হলো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লার বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য যেমন পা শোভনীয়, তাঁর পা ঠিক সে রকমই। আল্লাহ তায়া’লার হাত এবং চেহারার মতই পা তাঁর সিফাতে যাতিয়া তথা সত্তাগত বিশেষণ।
[বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন…]
(৪) আল্লাহ তায়া’লার দুটি হাত আছে!
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দুটি হাত রয়েছে, তবে তা কোন সৃষ্টিজীবের হাতের মত নয়। এটিই বিশুদ্ধ আকিদা।
যেমন মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“হে ইবলিস, যাকে আমি নিজের দুই হাতে সৃষ্টি করেছি তাঁর সম্মুখে সেজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে? নাকি তুমি তাঁর চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?” [সূরা সোয়াদ: ৭৫]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“আর ইহুদিরা বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা হয়ে গেছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের উপর অভিসম্পাত করা হয়েছে। বরং তাঁর উভয় হাত সদা উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন।” [সূরা মায়িদা: ৬৪]
আয়াতের ব্যাখ্যায় শাইখ সালিহ আল-ফাওযান হাফিজাহুল্লাহ বলেন-
উপরোক্ত দুটি আয়াতে কারীমা হতে মহান আল্লাহর দুটি হাত থাকার কথা প্রমাণিত হলো। প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মানের জন্য শোভনীয় তাঁর দুটি হাত রয়েছে। এই হাত দুটি কোন মাখলুকের দুই হাতের মত নয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ“তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই।”
যারা আল্লাহর প্রকৃত দুই হাতকে অস্বীকার করে, এখানে তাদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। সেই সাথে যারা ধারণা করে, হাত দ্বারা আল্লাহ তায়া’লার কুদরত অথবা নেয়ামত উদ্দেশ্য তাদেরও প্রতিবাদ রয়েছে।
আরো বলা যেতে পারে যে, হাত দ্বারা যদি কুদরত উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আল্লাহ তায়া’লার কুদরত মাত্র দুটি হওয়া আবশ্যক হয়। অথচ মুসলিমদের ঐক্যমতে এই কথা বাতিল বলে প্রমাণিত। কেননা আয়াতের মধ্যে আল্লাহর দুই হাত সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে আরো বলা যেতে পারে যে, হাত দ্বারা যদি নেয়ামত উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তায়া’লা আদমকে মাত্র দুটি নেয়ামত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এটি সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা আল্লাহর নেয়ামত অসংখ্য, মাত্র দুটি নয়।”
[বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন…]
সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যঃ
মহান আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? এ সম্পর্কিত পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের সকল বাণীর উপর আমরা সেভাবেই বিশ্বাস স্থাপন করছি, যেভাবে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) বলেছেন। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে মহান আল্লাহর এই সত্তাগত সিফাতগুলো নিয়েও বেশ বিতর্ক ও মতানৈক্য দেখা যায়। আফসোস, যা খুবই নিন্দিত ও ঘৃণিত কাজ৷ তাই অন্তত আল্লাহ সম্পর্কিত আকিদা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা একদম-ই উচিত নয়।
মহান আল্লাহ তায়া’লা দেখতে কেমন? এ সম্পর্কিত সকল আকিদার বিষয়ে আমাদের নিজেদের চিন্তাগত সকল ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কেননা আকিদার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিস যা বলেছে, অকাট্যচিত্তে সেসবের উপর হুবহু সেভাবে বিশ্বাস স্থাপন করাই ইমানের দাবি। তাই আমাদের জন্য এক্ষেত্রে সালফে সালেহীনদের আকিদা পোষণ করাই সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। তাই বিশুদ্ধ আকিদা পোষণের জন্য পড়ুন, প্রসিদ্ধ আকিদার গ্রন্থ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (রহ.)-এর লেখা শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া গ্রন্থটি।
মহান আল্লাহ তায়া’লা তাঁর সম্পর্কে আমাদের বিশুদ্ধ আকিদা পোষণের তৌফিক দান করুক, আমিন।
তথ্য সহায়তাঃ
- hadithbd.com