মহান আল্লাহ কোথায় আছেন? তিনি কি সর্বত্র বিরাজমান নাকি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আছেন? মহান আল্লাহ তায়া’লার অবস্থান সম্পর্কিত এই আকিদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকিদা। কেননা এক হাদিস থেকে জানা যায় সম্পর্কে সঠিক আকিদা জানা না থাকলে সে কখনোই প্রকৃত মুমিন হতে পারে না৷ আমাদের উপমহাদেশে আল্লাহ তায়া’লার অবস্থান নিয়ে ভিন্ন আকিদা লক্ষ্য করা যায় যা খুবই দুঃখজনক একটি ব্যাপার৷ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার সাথে যা সরাসরি বৈসাদৃশ্য।
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এই ইমান যেমন জরুরি, ঠিক তাঁর অস্তিত্ব ব্যাপরেও সঠিক আকিদা রাখা জরুরি। কেননা মহান আল্লাহ তায়া’লা এ সম্পর্কিত প্রায় ৭টি স্পষ্ট আয়াত পবিত্র কোরআনে নাজিল করেছেন। তারপরও অনেকই আমরা বিশুদ্ধ আকিদা গ্রহন করছি না!! কিন্তু কেন? তাই আসুন আলোচ্য প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে সবচেয়ে বিশুদ্ধ আকিদা কি? তা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।
মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন-
১. “রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) “আরশের উপর উঠেছেন।” [সূরা ত্বা-হা : ৫]
২.“নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ্ যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন। তিনিই দিনকে রাত দিয়ে ঢেকে দেন, তাদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে।” [সূরা আরাফ: ৫৪]
৩.“তোমাদের রব তো আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি ‘আরশের উপর সমাসীন হলেন, তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন।” [ সূরা ইউনুস: ৩]
৪.“আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া, তোমরা তা দেখছ। তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়মাধীন করেছেন; প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে।” [ সূরা রাদ: ০২]
৫.“আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠলেন। তিনিই ‘রাহমান’, সুতরাং তাঁর সম্বন্ধে যে অবহিত তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।” [সূরা ফুরকান: ৫৯]
৬.“আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই ও সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূরা সাজদাহ্: ৪]
৭.“তিনি ছয় দিনে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি ‘আরশের উপর সমাসীন হলেন, তিনি জানেন যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা থেকে বের হয়, আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উখিত হয়।” [সূরা হাদীদ: ৪]
পবিত্র কুরআনের আলোকে আমারা জেনেছি মহান আল্লাহ্ স্ব-সত্তায় সপ্ত আসমানের উপর অবস্থিত মহান আরশের উপরে আছেন। এখন দেখুন সম্পর্কিত একটি বিশুদ্ধ হাদীস-
এক ব্যক্তি একটি কালো দাসীকে সাথে করে রসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললো- একজন ঈমানদার দাসীকে মুক্ত করা আমার ওয়াজিব হয়ে গিয়েছে৷ আমি কি এই দাসীটিকে মুক্ত করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাসীটিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
“আল্লাহ কোথায়? সে আঙ্গুল দিয়ে আসমানের দিকে ইশারা করে দেখালো৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে ? সে প্রথমে নবী (সা.) দিকে এবং আসমানের দিকে ইশারা করলো৷ এভাবে তার উদ্দেশ্য বুঝা যাচ্ছিল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ একে মুক্ত করে দাও, এ ঈমানদার৷” [মুয়াত্তা, মুসলিম, ও নাসায়ী হাদীসগ্রন্থেও অনুরূপ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে]
অন্য এক বর্ণনায়- রাসূল (সা.) প্রশ্ন করলেনঃ
“মহান আল্লাহ কোথায়? দাসী বলল: আসমানের উপরে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি কে? দাসী বলল: আপনি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন: একে আজাদ (মুক্ত) করে দাও, কেননা সে একজন মুমিনা নারী।” [সহীহ মুসলিম: ১২২৭]
ইমাম আবু হানীফাহ (রহ.) বলেন-
“যে ব্যক্তি বলবে, আমি জানি না, আমার রব আসমানে না জমিনে, সে কাফির। অনুরূপ (সেও কাফির) যে বলবে, তিনি আরশে আছেন, তবে আমি জানি না, ‘আরশ আসমানে না জমিনে। [আল ফিকহুল আকবার: ১/১৩৫]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর উক্তি:
তাঁর ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া বলেন, একদা আমরা ইমাম মালিক ইবন আনাস (রহ.) এর কাছে বসা ছিলাম, এমন সময় তার কাছে এক লােক এসে
বলল-
“হে আবু আব্দুল্লাহ! মহান আল্লাহ বলেন, “রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন।” এই উপরে উঠা কীভাবে? এর রূপ ও ধরণ কেমন?
প্রশ্নটি শােনামাত্র ইমাম মালিক (রহ.) মাথা নীচু করলেন, এমনকি তিনি ঘর্মাক্ত হলেন: অতঃপর তিনি বললেন: ইসতিওয়া শব্দটির অর্থ (উপরে উঠা) সকলের জানা, কিন্তু এর ধরণ বা রূপ অজানা, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বিদ’আত। আর আমি তােমাকে বিদ’আতী ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। অতঃপর তিনি (রহ.) তাকে মজলিস থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।”
[ইতিকাদ লিল বাইহাকী ১/৬৭, হাশিয়াতুস সিন্ধী ‘আলা ইবনি মাজাহ ১/১৬৭, মিরকাতুল মাফাতীহ ২/১৭, ১৩/৮৯]
ইমাম শাফিঈ (রহ.)-এর উক্তি:
মহান আল্লাহ কোথায় আছেন? এ সম্পর্কে ইমাম শাফিঈ (রহ.)-এর স্পষ্ট বক্তব্য হল-
“আর নিশ্চয় আল্লাহ আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপর উঠেছেন।” [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.)-এর উক্তি:
মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-কাইসী বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করলামঃ
“এ মর্মে ইবনুল মুবারাক (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হল, “আমাদের রবের পরিচয় কীভাবে জানবাে? উত্তরে তিনি বললেন, “সাত আসমানের উপর ‘আরশে। (এ
ব্যাপারে আপনার মতামত কী?) ইমাম আহমাদ (রহ.) বললেন, “বিষয়টি আমাদের নিকট এ রকমই।” [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
মূলত এ কথাটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, কেননা যদি এর দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয় যে, “স্বয়ং আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” তাহলে সঠিক আকিদা নয়। আর যদি এর দ্বারা বুঝানাে হয় যে, “মহান আল্লাহর ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান” তাহলে এ আকিদা সঠিক।
কেননা আমরা জানি আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মাদ
(সা.)-এর নিকট ওহী প্রেরণ করতে মাধ্যম হিসেবে জিবরাইল (আ.) ব্যবহার করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
“এটাকে (কুরআনকে) রুহুল আমীন (জিবরাইল আ.) আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণ করেছেন।” [সূরা আশ-শুআরা: ১৯৩-১৯৪]
আল্লাহ নিজেই সর্বত্র বিরাজ করলে মাধ্যমের দরকার ছিল না। আবার আমরা আরও জানি যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে অত্যন্ত নিকট থেকে কথােপকথন করার জন্য মি’রাজ রজনীতে সাত আসমানের উপর আরােহণ করেছিলেন। [দেখুন, সূরা আন-নাজম:০১-১৮]
এক কথায়, মহান আল্লাহ যদি সর্বত্রই থাকবেন, তাহলে মি’রাজে রাসূল (সা.) যাওয়ার প্রয়ােজন ছিল না। আর তখন রাসূলের সঙ্গ দিয়েছিলেন জিবরাইল (আ.), নতুবা আল্লাহ নিজেই তাঁর রাসূলকে মি’রাজ যাত্রায় সঙ্গ দিতেন, জিবরাইলের প্রয়োজন ছিল না।
আরও পড়ুনঃ মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি নুরের নাকি মাটির? জেনে নিন বিস্তারিত
অতএব, মহান আল্লাহ কোথায় আছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে “মহান আল্লাহ স্ব-সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান” এ কথাটি বাতিল। স্পষ্ট কুরআন-হাদীস পরিপন্থী ও আল্লাহর জন্য মানহানীকর। বরং একথা বিশুদ্ধ যে, আল্লাহ তায়া’লার জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর স্ব-সত্তা অর্থাৎ স্বয়ং তিনি সর্বত্র বিরাজমান নয়।
উল্লিখিত সকল দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা মহান আল্লাহ তা’আলার পরিচয় বা অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তবে তিনি কোন অবস্থায় আছে? কিভাবে আছেন? কিভাবে আসমানে উঠেছেন? সম্পর্কিত কোনো বর্ণনা পবিত্র কুরআনে ও সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না৷ তাই মহান আল্লাহ তায়া’লা আমাদের যতটুকু বলেছেন ততটুকুর উপর ইমানআনা ফরজ বা ওয়াজিব। এর বেশি চিন্তা বা প্রশ্ন করা সুস্পষ্ট বিদ’আত এবং ভ্রষ্টতার কারণ।
আবার আল্লাহ পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.) হাদীসের মাধ্যমে যেখানে যেভাবে বলেছেন যে, তিনি আমাদের অতি নিকটবর্তী, শেষ রাতে প্রথম আসমানে আসেন। এ সকল আয়াত ও হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করাও জায়েজ নেই৷ বরং এর উত্তর স্বয়ং আল্লাহ ভালো জানেন। কিভাবে কি? তা তিনি আমাদের জাননি। তাই মহান আল্লাহ্ এসব বিষয়ে যেখানে যেভাবে বলেছেন, সেভাবে বিশ্বাস করাই ইমানের দাবি।
সুতরাং মহান আল্লাহ কোথায় আছেন? পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী এর বিশুদ্ধ আকিদা হলো তিনি আসমানের উপরে (আরশে) আছেন। স্বয়ং সর্বত্র বিরাজমান নন। বরং সর্বত্র বিরাজমান তাঁর ক্ষমতা, স্ব-সত্তা নয়।
মহান আল্লাহ তায়া’লা তাঁর সম্পর্কে যেখানে বর্ণনা যেভাবে বলেছেন, আমরা হুবহু সেখানে সেভাবেই ইমান আনছি।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন