মানুষের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক হলো মাথার চুল৷ দেশ, বর্ণ, গোত্র বা জাতিগত ভিন্নতার কারণে এক এক স্থানে মানুষের চুলের রং, আকার ও গঠনে কিছুটা ভিন্নতা বা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷ তবে বাঙালি জাতির মাথার চুল সাধারণত কালো রঙের হয়ে থাকে৷ তাই আমরা অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা পছন্দের তারকা বা ব্যক্তির মত মাথার চুল রাখার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু এই চুল রাখার ব্যাপারেও যে ইসলামে কিছু নিয়ম বেধে দেওয়া হয়েছে, আমরা হয়তো অনেকেই সে ব্যাপারে অবগত নই। তাই মনমত বিভিন্ন স্টাইলে চুল রাখা কখনো সৌন্দর্যের প্রতীক হতে পারে না। বরং চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি প্রত্যেক মুসলিমের অনুসরণ করা উচিত এবং এটিতেই চুলের প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে আমরা বিশেষ করে কিশোর-যুকদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি দেখতে পাই যে, তারা বিভিন্ন দেশের নায়ক, গায়ক, খোলোয়ার বা পছন্দের ব্যক্তিকে তাদের মডেল মনে করে থাকে। তাই তাদের মত তারা চুলের স্টাইল করে ও বিভিন্ন রং করে থাকে। আসলে এটা খুবই দুঃখজনক, কেননা তারা মুসলিম হওয়া সত্যেও এমন কিছু মানুষকে মডেল মনে করে বা অনুসরণ করে থাকে, যাদের সাথে ইসলামি আদর্শের মৌলিক কোন মিল নেই। বরং খুঁজে দেখবেন ঐসকল মানুষগুলো হলো বিকৃত রুচির ও পথভ্রষ্ট।
আজ আমরা কিশোর ও যুকদের মাথায় যে বিভিন্ন স্টাইলে চুল রাখার প্রতিযোগিতা দেখতে পাই, তা একদমই ইসলাম সম্মত নয়। আর আমরা বেশিরভাগ মানুষই এ ব্যাপারে ভালো করে জানি না যে, ইসলামে এ বিষয়ে কি বলা হয়েছে? তাই আজ আমরা হাদিসের আলোকে চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করছি, ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় নবী (সা.) কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার দাবিতে আমরা তাঁর প্রতিটা সুন্নাহকে সম্মান ও অনুসরণ করা সর্বোত্তম সৌন্দর্য এবং মডেল মনে করে থাকি। আচ্ছা আমরা কখনো কি জেনে দেখেছি, কেমন ছিল আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এর মাথার চুল মোবারক? কেমন করে চুল রাখতেন তিনি? কেমনি বা পছন্দ করতেন বা অনুমোদন করেছেন!! রাসূল (সা.) এর সিরাত ও হাদিস থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়-
“রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে আরব পুরুষদের রীতি ছিল লম্বা চুল রাখা। এমনকি রাসূল নিজেও লম্বা চুল রাখতেন। তাঁর চুল কখনো কানের মাঝামাঝি, কখনো কানের লতি কিংবা দুই কাঁধ পর্যন্ত লম্বা থাকতো। তাঁর চুল কাঁধ ছাড়িয়ে আরো লম্বা হতো বলেও জানা যায়।” [তিরমিযী, আশ শামাইল আল মুহাম্মাদিয়া]
কখনো এতদূর অবধি তাঁর মাথার চুল লম্বা হতো যে, তা তিনি বিনুনি/গুচ্ছ করে রাখতেন। তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানী (রা.) বলেন-“মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কায় আগমণ করলেন তখন তাঁর চুলে চারটি গুচ্ছ বা বিনুনি ছিল।”
দেখুন-[ তিরমিযী, আস সুনান ৪/২৪৬, আবু দাউদ, আস সুনান ৪/৮৩, ইবনু মাজাহ, আস সুনান ২/১১৯৯, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৫৭২, ১০/৩৬০, আলবানী, মুখাতাসারুশ শামাইল/৩৫]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন-“তাঁর চুল যখন লম্বা হতো তখন তিনি তা চারটি গুচ্ছে বিভক্ত করে রাখতেন।”[ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা’আদ ১/১৭০]
*আরবীতে চুল জড়িয়ে বা বিনুনি করাকে “গাদীরাহ” বলে। হাদিসে “আরবায়ু গাদায়ের” চারটি গুচ্ছ ভাষাটি ব্যাবহার হয়েছে।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ.) বলেন- “অধিকাংশ সময়ে তাঁর চুল এরূপ কাঁধের কাছাকাছি থাকত। কখনো তা আরো লম্বা হতো এবং ঝুলন্ত গুচ্ছেলে পরিনত হতো। তিনি সেগুলোকে বিনুনি বানিয়ে রাখতেন” তবে কাঁধ অবধি থাকা তাঁর স্বাভাবিকতা ছিল। [ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১০/৩৬০]
একঃ “হজ্জ বা উমরা ব্যতীত তিনি কখনো মাথার চুল মুন্ডন করেছেন বলে জানা যায় না।” [ ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা’আদ ১/১৬৭, শামী সীরাহ শামিয়াহ ৭/৩৪৯-৩৫০]
মাথা মুন্ডন প্রসঙ্গে চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি নিয়ে সেজন্যই মতভেদ আছে যে, মুন্ডন করা যাবে কি? যাবে না? কোনো কোনো ফকীহ হজ্জ উমরা ছাড়া মাথা মুন্ডন কে মাকরুহ বলেছেন। তারা দু কারণে তাদের মতের পক্ষে এ প্রমাণ পেশ করেন। প্রথমত: রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কখনোই হজ্জ উমরা ছাড়া মাথা মুন্ডন করেন নি। দ্বিতীয়ত: বিভিন্ন হাদিস থেকে মাথা মুন্ডন আপত্তিকর বলে জানা যায়। আর সাহাবীগণ ছোট চুল রাখতেন এবং নেড়া (মুন্ডর করা) পরিহার করতেন।
দুইঃ হযরত জাবির (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “হজ্জে বা উমরা ছাড়া মাথার চুল ফেলা যাবে না।” [দূর্বল সনদে- তাবারানী, আল মু’জামুল আউসাত ৯/১৮০]
*দূর্বল হলেও বেশ কয়েকটি সনদে হাদিসটি উল্লেখ আছে। তবে হাদিসের বর্ননা সূত্রের কেউ মিথ্যায় অভিযুক্ত নন।
আবু নু’আইমের বর্ণনায় হাদিসটি হলো- “হজ্জে বা উমরা ছাড়া মাথার চুল ফেলা যাবে না। এছাড়া তা সৃষ্টি বিকৃতি করা বলে গণ্য হবে।”[আবু নু’আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/১৩৯]
অন্য হাদিসে হযরত জাবির (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- “যে ব্যক্তি (মাথার চুল) মুন্ডন করে, (পোশাক পরিচ্ছদ) ছিড়ে ফেলে বা চিৎকার করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”[সহীহ বুখারী ৬/২৭৪৮]
তিনঃ আবূ মূসা আশআরী (রা) থেকে একাধিক গ্রহনযোগ্য সনদে এ অর্থে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তবে এ হাদীসটি মূলত বিপদ মূসিবতে অধৈর্য্য হয়ে এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
দুবা’য়ি নামক এক নিকৃষ্ট অপরাধী ব্যক্তিকে হযরত উমার (রা) শাস্তি প্রদান করেন এবং বলেন- “তোমাকে যদি মাথা মুন্ডিত অবস্থায় পেতাম, তবে আমি যাতে তোমার চক্ষুদ্বয় রয়েছে তা (তোমার মস্তক) তরবারীর আঘাতে কেটে ফেলতাম।” এর মানে শাস্তি অধিক হতো। [ ইবনু কুদামা, আল মুগনী ১/৬৫]
সুতরাং এ থেকেও বোঝা যায়, সাহাবীগণ মাথা মুন্ডনের অভ্যাস কে আপত্তিকর বলে মনে করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহ.) বলেন-“প্রথম যুগের সালাফগণ মাথা মুন্ডন করা মাকরুহ বলে মনে করতেন।”[মোল্লা আলী কারী, মিরকাত ৮/২৪০]
যদিও তা হারাম বা গুনাহের কাজ ভাবা ঠিক হবে না। বরং আমরা এতটুকু বলতে পারি, এ হাদিস থেকে বুঝা যায় এরূপ (মাথা মুন্ডন) করা চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি নয়।
মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন- “চুল দীর্ঘ হওয়া কোনো নিন্দিত বিষয় নয়। কাঁধ ছাপিয়ে পরিমাপের চেয়ে বড় হলে চুল কেটে ফেলতে হবে বলেও কোনো নির্দেশ নেই।” [মিরকাত ৮/২৪০]
সুতরাং পুরুষের চুল কাঁধের নীচে চলে গেছে মানেই তিনি গুনাহ করছেন, এটি দ্বীনি জ্ঞানে অজ্ঞদের ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এই বড় চুল রাখা দ্বারা যেন অহংকার প্রকাশ না হয়। আর এ (বড় রাখা বা ছোট রাখা) নিয়ে একে অপরের মাঝে যেন বিবাদের কোন কারণ না ঘটে।
চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি মানে এই নয় যে, বড় চুল রাখা পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। বরং অনেক ফকীহ দাড়ি বড় হবার আগে চুল বড় করতে বারণ করেছেন (তাশাব্বুহ মায়ান নিসওয়ান)। আর ছোট করে চুল রাখাও জায়েজ। তবে এক্ষেত্রে মাথার সব অংশে চুল তা সমান হতে হবে। কোথায় বড় কোথাও ছোট এভাবে রাখা ইসলামে সুন্নাহ সম্মত নয়।
হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত -“তাঁর কাধ ছাপিয়ে বিশাল চুল নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে জিজ্ঞাসা করলে রাসূল (সা.) তাঁকে একদিন পর চুল আঁচড়াতে এবং পরিপাটি করে রাখতে নির্দেশ দেন।” [নাসায়ী – ৮/১৮৪]
অর্থাৎ চুল বড় রাখলেও তা সুন্দর বা পরিপাটি করে রাখতে হবে। এলোমেলো রাখা ঠিক নয়। আবার চুলের যত্নে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ অনুসারে “চুলে তেল দেয়া, সুগন্ধি মিশিয়ে তেল দেয়া, পুরুষের জন্য আঁচড়িয়ে পরিপাটি রাখা, মাঝে সিথি করাও সুন্নত।”[ মুয়াত্তা মালিক- ২/৯৪৯]
(০১) হাদিসের আলোকে আমরা রাসূল (সা.) এর চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আর এই প্রবন্ধে কিভাবে চুল রাখা উচিৎ তাও কিছুটা বর্ণনা করেছি। তবে এখানে হাদিসে মাথা মুন্ডন না করার ব্যাপারে কিছুটা বেশি কঠোরতা দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে মাথা মুন্ডন একদমি করা যাবে না। বরং প্রয়োজনে করা যেতে পারে। আসলে আমাদের সমাজে প্রচলন রয়েছে যে, মাথা মুন্ডন করা সুন্নাত। তবে এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট হলাম যে এটি সুন্নাহ নয়৷ তাই কাউকে আইডল বা মডেল মনে করে মাথা মুন্ডন করা শার’ঈ বিরোধী কাজ বলতে পারি।
আবার কাউকে আইডল বা মডেল মনে করে চুল এক জায়গায় ছোট, অন্য স্থানে বড় করে রেখে ফ্যাশন করাও ঠিক (জায়েজ বা বৈধ) নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ কিশোর-যুবকরা এটিই বেশি করে থাকে। তারা মাথার পিছনে ও পাশ দিয়ে চুল ছোট করে সমানে দিয়ে চুল বড় করে দেয়। আবার কেউ কেউ দুপাশে ছোট করে মাঝখানে বড় করে রাখে এবং বিভিন্ন রঙের কালার করে থাকে। যা সরাসরি সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।
তবে একটি কথা, আমরা কাউকে এভাবে চুল, ছোট-বড় মিশিয়ে রাখলে, কিম্বা চুলে রং করে কারো মতো স্টাইল করতে দেখলে তাকে নিয়ে যেন কটু বা খারাপ মন্তব্য না করি। বরং সুন্দর মার্জিত ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এটা ঠিক নয়। এটিই ইসলামের আদর্শ। তাই আমাদের জন্য দুনিয়া ও পরকালের সকল ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করাই হলো সর্বোত্তম আদর্শ।
(০২) আবার কেউ বড় চুল রাখলে, কানের লতি ছাপিয়ে নীচে গেলেই না বুঝে আপত্তিকর বা বাজে মন্তব্য যেন আমরা না করি। কেননা এ সম্পর্কে স্পষ্ট হাদিস রয়েছে। রাসূল (সা.) এর যুগে আরবরা চুল এভাবে বড় রাখত এবং রাসূল (সা.) নিজেও এমন চুল রেখেছেন হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে দাড়ি না রেখেই*, চুল বড় রাখার সুন্নত পালন করা একটু বেশি বেশি হয়ে যাবে বলে মনে করছি। অনেক ফকিহগণ তো সরাসরি নিষেধ করেই দিয়েছেন।
[*দাড়ি রাখা হলো ওয়াজিব, চুলের ব্যাপারটা সুন্নাহ পর্যন্ত এটি ওয়াজিব বা ফরজ নয়।]
আর কোন যৌক্তিক কারনে পিতামাতা যদি সন্তানকে চুল ছোট রাখতে বলেন, তবে তা সন্তানদের মান্যকরা দায়িত্ব। কেননা চুল বড় রাখা একটি সুন্নাহ যায়েদা, কিন্তু পিতামাতার বাধ্য থাকা ফরজ। সুতরাং এটি নিয়ে একদমই যেন বাড়াবাড়ি না হয়। মহান আল্লাহ তায়া’লা আমাদের সকলকে সহিহ বুঝ দান করুক, আমিন।
এ বিষয়ে (চুল রাখার সুন্নত পদ্ধতি) আরও বিস্তারিত জানতে ড.খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহি.) রচিত “ইসলামে পোশাক পর্দা ও দেহ-সজ্জা” বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন