আমাদের উপমহাদেশে বিদআত শব্দটি বর্তমানে সময়ে খুবই পরিচিত ও আলোচিত। কিন্তু বিদআতের অর্থ ও প্রকারভেদ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি বিদআতি বলে অন্যকে হেয় করার চেষ্টা মারাত্মক রূপধারন করেছে। তাই আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ও সচেতন ধারনা থাকা খুবই জরুরি মনে করছি। আজ আমরা বিদআতের অর্থ ও প্রকারভেদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি পরিস্কার ও স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায ( রহ.) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল- শরীয়তে কোন আমল কখন বিদআত বলে গণ্য হবে? বিদআত প্রয়ােগ কি শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে? নাকি ইবাদত এবং আদান-প্রদান তথা লেনদেনের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য?
উত্তরে তিনি অতন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন- শরীয়তে বিদআত হলাে: প্রতিটি সেই ইবাদত, যা মানুষ নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। অথচ কুরআন ও হাদীসে এর কোনাে অস্তিত্ব নেই এবং সুপথপ্রাপ্ত চার খলিফার আমলেও নেই।
বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনাে জিনিস সৃষ্টি করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত। ( সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
রাসূল (সা.) আরও বলেছেন,
“যে ব্যক্তি এমন কোনাে আমল করবে যা আমার শরিয়ত সমর্থন করে না তা প্রত্যাখ্যাত।” (সহিহ মুসলিম )
তিনি ইরবাদ ইবন সারিয়া (রা.) এর হাদীসে আরাে বলেন-
“তােমাদের উপর ওয়াজিব হলাে: আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং আমার পর সুপথপ্রাপ্ত চার খলীফাদের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং তা দন্ত দ্বারা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করা। আর তােমরা দ্বীনে নব রচিত কর্মসমূহ হতে সাবধান থাক!কেননা প্রতিটি নব রচিত কর্ম হচ্ছে বিদআত এবং সকল বিদআত হচ্ছে ভ্রষ্টতা।”(আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ)
বিদআত সম্পর্কে এ অর্থে আরও বহু হাদীস রয়েছে। শায়েখ বিন বায (রা.) এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে উপস্থাপন করায় সেগুলো উল্লেখ করছি না। তবে সবগুলো হাদিসে এ মর্মে রাসূল (সা.) বানী উদধৃত করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আরবী ভাষায় বিদআত প্রযােজ্য হয় প্রতিটি সেই নব আবিস্কৃত জিনিসের উপর যার কোনাে পূর্ব নমুনা নেই। কিন্তু তা অর্থাৎ নব আবিষ্কৃত জিনিস দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত না হলে এর সাথে নিষেধের কোনাে সম্পৃক্ততা নেই। পক্ষান্তরে লেনদেনের ক্ষেত্রে যা শরীয়ত সমর্থিত তা শর’ঈ বন্ধন এবং যা এর পরিপন্থী তা বাতিল বন্ধন হিসাবে প্রযােজ্য। একে শরীয়তে বিদআত বলা যাবে না, কেননা তা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে বিদআত হলো ইবাদত ও সওয়াবের উদ্দেশ্য নব্য কর্মপন্থা, যা রাসূল (সা.) ও ইসলামি শরিয়তের পরিপন্থী। অর্থাৎ ইসলামি শরীয়তে যা কুরআন ও হাদিসের মানদন্ডে প্রমাণিত নয়। কেননা বিদআতের কোনো সহিহ দলিল হয় না।
ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ:) তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বিদআতকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে করেছেন। যেমন-
বিদআতের অর্থ ও প্রকারভেদ সম্পর্কে সঠিক উত্তর জানতে ইমাম নববীর উক্ত প্রকারভেদের কথা উল্লেখ করে জনৈক এক ব্যক্তি শায়েখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) কে বলেন –
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন: প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা। তাহলে এই প্রকারভেদ দ্বারা ইমাম নাওয়াওয়ীর উদ্দেশ্য কি? তা বর্ণনাসহ বিস্তারিত বলার জন্য আপনাকে অনুরােধ করছি, আল্লাহ আপনাকে বরকতময় করুন।
আপনি ইমাম নাওয়াওয়ী থেকে যে পাঁচ প্রকার বিদআত তুলে ধরেছেন, তা আলেমগণের একটি জামায়াত উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন: বিদআত পাঁচ প্রকার: ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ (অনুমােদিত), হারাম ও মাকরুহ।
তবে প্রসিদ্ধ অন্য আলেমগণ বলেছেন: সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা। এর মধ্যে কোনাে প্রকারভেদ নেই বরং সবগুলােই ভ্রষ্টতা যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,“সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা।”
এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে আরো বহু সহীহ হাদীস এসেছে। তন্মধ্যে সহীহ মুসলিমে জাবের ইবন আব্দুল্লাহ আল আনসারী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
রাসূলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন খুৎবায় বলেন-
“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলাে: আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলাে: মুহাম্মদ (সা.) এর হেদায়েত। আর নিকৃষ্টতর কাজ হলাে: দ্বীনে নব আবিষ্কৃত কাজ এবং প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (সহিহ মুসলিম)
এ অর্থে আরও কয়েকটি হাদীস এসেছে, আয়েশা ও ইরবাদ ইবন সারিয়ার হাদীসসহ বহু হাদীসে।
এটাই সত্য যে, ইমাম নওয়াওয়ী ও অন্যান্যরা বিদআতের যে প্রকার উল্লেখ করেছেন এ ধরনের কোনাে প্রকার বাস্তবে নেই বরং সব বিদআতই ভ্রষ্টতা। কারণ, বিদআত হয় কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রে, মুবাহ বা অনুমােদিত কোনাে জিনিসের ক্ষেত্রে নয়।
যেমন: নতুন কোনাে খাবার তৈরী করা, যা এর আগে কেউ তৈরী করেনি। শরীয়তের পরিভাষায় একে বিদআত বলা হয় না। যদিও শাব্দিক অর্থে তা বিদআত। কেননা শাব্দিক অর্থে বিদআত বলা হয়, পূর্ব নমুনা ব্যতীত নতুনভাবে কোনাে জিনিস আবিষ্কার করাকে।
যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
“আল্লাহ ভূমন্ডল ও নভােমন্ডলের নবউদ্ভাবক। (সূরা বাকারা: ১১৭) অর্থাৎ পূর্ব কোন নমুনা ব্যতীত তিনি এর আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক।
কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় কোনাে ব্যাপারটি তখনই বিদআত বলা যাবে, যখন কেউ এমন কোনাে জিনিস তৈরী করল যার প্রমাণ কুরআন ও হাদীসে নেই। আর এটিই সত্য যা আলেমগণের একটি দল মেনে নিয়ে এর স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং যারা এর বিরােধিতা করছেন তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইসলামের শত্রু এবং নাস্তিকদের প্রতিউত্তর দেওয়ার ব্যাপারে দলীল প্রস্তুত করা এবং বই লেখাকে বিদআত বলা যাবে না। কারণ, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত বিধায় তা বিদআত নয়। কেননা, কুরআনুল কারীম স্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ শত্রুদের প্রতিউত্তর দিয়েছে এবং তাদের সন্দেহের মুখােশ উৎঘাটন করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অনেক আয়াতের মাধ্যমে রাসূলের সুন্নাত ও ইসলামের শত্রুদের প্রতিউত্তর দিয়েছে।
এমনিভাবে সাহাবাদের যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মুসলিমগণ তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিচ্ছে। এর কোনটিই বিদআত নয় বরং ওয়াজিব পালিত হচ্ছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ হচ্ছে, তাই এগুলাে কোনােভাবেই বিদআত নয়।
তদ্রুপ মাদরাসা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করা, যাতে মুসলিমদের উপকার হয়, তাকে শরীয়তে বিদআত বলা হবে না। কেননা শরীয়তই শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে, আর মাদরাসা তৈরী শিক্ষা গ্রহণ করতে সাহায্য করছে।
এমনিভাবে আল্লাহ্ গরীব ও অসহায়দের প্রতি অনুগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ যদি তাদের জন্য কোনাে ঘর তৈরী করে, তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তবে এটিই আল্লাহর নির্দেশ। তদ্রুপ নদীর উপর কোনাে সেতু তৈরী করা, এসব কিছুই মানুষের উপকার বিদআত নয় বরং তা ইসলামেরই নির্দেশ। তা কেবল শাব্দিক অর্থেই বিদআত হবে।
যেমন, উমর (রা.) তারাবীহ এর সালাতের জন্য যখন লােকদেরকে এক ইমামের পিছনে জমা করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন- “এটি কতইনা ভালাে বিদআত”!
অথচ তারাবীর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়েছেন এবং সাহাবাদেরকে তা পড়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন, কাজেই তা বিদ’আত নয় বরং তা সুন্নাত। কিন্তু উমর (রা.) একে শাব্দিক অর্থে বিদআত বলেছেন। কারণ পূর্বে এভাবে এক ইমামের পেছনে সালাত পড়া হতো না। বরং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সময় এবং তাঁর পরে দুইজন বা তিনজন করে ছােট ছােট জামাতে পড়া হতো।
বিতর সালাত রাসূলুল্লাহ (সা.) তিন দিন জামাতে পড়েছেন, তারপর ছেড়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন-
“রাত্রির সালাত তােমাদের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার ভয় করছি।”
অতঃপর তিনি তাঁর উম্মতের উপর এ সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে জামাতে পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন এ ভয় দূর হয়ে গেল, অতঃপর উমর (রা.) তা জামাতে পড়ার নির্দেশ দেন।
মােটকথা রমাদানে রাত্রির তারাবীর সালাত পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বিদ’আত নয়। এর দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহর বিধানের বাইরে দ্বীনের মধ্যে মানুষ নতুন যা সৃষ্টি করবে তাই বিদআত। যা ভ্রষ্টতা হিসেবে স্বীকৃত, আর তাই তা করা জায়েয নেই এবং একে ওয়াজিব, সুন্নাত , মুবাহ .. ইত্যাদি হিসাবে ভাগ করাও জায়েয নেই। কারণ তা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সাব্যস্ত শারঈ দলীলের পরিপন্থী, যেমনটি পূর্বে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) এর ফতোয়া আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম৷ ঠিক এমনি ফতোয়া আপনি ইবনে তাইমিয়ার (রহ.) সহ প্রসিদ্ধ ফকিহগনের বক্তব্যে লক্ষ্য করবেন।
আগ্রহী পাঠকদের শায়েখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) এর লেখা ‘বিদআত ও এর মন্দ প্রভাব’ বইটি ভালো করে পাঠ করার পরামর্শ দিচ্ছি।
সুতরাং ওয়াজিব, সুন্নাত, মুবাহ হিসেবে বিদআতের অর্থ ও প্রকারভেদ করার কোনো দলিল নেই। বরং তা শরঈ দলিলের পরিপন্থী। তবে একটি কথা আবার স্পষ্ট করে দেই- শাব্দিক অর্থে বিদআত এবং শারঈ অর্থে বিদআতের অর্থ পৃথক। শাব্দিক অর্থে বিদআত শরিয়তের নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু শারঈ অর্থে শরিয়তে নতুন কিছু আবির্ভাব হলে তা নিষিদ্ধ অর্থাৎ হারাম, হারাম এবং হারাম।
আমরা মহান আল্লাহর কাছে ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার বিদআত থেকে পানাহ চাই। আমিন।
মন্তব্য লিখুন