প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) এর সাথে বিবাহের সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তখনও ওহী প্রাপ্ত হননি। এই ২৫ বছরের মধ্যে প্রিয় চাচা আবু তালিবের সাথে তিনি ব্যবসা বানিজ্যের বিভিন্ন কাজে বিশ্বস্ত যোগ্য ও সর্বোত্তম সহোযোগী হিসেবে ছিলেন। ব্যবসাহের সুলভে তাঁর এ বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পেরেছিলেন মক্কার অন্যতম সম্ভান্ত্র মহীয়সী নারী হযরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭ বা ৪০ বছর।
তখনও তিনি ছিলের অনুপম সৌন্দর্যের এক রমনী। হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান বৈশিষ্ট্যের জন্য এ মহীয়সী নারী খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ তাঁর হৃদয়ে ভালোবাসা অনুভব করেন। এরপর খাদিজা (রাঃ) এর প্রস্তাবে ও চাচা আবু তালিবের পরামর্শে যুবক মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে খাদিজা (রাঃ) এর বিয়ে হয়ে যায়।
“সিরিয়ার বাণিজ্যিক সফর শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম মক্কায় ফিরে আসার পর খাদিজা রা. দেখলেন—অতীতের চেয়ে এবার তাঁর মুনাফা হয়েছে অনেক বেশি। এছাড়া তিনি ভৃত্য মায়সারার কাছে আল্লাহর রাসূলের উন্নত চরিত্র, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা শুনলেন। এসব শুনে মনে মনে তিনি রাসুলুল্লাহ সাঃ ভালােবেসে ফেললেন।
ইতােপূর্বে বড়াে বড়াে অনেক নেতা ও গােত্রপ্রধান তাঁর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনােটিই মঞ্জুর করেননি। অথচ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি নিজ অন্তরের গােপন বাসনা ও ব্যাকুলতার কথা তার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহ-এর কাছে ব্যক্ত করেন এবং বিষয়টি নিয়ে মুহাম্মদের সাথে আলােচনার জন্য তাঁকে অনুরােধ জানান।
নাফিসা খাদিজা রা.-এর প্রস্তাব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাঃ সাথে আলােচনা করলেন। আল্লাহর রাসুল তাতে রাযি হয়ে যান এবং তাঁর চাচা সাথে পরামর্শ করেন। তার চাচারা খাদিজার চাচার সাথে আলােচনা করেন এবং বিয়ের পয়গাম পাঠান। এরপর অনুষ্ঠিত হলাে বিয়ে। এ বিয়েতে বনু হাশিম এবং মুযার গােত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের দু’মাস পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাদিজা রা.-এর মধ্যে শুভবিবাহপর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি সহধর্মিনী খাদিজাকে মােহরানা স্বরূপ ২০টি উট দেন। ওই সময় খাদিজা রা.-এর বয়স হয়েছিলাে ৪০ বছর। সহায়-সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমাজের মধ্যে অগ্রগণ্য।বংশমর্যাদার ছিলেন শ্রেষ্ঠ নারী। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারীণী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম স্ত্রী। তাঁর জীবদ্দশায় রাসুল অন্য কোনাে মহিলার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি।”[ আর রাহিকুল মাখতুম]
সেই সময়ের কথা বলছি যখন নবীজি (সাঃ) কাছের প্রিয় সকল মানুষ এক এক করে মৃত্যু বরণ করে নবীজিকে একা করে দিচ্ছিল। ঠিক তখনই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) কে নিয়ামত সরূপ উপহার দেন। এক কথায় জাহিলিয়াতের ছোবলে ডুবে যাওয়া আরব সমাজের মধ্য হতে এমন এক বিদুষী, রমনী, মহীয়সী জীবনসঙ্গিনী ছিল নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে তখন অন্যতম সবচেয়ে সেরা উপহার।
পৃথিবীর বুকে খাদিজা (রাঃ) ছাড়া হৃদয়ের এত সন্নিকটে তখন আর তাঁর দ্বিতীয় কেউ ছিল। কেননা যে চাচার স্নেহ ছত্রছায়ায় তিনি (সাঃ) বেড়ে উঠেছেন সেই চাচাও তখন এ পৃথিবী ছেড়ে পরকালের পথে চলে জমান। তখন প্রিয়নবী (সাঃ) একমাত্র আশ্রয়স্থল ও সঙ্গী তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) এর ঘর। এক কথায় তখন তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আশ্রয়, কঠিন পথ চলার মানসিক শক্তি , সমাজ বিনির্মানের অনুপ্রেরণা, ক্লান্ত শরীর ও দুঃখ কষ্টের অংশীদারের একমাত্র সাথী এবং দ্বীনের দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষ ।
মহান আল্লাহ তায়ালা খাদিজা (রাঃ) কে এমন এক নিয়ামত দিয়ে হয়তো সৃষ্টি করেছিলেন যার কাছে গেলে তাঁর প্রিয় হাবীব (সাঃ) এর সকল কষ্ট ও ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যেত। বলা যায় প্রিয় হাবীবের প্রতি মহান আল্লাহর এ উপহার ও নিয়ামত ছিল ঐশ্বরিক ও জান্নাতি অপার সৌন্দর্যের নির্দশন।
নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ওহী প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি জাবালে নুরে হেরা গুহায় অধিকাংশ সময় অবস্থান করতেন। বিবি খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) সেই পর্বত অতিক্রম করে প্রানের চেয়ে প্রিয় স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে হাজির হতেন। নিজ হাতে মুখে খাবার তুলে দিতেন ভালোবাসার অনুপম সৌন্দর্যে।
দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই। হঠাৎ একরাতে জাবালে নুর যেন প্রকম্পিত হলো এক ঐশ্বরিক বাণীতে। নাজিল হলো মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল-কোরআনের সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত-
“পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি দয়ালু। মানুষ সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিন্ড হতে। পাঠ কর, আর তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।” [সূরা আলাক ১-৫ আয়াত ]
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স তখন ৪০ পূর্ণ হয়েছে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রচন্ড জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে আসেন। মূলত এটি ছিল মহান আল্লাহর ওহীর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। নবীজি এমত অবস্থায় কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) কে বললেন তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে। হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। রাসূল (সাঃ) এর অস্থিরতা কিছুটা দূর হলে তিনি খাদিজা (রাঃ) কে সবকিছু জানান।
প্রিয়তমা স্ত্রী তখন তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন-
“আপনি ভয় করবেন না, আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কখনো অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন, মেহমানদারী করেন, সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অপদস্থ করবেন না।” [আর রাহিকুল মাখতুম]
সুবহানাল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এমন এক মহান সহধর্মিণী দান করলেন যিনি কিনা তখন নবীজির এমতাবস্থায় বিচলিত ও হতাশ হয়ে পড়েননি বরং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জানিয়েছেন উত্তম কথা। রাসূল (সাঃ) এর নবুয়তি জীবনের এখানেই সূচনা।
নবীজির হাতে প্রথম নারী হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ (রাঃ) । এরপরই মক্কার জামিনে নবীজির শুরু হয়ে যায় আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার এক কঠিন পথচলা। এই কঠিন পথচলায় প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর সমস্ত সম্পদ দিয়ে ইসলামের জন্য অকাতরে দান করে দেন।
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তানদের মধ্যে ইবরাহিম ব্যতীত অন্যান্য সকলেই ছিলেন হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার গর্ভজাত সন্তান। তাঁদের প্রথম সন্তান ছিলেন কাসিম। এ কারণে আল্লাহর রাসুলকে বলা হতাে আবুল কাসিম বা কাসিমের পিতা। কাসিমের পর যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল্লাহর উপাধি ছিলাে। তাইয়্যিব ও তাহির। ছেলে সন্তান সকলেই শৈশবে ইন্তেকাল করেন।
তবে মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামের যুগ পেয়েছেন, মুসলিম হয়েছেন এবং মুহাজিরের মর্যাদাও লাভ করেছেন। কিন্তু ফাতিমা রা. ব্যতীত অন্যান্য মেয়েরা পিতার জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেন। ফাতিমা রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পর ইন্তেকাল করেন।” [আর রাহিকুল মাখতুম ]
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) খাদিজা (রাঃ) এর জীবদ্দশায় তাঁর প্রশংসা করতেন। এমনকি খাদিজা (রাঃ) এর মৃত্যুর পরও অন্য সকল স্ত্রীর চেয়ে রাসূল (সাঃ) তাঁর বেশি প্রশংসা করতেন। তিনি (সাঃ) সবসময় খাদিজা (রাঃ) এর ভালোবাসার কথা স্বরণ করতেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করতেন। তাঁর গুণের কথা বলতেন। অন্য স্ত্রীদের কাছে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার কথা তুলে ধরতেন । এককথায় নবীজি (সাঃ) এর হৃদয়ে প্রিয়তমা খাদিজার জন্য যে ভালােবাসা ছিল, তা তিনি অকপটে প্রকাশ করতেন।
এক হাদিসে হযরত আয়িশা (রাঃ) বলেন-
“‘আমি নবিজি (সাঃ) এর স্ত্রীদের মধ্যে আর কারও প্রতি এতটা ঈর্ষাবােধ করিনি, যতটা করেছি খাদিজা (রাঃ) এর বেলায়। অথচ তাঁকে আমি দেখিনি পর্যন্ত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) খুব বেশি তাঁর কথা স্মরণ করতেন। মাঝে মাঝে ছাগল জবাই করে গােশতের কয়েকটি ভাগ করতেন। তারপর সেগুলাে খাদিজার বান্ধবীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কখনাে আমি (ঈর্ষাবশত) বলতাম, “খাদিজা ছাড়া তাে দুনিয়ায় আর কোনাে নারীই নেই!” তখন রাসুল সাঃ বলতেন, “খাদিজা এমন ছিল। এমন গুণবতী ছিল…. তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে।” [সহিহ বুখারী]
জন্ম: ৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।
বিয়ে: বিয়ের সময় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বয়স ছিল ৪০ এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের বয়স ছিল ২৫।
বিবাহ সন: ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দ।
দাম্পত্যজীবন: রাসুলের সাথে তার দাম্পত্যকাল ২৪ বছর ৬ মাস বা প্রায় ২৫ বছর। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসুল দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
মৃত্যুসন: ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল/মে মােতাবেক নবুওয়াতের দশম বর্ষের রমজান মাসের ১০ তারিখ।
দাফন: মক্কার ‘হাজুনে’; মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
আজ এমন এক মহান মহীয়সী নারী সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করলাম যিনি কিনা এমন এক নারী যাঁর সম্মানে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সালাম জানিয়েছিলেন। তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার এমন এক সৃষ্টি যাঁর জীবন ও কর্ম পৃথিবীর সকল নারী জাতির জন্য সেরা অনুকরণীয় আদর্শ। তাই আমাদের এ মহীয়সী মাতার জীবন থেকে-ই আদর্শের সেরা শিক্ষা গ্রহন করতে হবে।
তাই বলছি, আজকের এ আধুনিক সমাজের নারী জাতির জন্য তাঁর চেয়ে সেরা কোনো মডেল আর কেউ হতে পারে না! আল্লাহ নামে শপথ করে বলছি- হে আমার বোন, আপনার জন্য উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) যখন সেরা মডেল। আপনিও তখন অন্য নারীদের চেয়ে অন্যন্য ও সেরা। আর তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে-ই।
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) এর মাধ্যমে পৃথিবীর সকল নারী জাতিকে কতোটা বেশি সম্মানিত করেছেন যার বর্ণনা করে হয়তো শেষ করা যাবে না। তাই সেই জালিয়ালিয়াতে নিমজ্জিত আরব জাতি থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাপ্তি পর্যন্ত সকল নারী জাতি আমাদের এ মহান মহীয়সী মাতার কারনেই সম্মানিত ও মহান আদর্শিক চরিত্র।
মহান আল্লাহ তায়ালা উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ (রাঃ) থেকে আমাদের সকলকে আদর্শের মহান শিক্ষা গ্রহনের তৌফিক দান করুন এবং পৃথিবীর সকল নারী জাতিকে তাঁর আদর্শের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন