সামাজিক মাধ্যম আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

সামাজিক মাধ্যম আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আমাদের পাঠাভ্যাসের জায়গা দখলে নিয়েছে দেখাভ্যাস। প্রথমটি সভ্যতার সন্ধানে মানুষের তৈরি পরেরটি এনেছে কোম্পানী তার ব্যবসার প্রয়োজনে। উদ্দেশ্যগুলি খেয়াল করা দরকার। না হলে স্বকীয়তা হারানোর পরিণাম এড়ানো কঠিন হবে।” –মোঃ মমতাজ হাসান

এটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক যে, সামাজিক মাধ্যম গুলির (সোশ্যাল মিডিয়া) ভুমিকা নিয়ে কোন আলোচনা হয়না। এগুলি আসলে কী করছে, আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত পরিণতি কী? সেসব প্রশ্নে সবাই নীরব। এই ফাঁকে বেড়ে চলেছে মাধ্যমগুলির আগ্রাসন।

বর্তমানে এগুলি খুব জনপ্রিয় ও কাজের, যুগপৎভাবে অনেককে সংযুক্ত করতে পারে ও প্রচুর তথ্যের যোগান দেয়। যোগাযোগ ঘটার পাশাপাশি অনেক কিছু দেখা ও জানা যায়; পরামর্শ ও বিনোদনে ভরা, প্রতিদিন নানা রকমের অসংখ্য দৃশ্য-তথ্য সামনে হাজির করে মন-ধ্যান ও চিন্তা-চেতনাকে টেনে নেয়।

এগুলি হয়ে উঠেছে নিজেকে জাহির করার সহজ উপায়। জ্ঞান বিতরণ প্রচারণা কৌতুক ত্বত্ত্ব উপদেশ আদি রস আলোচনা-সমালোচনা সহ প্রায় সব রকমের আয়োজন নিয়ে সামাজিক মাধ্যম গুলি সক্রিয়। ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক রকম সেবা যোগাতে পারার কারণে এদের বিস্তৃতি বিপুল।

সামাজিক মাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ বহু। একটি প্রধান অভিযোগ স্বাভাবিক সংযোগ ও পারিপার্শ্বিকতার সংগে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির। সমাজ ও পরিবেশের সংগে যোগাযোগ করা, খাপ খাওয়ানো, সাম্যতা বজায় রাখা, নিজের চিন্তা-চেতনাকে সমাজের পরিসরে সম্প্রসারিত ও পরিপুষ্ট করা এবং পারষ্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য মানুষের কিছু সহজাত ক্ষমতা ও পদ্ধতি আছে।

সামাজিক মাধ্যম সবগুলিকে ছেঁটে ছোট ও অকেজো করছে। আমরা এই স্বাভাবিক বিষয়গুলি হারাচ্ছি। হয়তঃ একদিন সব বিলুপ্ত হবে। প্রাথমিক ক্ষতিটা হল আমাদের সুস্থ ভাবনা ও মুল্যবোধগুলি এসব অতি আধুনিকতার পাল্লায় পড়ে ঔপনিবেশিক আমলের ন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

বিশেষভাবে সরব অভিভাবকমহল। শিশু-কিশোরদের মাত্রাহীন আসক্তি, বখে যাওয়া, লেখাপড়ায় মনোযোগ হারানো ,পরিবারের প্রতি উদাসীন হওয়া প্রভৃতি অভিযোগের কেন্দ্রীয় বিষয়। এগুলি তাদের গড়ে ওঠা ও বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ করে; অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন। বড়দের বিপদও কম নয়। জাল-জালিয়াতি প্রতারণা ও প্রলোভনের প্রচুর ফাঁদ মাধ্যমগুলিতে বিস্তৃত, বহু মানুষ বিভ্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত।

ব্যবহারকারীদের মধ্যে কম বয়সীদের সংখ্যা অধিক; রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, পার্ক, গাছতলা, ঘরে-বাইরে সবখানে মোবাইলের পর্দায় এদের মনোযোগ একটি সাধারণ দৃশ্য। এদের কৌতুহল বেশী তাই কেবল উস্কে দেয়ার কাজ সামাজিক মাধ্যম গুলো বেশ বুঝতে পেরেছে। সেই সাথে খোরাকও যোগান দিচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক হয়ে উঠেছে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। হয়তঃ জানা নেই কিম্বা মনে নেই এমন অনেক কিছু আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, করণীয় নির্দেশ করে। বিষয়টির প্রতি নাগরিক সমাজের নিস্পৃহতা এর ‘প্রয়োজনীয়তা’ ও ব্যবহার বেড়ে চলায় সহায়ক।

অবশ্য এর কিছু বাস্তব কারণও আছে। বড় বড় শহরের আবদ্ধ পরিবেশে বেড়ে-ওঠা শিশুদের-কিশোরদের উন্মুক্ত বিচরণ ও খেলাধুলার সুযোগ খুব কম। তাই অনেক অভিভাবক সময় কাটানোর সহজ উপায় হিসাবে সন্তানকে মোবাইল ফোন কিনে দেন। অতঃপর শিশুটি তার প্রাপ্য প্রকৃতি পরিবেশ ও সংগীর চাহিদা মেটাতে নিজেকে কাঁচের পর্দায় ঢেলে দেয়। এই পরিস্থিতি তার মানসিকতা ও মেজাজ বদলায়, শারিরীক সমস্যাও তৈরি করে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হওয়া একটি কমন রোগ। ক্রমে সমস্যাগুলো প্রকট হলেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। এক দৃষ্টি কত দিকে যাবে।

সামাজিক মাধ্যমের ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ এক বৃহৎ ও সুন্দর বিভ্রান্তি, ইচ্ছে করলেও ছাড়া যায়না, নানা সুবিধার হাত প্রসারিত করে পেঁচিয়ে ধরে। এই বৈশিষ্ট্য কোম্পানীগুলির একটি কৌশল। কারণ তাতে ব্যক্তি ও সমাজের নির্ভরতার কতক গুরুত্বপুর্ণ ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ব্যবসা অনেকটা চিন্তা মুক্ত। তাই দেখা যায় মাধ্যমগুলো খুব তৎপর; অনুক্ষণ আপনাকে অনুসরণ করে, নানা বিষয়ে স্বতঃস্ফুর্ত (অটো জেনারেটেড) পরামর্শ দেয়। হাতের কাছে পেয়ে সাবলীলভাবে আপনি তা অনুসরণ করেন, অনেকটা সময় তাদের সংগে কাটান; কোম্পানীর চলার পথ প্রশস্থ হয় তবে আপনার নজরে আসেনা।

এভাবে ব্যবহারকারীরা যেন আটকে পড়ছেন সামাজিক মাধ্যমের ‘ভার্চুয়াল’ চরে, মুল ভুখন্ডের সংগে কোন যোগাযোগ থাকছেনা বা থাকলেও অল্প। অযুত তথ্য-দৃশ্য নদীর স্রোতের মত অনবরতঃ ভেসে আসে, দ্রুত চলেও যায়; এর আকর্ষণ অনেক, স্থায়ীত্ব নেই। স্রোতের মতই সেগুলো ব্যবহারকারীর মন থেকেও দ্রুত সরে ও পরবর্তী বিষয়ের জন্য অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে রাখে।

মানুষকে এভাবে আটকানো গুরুত্বপুর্ণ। কারণ ব্যবসাটা অনেকটা স্রোত নির্ভর; স্রোত থামলে নতুনত্ব অনুসন্ধিৎসা ও আকর্ষণ থাকবেনা,ব্যবসা পন্ড। প্রচুর তথ্যের এরুপ আসা-যাওয়া ব্যবহারকারীর মস্তিস্ক ও হৃদয়কেও ভাসমান রাখে, কোথাও থিতু হতে দেয়না।

এটা সম্ভবতঃ অনুকুল মেধা-মনন তৈরির একটি পদ্ধতি। এর বিপরীতে থাকা মুদ্রিত মাধ্যমগুলি অপাংতেয়। বইপত্র ও যোগাযোগের বাস্তব মাধ্যমের ব্যবহার কমছে, দাপ্তরিক প্রয়োজন ব্যতিত চিঠিপত্রের ব্যবহার নেই, পরিবর্তে সবকিছু কাঁচের পর্দা থেকে চটজলদি বুঝে নিতে চেষ্টা করি। এভাবে বেশী কিছু বোঝা যায়না, সেসব স্থায়ীও হয়না

আমাদের পাঠাভ্যাসের জায়গা দখলে নিয়েছে দেখাভ্যাস। প্রথমটি সভ্যতার সন্ধানে মানুষের তৈরি পরেরটি এনেছে কোম্পানী তার ব্যবসার প্রয়োজনে। উদ্দেশ্যগুলি খেয়াল করা দরকার। না হলে স্বকীয়তা হারানোর পরিণাম এড়ানো কঠিন হবে।

এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উদাহরণ প্রাসংগিক। এরা ভারতে অনেক আধুনিক ব্যবস্থা (যেমনঃ রেল) এনেছিল যার দ্বারা গোটা ভারতকে ‘একত্র’ করে সম্পদ সংগ্রহ ও পাচারের কাজ সম্পন্ন করে। স্থানীয়রা, বিশেষ করে অগ্রসর শ্রেণী চুটিয়ে সেসব ভোগ ও ব্যবহার করেছেন।

সামাজিক মাধ্যমগুলির অবস্থা অনুরুপ। প্রবর্তিত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের ধারায় ‘একত্রীকরণের’ কাজ সম্পন্ন, অনেক ক্ষেত্র বেদখল হবার উপক্রম। সহজপ্রাপ্তি ও নেশা এই কাজের সহায়ক। তারা সফল। সামাজিক মাধ্যমগুলো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয় তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তার আগে ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের উপরে এদের প্রভাব নিয়ে নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার।

সাধারণতঃ কোন নতুন বিষয়ের প্রচলন হলে তার ভালমন্দ নিয়ে সমাজে একটা আলোচনা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে তার উপকারীতা-অপকারিতা প্রভাব সহ অন্যান্য প্রাসংগিক বিষয়। সামাজিকতায় যুক্ত হিসাবে সামাজিক মাধ্যমগুলোর আলোচনা আরো বেশী হওয়া উচিৎ। কিন্তু হয়না।

আলোচনা গুলি শুরু না-হওয়ার দায় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির। এর বর্তমান কাঠামো বাজার ভিত্তিক, চলতি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বেশী ব্যস্ত, অন্যগুলির প্রতি সহসা চোখ পড়েনা। তাই খুব দরকারী হলেও এরকম আলোচনা শুরু হয় অনেক দেরীতে। এর একটি বড় উদাহরণ শাসনতান্ত্রিক সংষ্কার

স্বাধীনতার অর্ধশতক অতিক্রান্ত হল জনগণের পুর্ণ ক্ষমতায়ন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং এজন্য অনুকুল একটি সংবিধান তৈরির আলোচনা -রাজনৈতিক মেঠো বক্তৃতা বাদ দিলে বলা যায় -এখনও শুরু হয়নি।

দ্বিতীয় বৃহৎ নজীর এনজিও ও ক্ষুদ্র ঋণ। এদের আবির্ভাব হয় স্বাধীনতার পরেই। আর আলোচনাগুলি সরব হল এর অন্ততঃ দুই দশক পরে যখন ভেতরের কেরামতিগুলি ফাঁস হল। মাঝের এই দীর্ঘ অবকাশে বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় সভা সেমিনার আর গোলটেবিলে বসে বিষয়টাকে এতটা শক্তিমান করে তুলেছেন যে তা কার্যকর হতে অপেক্ষা করতে হয় আরো প্রায় দু’দশক। শেষ পর্যন্ত দরিদ্র বিত্তহীন মানুষকে ৫০/৬০ ভাগ সুদ হারের অসহনীয় নিষ্পেষণ হতে নিষ্কৃতি দিতে যা ঘটে তাতে কথিত বুদ্ধিজীবিদের ভুমিকা সামান্য।

কারণ, যারা সেখানে ছিলেন তারা -ব্যতিক্রম বাদে। এখানে তেমনভাবে থাকতে পারেননি। এনজিও ও ক্ষুদ্র ঋণ ছুটেছে কেবল একটি শ্রেণীর দরিদ্রদের পেছনে। তাতে করে বুদ্ধিজীবিদেরকে অন্ততঃ দুই দশকেরও অধিক সময় ঠেকিয়ে রাখা গেছে।

বর্তমান সামাজিক মাধ্যমগুলি, বিশেষ করে ফেসবুক লেগেছে সবার পেছনে। তাই বলা যায় এদের ক্ষমতা ও স্থায়ীত্ব অনেক বেশী হবে। ফলে এদের নিয়ে আলোচনা সমাজের ঘাটে ভীড়বেও অনেক দেরীতে। ততদিন মাধ্যমগুলি বুদ্ধিজীবিদের ভালভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে যদি গোলটেবিল ও আনুষাংগিক উপকরণগুলির যোগান ঠিক থাকে। হয়তঃ এরপর শুরু হবে সমাধান বা বিকল্পের খোঁজ। ততদিনে সমাজের দফারফা অবস্থা।

সামাজিক মাধ্যমের ভার্চুয়াল জগৎ বাস্তব চর্চা ও অনুসংগী পরিবেশের জন্য সহায়ক হতে পারে তবে বিকল্প নয়। মুল প্রশ্ন আমরা এসব আধুনিক বাণিজ্যিক উপানিবেশবাদ গ্রহণ করব কি না বা কতখানি করব। যতই মনোহর ও আকর্ষণীয় হোক চরের বাস বেশীদিন নয়। মুল ভূখন্ড প্রয়োজন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও দেশটাকে একদিক থেকে আধুনিকতার চরে আটকে ফেলেছিল। আমাদের ভু-সামন্তরা,উঠতি শিক্ষিত সমাজ, ডেপুটি বাবুরা, বিশেষ করে রাজনীতিবিদেরা ছিলেন মশগুল। এখন খবর পাওয়া যাচ্ছে কেউ কেউ অন্দর মহল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

এতদিন পরে এসে পরিষ্কার হচ্ছে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। তারা কেবল সম্পদই নিয়ে যাননি, নৈতিকতা চেতনাবোধ দেশপ্রেম সম্প্রীতি ঐতিহ্য প্রকৃত প্রগতিশীলতা চর্চার নানা ক্ষেত্রে অনেক বড় ধ্বস সৃষ্টি হয়েছে। সে সবের ফল এখনও বহন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে এসে গেল আরেকদল কোম্পানী আরও অধিক আধুনিক সুবিধা নিয়ে, আমরা বেসামাল। বিশেষ ভাবনার বিষয় আচ্ছন্ন থাকা তরুন-কিশোর প্রজন্ম। সেদিকে কারো মনোযোগ নেই।

কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ার আগে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের নীতিমালা ও সমন্বয় প্রয়োজন। এখুনি পদক্ষে নেয়া দরকার, অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

Exit mobile version