মানুষের হলো এক সমন্বিত সত্তা। মানুষের মধ্যে যেমন রয়েছে আল্লাহর প্রতি তীব্র হেদায়েতের তামান্না, ঠিক তেমনি রয়েছে পথভ্রষ্ট শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রতি সখ্যতা। অর্থাৎ একদিকে রয়েছে হেদায়েতের জন্য তীব্র আকাঙ্খা, অন্যদিকে আবার জাহিলিয়াত বা গোমরাহির প্রতি আকর্ষণ। যদিও মানুষকে মহান আল্লাহ তায়া’লা দিয়েছেন জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-চেতনা, যা কাজে লাগিয়ে সে ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য করে পথ চলতে সক্ষম। তারপরও শয়তানের কুমন্ত্রণায় মানুষ তুলনামূলক অনেকটা বেশি আসক্ত হয়ে যায় এবং নফসের গোলামি করতে থাকে।
তবে ভালো ও মন্দের এই উভয় বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে কিছু মানুষ আল্লাহ তায়া’লার হেদায়েতের মহিমায় সিক্ত হয়ে জয় করে নেয় দুনিয়া ও পরকালে প্রকৃত সফলতা। আবার কিছু লোক ভ্রষ্টতার উপত্যকায় ঘুরতে থাকে, আর তারা হবে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই লাঞ্ছিত। তাই নফসের গোলামি আর হেদায়েতের পথনির্দেশনা কখনোই এক নয়। একটি হলো ধ্বংসের কারণ, অন্যটি মুক্তির মঞ্জিল।
মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারিমে এ কথাই বলেছেন-
“শপথ নফসের এবং তাঁর যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন। তারপর তার পাপ ও তার তাকওয়া তার প্রতি ইলহাম করেছেন অর্থাৎ তাকে তার সৎকাজের এবং তার অসৎ-কাজের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে কলুষিত করেছে।” [সূরা আশ শামস:৭-১০]
এই আয়াতগুলোর তাফসিরে মুফাস্সিরগণ বর্ণনা করেছেন-
আয়াতে ‘নাফস’ শব্দটি দ্বারা যেকোনো প্রাণীর নফস বা আত্মা উদ্দেশ্য হতে পারে, আবার জবাবদিহি করতে বাধ্য মানুষের নফসও উদ্দেশ্য হতে পারে। [সা‘দী] এছাড়া ‘সুবিন্যস্ত করার’ এ অর্থ রয়েছে যে, তাকে জন্মগতভাবে সহজ সরল প্রকৃতির উপর সৃষ্টি করেছেন। [ইবনে কাসীর]
উক্ত আয়াতের অর্থে আরও বলা যায়,”আল্লাহ্ মানুষের নফসের মধ্যে নেকি ও গুনাহ উভয়টি স্পষ্ট করেছেন এবং চিনিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রত্যেক নফসেরই ভালো ও মন্দ কাজ করার কথা রেখে দিয়েছেন; এবং যা তাকদীরে লেখা রয়েছে তা সহজ করে দিয়েছেন।” [ইবনে কাসীর]
নফসের গোলামি নিয়ে ঠিক একথাটি পবিত্র কুরআনের অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে-
“আর আমরা ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুস্পষ্ট করে রেখে দিয়েছি।”[সূরা আল-বালাদ:১০]
“আমরা তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, চাইলে তারা কৃতজ্ঞ হতে পারে আবার চাইলে হতে পারে অস্বীকারকারী।” [সূরা আল-ইনসান: ৩]
“অবশ্যই আমি শপথ করছি নাফস আল-লাওয়ামার (বিবেকের)।” [সূরা আল-কিয়ামাহ: ২]
যদিও মানুষের নফস ও বিবেক এমনি এক জিনিস যা তাকে প্রত্যেক অসৎ কাজের জন্য মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার জানাতে থাকে। আবার ভালো কজের জন্য উৎসাহিত করে। কিন্তু হয়তো বা বিবেকের অচেতনা তাকে এই তিরস্কার ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয় না। কেননা সে তার বিবেকের বাধা কখনোই উপলব্ধির চেষ্টা করে না। তাই ভলো ও মন্দের সকল কাজের জন্য কখনোই নফসের দোহাই দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবা অজ্ঞতার আরেক কারণ বলে মনে করছি।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহর তায়া’লা আরও বলেন-
“আর প্রত্যেক ব্যক্তি সে যতই ওজর পেশ করুক না কেন সে কি তা সে খুব ভালো করেই জানে।”[সূরা আল-কিয়ামাহ্ঃ ১৪-১৫]
এই তাফসীর অনুযায়ী এরূপ প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই যে, মানুষের সৃষ্টির মধ্যেই যখন পাপ ও ইবাদত নিহিত আছে, তখন সে তা করতে বাধ্য। অর্থাৎ নফসের গোলামি করতে সে বাধ্য, তাই এর জন্যে সে কোন সওয়াব অথবা আযাবের যোগ্য হবে না। একটি হাদীস থেকে এই তাফসীর গৃহীত হয়েছে। তাকদীর সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জওয়াবে রাসূল (সা.) আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করেন। [মুসলিম: ২৬৫০, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৪৩৮]
উক্ত আয়াতের অর্থে এও বুঝা যায়,”সেই ব্যক্তিই ব্যৰ্থ, যে নিজের নাফসকে নেকী ও সৎকর্মের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করার পরিবর্তে দাবিয়ে দেয়, তাকে বিভ্রান্ত করে অসৎপ্রবণতার দিকে নিয়ে যায়।” [ফাতহুল কাদীর]
আবার কোন কোন মুফাস্সির আয়াতের এ অর্থ করেছেন,”সে ব্যক্তি সফলকাম হয়; যাকে আল্লাহ্ পরিশুদ্ধ করেন এবং সে ব্যক্তি ব্যর্থ, যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা গোনাহে ডুবিয়ে দেন।” [ইবনে কাসীর, তাবারী]
এ তাফসীর থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তায়া’লা মানুষের মধ্যে গোনাহ ও ইবাদত উভয়ের যোগ্যতাই গচ্ছিত রেখেছেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে যে কোন একটি করতে বাধ্য করেননি। বরং মানুষকে উভয়ের মধ্য থেকে যে কোন একটি করার ক্ষমতা দান করেছেন অর্থাৎ নফস দান করেছেন। তাই প্রত্যেকের কর্মফল একমাত্র তারই হাতের কামাই। এরজন্য সেদিন (কিয়ামত) আল্লাহকে দায়ি বা দোষারোপ করা যাবে না। কেননা মানুষ একমাত্র জীব যাদের মহান আল্লাহর তায়া’লা ভালো মন্দের পার্থক্য করার সক্ষমতা দান করেছেন ৷
আর শয়তানের কাজই হচ্ছে ধোঁকা ও কুমন্ত্রণা দেওয়া (অর্থাৎ নফসের গোলামি করানো), কিন্তু সে অনুযায়ী সকল কাজের বাস্তবায়ন তো মানুষই করে থাকে। তার বিবেক এসকল কাজ সম্পর্কে অবশ্যই তাকে সঠিক দিক দেখাবে, যদি সে দ্বীনের আলোয় চিন্তা করে। তাই কিয়ামতের দিন শয়তানকে নিজের কাজের দোষারোপ দিয়ে, নিজেকে রক্ষা কারও সম্ভব হবে না। বরং প্রত্যেকের উচিত বেশি বেশি করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। তবেই সে শয়তানের ধোঁকা ও কুমন্ত্রণা থেকে নিজের বিবেকের সঠিক ব্যবহার করতে সক্ষম হবে৷ নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।
একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লহ (সা.) দো‘আ করতেন-
“হে আল্লাহ্ আমাকে তাকওয়ার তওফীক দান করুন এবং নাফসকে পবিত্র করুন, আপনিই তো উত্তম পবিত্রকারী। আর আপনিই আমার নাফসের মুরুব্বী ও পৃষ্ঠপোষক।” [মুসলিম: ২৭২২]
আবার, তাকওয়া যেভাবে ইলহাম হয়, তেমনিভাবে আল্লাহ্ তায়া’লা কোন কোন মানুষের পাপের কারণে তাদের অন্তরে পাপেরও ইলহাম করেন।” [উসাইমীন: তাফসীর জুয আম্মা]
‘ইলহাম’ শব্দটির উৎপত্তি লহম (আরবী ) থেকে৷ এর মানে গিলে ফেলা৷ যেমন বলা হয় উমুক ব্যক্তি জিনিসটিকে গিলে ফেলেছে৷ আবার বলা হয় , আমি উমুক জিনিসটি তাকে গিলিয়ে দিয়েছি বা তার গলায় নীচে নামিয়ে দিয়েছি৷ এই মৌলিক অর্থের দিক দিয়ে ইলহাম শব্দ পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কল্পনা বা চিন্তাকে অবচেতনভাবে বান্দার মন ও মস্তিষ্কের গোপন প্রদেশে নামিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়৷ মানুষের প্রতি তার পাপ এবং তার নেকী ও তাকওয়া ইলহাম করে দেয়ার দু’টি অর্থ হয়৷
(১) স্রষ্টা তার মধ্যে নেকী ও গোনাহ উভয়ের ঝোঁক প্রবণতা রেখে দিয়েছেন৷ প্রত্যেক ব্যক্তিই এটি অনুভব করে৷
(২) প্রত্যেক ব্যক্তির অবচেতন মনে আল্লাহ এ চিন্তাটি রেখে দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোন জিনিস ভালো ও কোন জিনিস মন্দ এবং সৎ নৈতিক বৃত্তি ও সৎকাজ এবং অসৎ নৈতিক বৃত্তি ও অসৎকাজ সমান নয়৷ ফুজুর ( দুস্কৃতি ও পাপ ) একটি খারাপ জিনিস এবং তাকওয়া ( খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা) একটি ভালো জিনিস , এ চিন্তাধারা মানুষের জন্য নতুন নয়৷ বরং তার প্রকৃতি এগুলোর সাথে পরিচিত৷ স্রষ্টা তার মধ্যে জন্মগতভাবে ভালো ও মন্দের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। [ তাফহীমুল কুরআন ]
তাই এ সম্পর্কে শাইখ সালিহ আল-উসাইমিন (রহ.) বলেন-
“যদি আল্লাহ্ কারও প্রতি সদয় হন তবে তাকে ভাল কাজের প্রতি ইলহাম করেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজ করতে সমর্থ হয়, সে যেন আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে। আর যদি সে খারাপ কাজ করে তবে তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা উচিত। আল্লাহ্ কেন তাকে দিয়ে এটা করালেন, বা এ গোনাহ তার দ্বারা কেন হতে দিলেন, এ ধরনের যুক্তি দাঁড় করানোর মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়েই রাখা যায়, কোন সমাধানে পৌঁছা যাবে না।
কারণ, রহমতের তিনিই মালিক। তিনি যদি তার রহমত কারও প্রতি উজাড় করে দেন তবে সেটা তার মালিকানা থেকে তিনি খরচ করলেন পক্ষান্তরে যদি তিনি তার রহমত কাউকে না দেন তবে কারও এ ব্যাপারে কোন আপত্তি তোলার অধিকার নেই। যদি আপত্তি না তোলে তাওবাহ করে নিজের কোন ক্রটির প্রতি দিক নির্দেশ করে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসে তবে হয়ত আল্লাহ্ তাকে পরবর্তীতে সঠিক পথের দিশা দিবেন এবং তাঁর রহমত দিয়ে ঢেকে দিবেন এবং তাকওয়ার অধিকারী করবেন।
ঐ ব্যক্তির ধ্বংস অনিবার্য যে আল্লাহর কর্মকাণ্ডে আপত্তি তোলতে তোলতে নিজের সময় নষ্ট করার পাশাপাশি তাকদির নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ভাল আমল পরিত্যাগ করে তাকদীরের দোষ দিয়ে বসে থাকে। হ্যাঁ, যদি কোন বিপদাপদ এসে যায় তখন শুধুমাত্র আল্লাহর তাকদীরে সন্তুষ্টি প্রকাশের খাতিরে তাকদীরের কথা বলে শোকরিয়া আদায় করতে হবে। পক্ষান্তরে গোনাহের সময় কোনভাবেই তাকদীরের দোহাই দেয়া যাবে না। বরং নিজের দোষ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে ভবিষ্যতের জন্য তাওফীক কামনা করতে হবে। এজন্যই বলা হয় যে, ‘গোনাহের সময় তাকদীরের দোহাই দেয়া যাবে না, তবে বিপদাপদের সময় তাকদীরের দোহাই দেয়া যাবে।”
[দেখুন, উসাইমীন, আল-কাওলুল মুফীদ শারহু কিতাবুত তাওহীদঃ ২/৩৯৬-৪০২]
উক্ত আলোচনা থেকে একটি কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, আমাদের একটি জগন্য বদঅভ্যাস রয়েছে। আমরা নিজেদের দোষ, অপরাধ বা ভুলের জন্য একমাত্র তাকদিরের দেহাই দিয়ে, মহান আল্লাহর উপর অভিযোগ দাড় করিয়ে ফেলি। কিন্তু তাকদিদের প্রকৃত অর্থই বুঝতে চাই না। তাকদিদের বা ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহ ফরজ করেছেন। তাই তাকদিরে বিশ্বাস স্থাপন না করে নিজেকে ইমানদার দাবি করা নিছক অজ্ঞতা বা জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এর মানে এই নয়, নফসের গোলামি করে সকল কাজের জন্য তাকদিরের দোহাই দিতে হবে।
প্রিয় পাঠক, মহান আল্লাহ তায়া’লা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাদের একমাত্র রব, তাই তিনি আমাদের মন মস্তিষ্ক সম্পর্কে অতি সুক্ষ্ম ভাবেই অবহিত। আপনি আমি আগামি কাল কি করবো, এক সপ্তাহ পরে কি করবো, একমাস, এক বছর, এক যুগ বা শতাব্দী পর শতাব্দী কি করতে পারি সে সম্পর্কে তিনি কি অবহিত নন? আ. হা, তিনি তো এ জন্যই সৃষ্টিকর্তা কেননা তিনি এসব বিষয়ে অতি সুক্ষ্ম ভাবে অবহিত, যা আর করো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়।
এখন তথ্য ও প্রযুক্তির কল্যানে আমরা ভবিষ্যতের অনেক কিছু নিয়েই হয়তো অনুমান করতে পারি। তবে অনুমানের কার্যকারিতা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা একমাত্র মহান আল্লাহরই সঠিক জানেন। কেননা আমরা হয়তো বললাম আগামি কাল, এ কাজটি বা ঐ কাজটি করবো অথবা অমুক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করবো। কিন্তু দেখা গেল তার আগেই মৃত্যু এসে হাজির হয়েছে বা অন্য কোন সমস্যা কিংবা ব্যস্ততার জন্য কাজটি বা সক্ষাতটি করাই হয়নি। এরকম সহস্র উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, আলোচ্য অনুচ্ছেদে আমরা শুধু একটু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র করেছি।
আরও পড়ুনঃ কুরআনের দৃষ্টিতে অশ্লীলতা বা পর্নোগ্রাফি আসক্তি এবং এ থেকে মুক্তির উপায়
একমাত্র মহান আল্লাহ তায়া’লাই আমাদের ভবিষ্যত কর্মের প্রতিটা বিষয় সম্পর্কে অবহিত এবং ফেরেস্তা কর্তৃক তা তিনি লিখে রেখেছেন। ফলে যা লেখা হয়েছে তা নিশ্চিত হবে, এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা ইমানের চরম দূর্বলতার দিক। এখনে এই বিষয়টি আরও একটু পরিস্কার করে বলছি- আমরা আমাদের জ্ঞান, বিবেক বা বুদ্ধি দ্বারা যা কিছু করতে যাচ্ছি, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা জানেন এবং তিনি সেটা আগে থেকেই লিখে রেখেছেন। আর এটিই হলো তাকদির৷
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“তুমি কি জান না যে, নভোমণ্ডলে ও ভুমন্ডলে যা কিছু আছে আল্লাহ সবকিছু জানেন। নিশ্চয় এসব কিতাবে লিখিত আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর কাছে সহজ।”[সূরা হজ্জ, আয়াত: ৭০]
সহিহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন-
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকূল সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সৃষ্টিকূলের তাকদির লিখে রেখেছেন।”
তিনি আরও বলেন-
“আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্টি করেছেন কলম। সৃষ্টির পর কলমকে বললেন: ‘লিখ’। কলম বলল: ইয়া রব্ব! কী লিখব? তিনি বললেন: কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাকদির লিখ।”[ আবু দাউদ: ৪৭০০] আলবানি (রহ.) সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
সুতরাং নফসের গোলামি বা নিজের অপরাধ, ভুল, পাপের জন্য আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, ইচ্ছা বা কর্মই দোষী হবে, এখানে তাকদিরের প্রতি দোহাই দিয়ে আল্লাহর উপর অভিযোগ আনা নিছক মূর্খতা বা জাহিলিয়াতের কাজ। তাই জ্ঞান, বিবেকের সঠিক কার্যক্রমের জন্য আমাদের সত্য ও মিথ্যা উপলব্ধি করে কাজ করা উচিত। এর জন্য একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং রাসূল (সা.) এর অনুসরণ করাই আমাদের একমাত্র পথনির্দেশনা।
আল্লাহ তায়া’লা মানুষ কে ইচ্ছে শক্তি দিয়েছেন। তাই বান্দার কর্মের সাথে বান্দার ইচ্ছে ও ক্ষমতা থাকা সাংঘর্ষিক নয়। মানুষের ইচ্ছে শক্তি রয়েছে অর্থাৎ বান্দা ইচ্ছা করলে কোন নেক কাজ করতে পারে এবং ইচ্ছা করলে তা বর্জন করতে পারে। ইচ্ছা করলে কোন গুনাহর কাজ করতে পারে এবং ইচ্ছা করলে তা বর্জন করতে পারে। শরিয়তের দলিল ও বাস্তব দলিল বান্দার এ ইচ্ছাশক্তি সাব্যস্ত করে।
মানুষের এই ইচ্ছে শক্তি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বেশ কিছু আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“ঐ দিনটি সত্য। অতএব যার ইচ্ছা সে তার রবের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করুক।”[সূরা নাবা, আয়াত: ৩৯]
“সুতরাং তোমরা তোমাদের ফসলক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে গমন কর”[সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৩]
আল্লাহর বান্দার সক্ষমতা সম্পর্কে বলেন-
“অতএব, তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর।” [সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬]
“আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে যা অর্জন করে তা তার-ই জন্য এবং সে যা কামাই করে তা তার-ই উপর বর্তাবে।” [সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬]
এ আয়াতগুলো সাব্যস্ত করে যে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে। এ দুটির মাধ্যমে সে যা ইচ্ছা তা করতে পারে এবং যা ইচ্ছা তা বর্জন করতে পারে। তবে মহান আল্লাহ ইচ্ছে ব্যতিত কিছুই হয় না৷ মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতার অনুবর্তী।
এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ তায়া’লার বাণী-
“যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়- তার জন্য। আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন।” [সূরা তাকবীর, আয়াত: ২৮-২৯]
তাছাড়া গোটা মহাবিশ্ব আল্লাহ তাআলার মালিকানাধীন। অতএব, তাঁর মালিকানাভুক্ত রাজ্যে কোন কিছু তাঁর অজ্ঞাতসারে অথবা অনিচ্ছায় ঘটা সম্ভব নয়। সবকিছুই আল্লাহ তায়া’লা তাকদির হিসেবে লিখে রেখেছেন। তাই তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাকদিরের দোহাই দিয়ে নফসের গোলামি করা নিছক ভুল চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়।
মহান আল্লাহ তায়া’লা আমাদের কে নফসের গোলামি বা কুপ্রভাব থেকে হেফাজত করুক, আমিন।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন