সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি. এর ভেরিফাইড টুইট একাউন্ট থেকে একটি স্টাটাস ভাইরাল হয়। যেখানে শাইখ ড. মিজানুর রহমান আজহারি‘র পোস্ট ফিলিস্তিন স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামী যুদ্ধ নিয়ে একটি সমালোচনা ফুটে ওঠে। যদিও এরপরই শাইখ আজহারি তার ফেসবুক পেইজে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন টুইটার ব্যক্তিগত ভাবে তিনি চালান না। কিন্তু অনেক অসাধু লোক তার নামে টুইটার খুঁজে চালাচ্ছে।
তাই তিনি একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন টুইটার ভেরিফাই করে দু একটি পোস্ট শেয়ার করতে। সেখানে ওই এডমিন বিতর্কিত ঐ স্টাটাসটি দিয়ে ফেলেছিল। শাইখ আজহারি দেখা মাত্র সেটি ডিলিট করতে বলেছেন। কিন্তু ফেসবুকে সমালোচকেরা এই পোস্টের জন্য শাইখ মিজানুর রহমান আজহারিকেই দায়ী করছেন। আজ আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ ড. মিজানুর রহমান আজহারি অবস্থান কি তা তুলে ধরার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।
ফিলিস্তিন ও আল-আকসা নিয়ে সাধারণত আমাদের আবেগ, বিবেক ও ভালোবাসা অনেকটা একই স্থানে অবস্থান করে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে আবেগের অবস্থানটা এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে কারো চুল পরিমান ভুল হলেও তার সমালোচনা করে আমরা তুলোধুনো করে ছাড়ি।
অথচ এই সামান্য ভুলটিও তার সত্যিই হয়েছিল কিনা তা আর খুঁজে দেখায় সময় আমাদের হাতে একেবারেই থাকে না।
ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গিতে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কাউকে সমালোচিত করা বা তাকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করা একটি অপবাদের সামিল যা মারাত্মক গুনাহের কাজ। পবিত্র কুরআনে এর বিধিনিষেধ স্পষ্ট করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে দূরে থাক। কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ। আর তোমরা একজন অন্য জনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। আর একজন অন্যজনের গিবত করো না।’ (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১২)
আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদের আল্লাহ তায়া’লা নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন অধিক ধারনা থেকে বেঁচে থাকে, অন্যের গোপনীয় দোষ অনুসন্ধান না করেন এবং গিবত না করেন।
বুখারীর এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কারো প্রতি কুধারণা পোষণ করতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ধারণাভিত্তিক কথা সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। তোমরা-
> একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না;
> পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করো না;
> পরস্পর শত্রুতা ও দুশমনি পোষণ করো না।
বরং হে আল্লাহর বান্দারা! ভাই ভাই হয়ে থাক। যেভাবে তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
অথচ আমাদের অতি আবেগী মুসলিম ভাইয়েরা শাইখ আজহারী’র টুইটার হতে মিস্টেক হওয়া পোস্টটি নিয়ে তারা কতটা বাড়াবাড়ি করল তা আমারা দেখেছি। এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, তারা অধিক ধারনা পোষণ করেছিল। কিন্তু তাদের উচিত ছিল মুমিন ভাই হিসেবে শাইখের কথায় বা স্টাটাসে বিশ্বাস রাখা। কিন্তু তারা তা করেনি। এটাই কি একজন নম্র ও আদর্শ বৈশিষ্ট্যের আলিমের প্রতি আমাদের ভালোবাসার নমুনা?
ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি. সেই টুইট দেখা মাত্র ডিলিট করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার ফেসবুক পেইজে নিজে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। এরপরও অনেকে বলছেন শাইখের মনের ভিতরে আসলে কি আছে? তিনি কি দালালি করছেন? তিনি কি তবে গোপনে গোপনে ফিলিস্তিনের সংগ্রামী ভাইদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ লালল করেন? তিনি আসলে অতি মডারিস্ট! ইত্যাদি সব অভিযোগ।
এমন সব ধারনা ও দোষত্রুটি খোঁজায় এভাবেই আমাদের ভাইয়েরা কি অহেতুক সময় নষ্ট করছেন না? এখানে তারা কি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেননি? আমাদের সম্মানিত বহু মাওলানা সাহেবের পোস্টেও এমন অধিক ধারণা লক্ষ্যণীয় দেখলম। অথচ এগুলো সুস্পষ্ট অপবাদ। বরং মুমিন ভাই হিসেবে তার কথায় বিশ্বাস রাখা উচিত ছিল।
“অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বুঝাবুঝির জন্য আমি দু:খ প্রকাশ করছি। ফিলি/স্তিন ইস্যু নিয়ে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে বলে মনে করি না। বিগত দিনগুলোতে ফিলি/স্তিনের পক্ষে দখ/লদারদের বিরুদ্ধে পোস্ট করায়, একাধিকবার ফেইসবুক আমাকে রেস্ট্রিকশন দিয়েছিল। পেইজ ডাউন করে রেখেছিল। প্রশ্নাতীতভাবে ফিলি/স্তিন ইস্যু আমাদের হৃদয়ের ইস্যু, ইমানের ইস্যু। আমরণ আমরা হৃদয়ে আক্ব/সাকে ধারণ করে যাব ইনশাআল্লাহ।”
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি একথাই বলে যে, একজন ব্যক্তি যদি ভুল করে এবং ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়, তাহলে তাকে ক্ষমা করাই শ্রেয়। যদি না ভুলটি বড় কোনো শাস্তিযোগ্য ভুল হয়ে থাকে। কিন্তু শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি. নিজে ভুল না করেও তার এডমিন ও নিজের পক্ষ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এরপরও তার সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে অতি আবেগী ভাইয়েরা কঠোর সমালোচনা করেছেন। আচ্ছা আমরা আজ কেমন মুসলিম হলাম যে, এতো সহজেই একজন সম্মানিত আলিমের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টি করি? আর তা প্রচারও করি? অথচ বিষয়টি স্পষ্ট একটি মিস্টেক ছিল মাত্র।
একটি মিস্টেক নিয়ে যদি এতো কিছু হয়, তাহলে একটি ভুল প্রকাশ পেলে আমরা কতটা বাড়াবাড়ি করতে পারি, একবার ভেবে দেখেছেন কি? অথচ ভুল হওয়া মনুষ্য বৈশিষ্ট্য। পার্থক্য হলো আমাদের থেকে ভুল হতে পারে, কিন্তু কোনো আলিমের তা হতে পারে না! যদি তাদের কোনো ভুল প্রকাশ পায় তাহলে….। যদি সে ক্ষমা চায়ও আমরা বলি তিনি আলিম হয়ে কেমনে করলেন এটা?
আমরা দেখেছি শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি’র ফিলিস্তিন নিয়ে তার অবস্থান অতীতের বহু পোস্টে স্পষ্ট । তাই আজকের সমালোচকদের উচিত সেগুলো আবারও স্বরণ করা। আর নিজেদের অধিক ধারণার জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার পাঠ করা।
এবার তবে আসুন একনজরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি.এর অতীতে করা সেই পোস্টগুলোর কয়েকটি একবার দেখে নেই। আশা করি এরপর যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের ফিলিস্তিন নিয়ে শাইখের অবস্থান পরিস্কার করতে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি তার ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন-
একঃ “হামাগুড়ি দিয়ে হলেও আমরা পৌঁছুব (মসজিদুল আকসায়) ইনশাআল্লাহ।” বিস্তারিত পড়ুন এখানে…।
দুইঃ “ইসরায়েল বলতে কোন রাষ্ট্র নেই। ওরা শরণার্থী, আশ্রিত এবং শেকড়হীন। ওদের কল্পিত রাষ্ট্রের পুরোটাই অধিকৃত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড। কূটকৌশল আর জবরদখল করেই ওরা টিকে আছে।”
তিনঃ “আপনার হৃদয় ভারাক্রান্ত? ভাবছেন কিছুই করার নেই? ভুলে যাবেন না, কাছে সব থেকে শক্তিশালী অস্ত্র ‘দু’আ’ আছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহকে ডাকুন। আমাদের হৃদয় কাননে গজিয়ে উঠা ‘আগা*ছা’ একদিন নির্মূল হবেই.. ইন শা আল্লাহ।”
চারঃ ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখের আরও অনেক দুআ ও প্রার্থনা করার পোস্ট আছে। যেগুলোর কয়েকটি তার প্রোফাইলের গ্যালারির ছবিতে রয়েছে।
যদিও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি. এর লেখা আরও কিছু পোস্ট ছিল। কিন্তু ফেসবুক অনেক পোস্ট রেস্ট্রিকটেড করে দেওয়ায় সেগুলোর বেশিরভাগ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
মূলত ফিলিস্তিন ও আল আকসা মুসলিমদের জন্য এমন একটি ইস্যু যা দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলিমদের আবেগ, বিবেগ ও ভালােবাসায় জায়গা। এই ইস্যুতে সকল মুসলিমরা একই মেরুতে অবস্থান করে এবং করবেও। ফিলিস্তিন ও আল-আকসা স্বাধীন করায় এর কোনো বিকল্পও নেই। আর সেখানে কোনো আলিম এর বিরোধিতা করবে এটা অকল্পনীয় বিষয়।
আমরা এটা মনে করি যে, যারা আজ শাইখের একটা মিসটিক হওয়া টুইট নিয়ে এতো সমালোচনায় লিপ্ত তারাও শাইখের অতীতের এই পোস্টগুলো পড়েছিলেন। হয়ত আজ তারা অনেকেই তা ভুলেও গিয়েছেন।
তবে এটাই এখনকার মানুষের বৈশিষ্ট্য যে, আমরা যখন কারো ভালোকিছু দেখি বাহবাহ দেই, লাভ ও লাইক রিয়েক্ট দেই। এরপর তার ছোট্ট কোনো মিস্টেক হলে তাকেই তুলোধুনো করা শুরু করি। অতীতে তার ত্যাগ ও ভালোটা ভুলে যাই।
সর্বশেষে বলব শয়তানের উদ্দেশ্য হলো আমাদের মধ্যমপন্থী আলিমদের সমালোচিত করা। যেন সাধারণ মানুষ মধ্যমপন্থী আলিমগণ হতে বিমুখ হয়। আর শয়তান এক্ষেত্রে অনেকটা সফল বলতে হবে। কেননা আজ আমরা আল্লাহর বাণী ভুলে গিয়ে শয়তানের কৌশলকে সহজ করে দিচ্ছি। যা উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসে স্পষ্ট। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাইখ মিজানুর রহমান আজহারি হাফি. মিস্টেক হওয়া একটি স্টাটাস নিয়ে যা হলো তা এটাই প্রমান করে যে, আমরা শয়তানের কৌশলকে কতটা সহজ করে দিচ্ছি।
আল্লাহ তায়া’লা আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের মধ্যমপন্থী আলিমদের হেফাজতে রাখুন। তাদের ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি আমাদের অগোচরে থাকুক। ফেসবুকে আলিমদের অতি সমালোচনা থেকে আমাদের হেদায়েত করুন। আমিন।
বারাকাল্লাহ ফিক
মন্তব্য লিখুন